পবিত্র কোরআনে মহামারী নিয়ে যত বিবরণ
মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২০, ০৯:০৭ পিএম
ইরাকের একটি মসজিদে জীবাণুনাশক স্প্রে দেয়া হচ্ছে। ছবি: আল মনিটর
পবিত্র কোরআনের দুটি সূরায় মহামারীর কথা এসেছে। প্রথমটি সূরা বাকারায়। ২৪৩ নং আয়াতে। হজরত হিযকিল আ.-এর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে।
বানু ইসরাইলের একটি দলের মাঝে মহামারী দেখা দিয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ ছিল মৃত্যু ভয়ে পলায়ন না করার। কিন্তু তারা পালিয়ে নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল।
দুই পাহাড়ের মাঝে একটি উপত্যকায় তারা সমবেতভাবে পালিয়ে এসেছিল। আল্লাহ তাদের সবাইকে একসঙ্গে মৃত্যু দেন।
কোরআনের ভাষায়, তুমি কি জান না সে সব লোকের কথা, যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে নিজেদের আবাসভূমি পরিত্যাগ করেছিল, তারপর আল্লাহ তাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের মৃত্যু হোক’। তারপর আল্লাহ তাদের জীবিত করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
আরবি আয়াতে আছে, ওয়াহুম উলুফুন, তারা ছিল হাজার হাজার। ঐতিহাসিক বর্ণনায় ৬ লাখ থেকে ৭০ হাজার পর্যন্ত বিভিন্ন মত রয়েছে।
বহু দিন পর হজরত হিযকিল একবার এ পথে যাচ্ছিলেন। সেখানে এত মানুষের কংকাল দেখে আল্লাহর কাছে জানতে চাইলেন এদের অবস্থা।
হজরত হিযকিলের মাধ্যমে আল্লাহ এদের আবার জীবিত করেন। এরা তাদের ঘরে ফিরে গিয়ে দেখে তাদের সন্তান সন্ততি বড় হয়ে গিয়েছে। তাদেরকে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে বাধা দেয় তাদের বংশধররা। পরিচয় জানার পর তারা তাদের বরণ করে নেয়।
বোঝা যায়, এরা নিজেরা বাঁচার জন্য সন্তান সন্ততি এবং অন্য অসুস্থদের পরিত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তাদের এ স্বার্থপরতার শাস্তিস্বরূপ আজাবের মাধ্যমে শেষ করে দেন পলায়নপর পুরো সমষ্টিকে।
এ আয়াতে মূলত এ শিক্ষা রয়েছে, বিপদের সময় কেবল নিজেকে বাঁচাতে চাইলে আল্লাহ আরও বড় বিপদে আক্রান্ত করতে পারেন। বিপদ যত বড়ই হোক না কেন সবার কথা ভাবতে হবে আমাদের।
মানুষকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দেয় এ ঘটনা। অন্যদের বিপদে ফেলে কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধির চিন্তার মতো মন্দ কিছু নেই আল্লাহর কাছে।
সূরা আরাফে আছে, মিসরের কিবতিদের আল্লাহ মহামারী দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, অতঃপর আমি তাদের প্লাবণ, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নিদর্শন; কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল, আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়। (সূরা আরাফ, আয়াত: ১৩৩)
বানু ইসরাইলের উপর দীর্ঘদিনের জুলুমের কারণে আল্লাহ তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলেন। একদিনে সত্বর হাজার কিবতি মৃত্যুবরণ করেছিল মহামারীতে। (তাফসীরে তাবারি)
ফেরাউন বলেছিল, হে মুসা, এ শাস্তি সরিয়ে নাও, তাহলে বানু ইসরাইলকে মুক্ত করে দিব। হজরত মুসা দোআ করলেন। মুসার দোআর পর মহামারী কেটে গিয়েছিল। কিন্তু ফেরাউন তার ওয়াদা রক্ষা করেনি। তারপর সাগরে ডুবে মরেছিল ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়। সে ইতিহাস সবারই জানা।
সূরা আরাফের অন্য আয়াতে বালআম ইবনে বাউরের ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে। বালআম ইবনে বাউর হজরত মুসার বিরুদ্ধে বদ দোআ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার জবান থেকে নিজের সম্প্রদায়ের জন্যই বদ দোআ বের হয়।
তখন সে তার জাতির লোকদের পরামর্শ দেয় যেন সুন্দরী নারীদের বানু ইসরাইলের বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পাঠানো হয়। সুন্দরী রূপসী মেয়েরা বানু ইসরাইলিদের কাছে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে যায়। বানু ইসরাইল এই নারীদের সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হলে আল্লাহর গজব হিসেবে মহামারী আসে।
তাতে সত্বর হাজার ইহুদি মারা যায়। (সূরা আরাফ ১৭৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে তাবারি ও ইবন কাসীর দ্রষ্টব্য)
মুওয়াত্তা মালেক ও ইবন মাজাহ শরিফে হজরত ইবন উমর ও ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা.ইরশাদ করেন, যখন কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী দেখা দেয়।
করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। মহামারীর আকার ধারণ করেছে এ ভাইরাস। এর বাহ্যিক কারণ হয়ত আছে কিন্তু একজন ধার্মিক মুসলিম সব সময় কোরআন-হাদীসের নির্দেশনার প্রতিও দৃষ্টি রাখে সচেতনভাবে।
সে হিসেবে আমাদের অবশ্যই কোরআন-হাদিসে যে কারণগুলোর কথা বলা হয়েছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ সব অপরাধ থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। তাওবা করতে হবে জুলুম, ফুহশ বা অশ্লীলতা এবং সব ধরনের পাপাচার থেকে।
মূলত এ সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বের মানুষের সামনে আমরা পারি ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে। মহামারীর সময়টিকে আমরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।
অন্য ধর্মাবলম্বি মানুষের প্রতি ঘৃণা না ছড়িয়ে আক্রান্ত মানুষের সেবা ও ভালোবাসার মাধ্যমে তাদের আকৃষ্ট করতে পারি ইসলাম ধর্মে।
রাজনৈতিক ইসলাম নয়; মানবিক ইসলামের প্রতি আমরা সুন্দরভাবে আহ্বান জানাতে পারি বিশ্বের সব ধর্ম ও জাতিকে।
তা না করে আমরা আমাদের দেশেরই প্রবাসীদের বাড়ি-ঘরে আক্রমণ করছি। করোনা আক্রান্ত রুগিদের চিকিৎসাকেন্দ্র খুলতে দিচ্ছি না কোথাও।
করোনায় মৃত্যুবরণ করা মানুষদের লাশ দাফন করতেও বাধা দিচ্ছি গোরস্থানে। এ সব সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কী বার্তা দিবে বলে মনে করেন? এ সব ঘটনা আমাদের প্রিয় ইসলাম ধর্মকে যেভাবে খাটো করবে বিশ্ববাসীর সামনে, ছোট করবে বাংলাদেশকেও।
বাঙালি মুসলিম বলে আমরা যারা গৌরব করি আমাদের আরেকটু মানব দরদি হতে হবে। ইসলামের মূল শিক্ষার কাছাকাছি যেতে না পারলে আমরা কখনওই নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করতে পারি না।
মনে রাখবেন, ইসলাম সব সময় মানবিক হতে শিক্ষা দেয়। সংবেদনশীল ও সহানুভূতিসম্পন্ন হবার শিক্ষা দেয় ইসলাম।
নবীজী সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের জন্য যা পছন্দ করে অন্যের জন্যও যদি তা পছন্দ না করে তাহলে সে কখনও মুমিন হতে পারবে না। (সহি বুখারী)
আসুন, করোনার এই বিপদ মুহূর্তে আমরা অসহায় খেটে খাওয়া দিনমজুর, দুস্থ ও দরিদ্রদের সহায়তায় এগিয়ে আসি। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বাড়িয়ে দেই। নিজেদের সুরক্ষিত রেখেই অসুস্থদের সেবার চিন্তা করি।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সহমর্মিতা দেখে পুরো মানব জাতির প্রতিই সদয় দৃষ্টি দিবেন বলে আশা করা যায়। দ্রুতই উঠে যাক করোনার কষ্ট। করোনাকে আল্লাহ তার করুণায় আমাদের থেকে সরিয়ে নিন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ