Logo
Logo
×

পরবাস

২০২০ সালে আমাদের চেতনা হোক দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার চেতনা

Icon

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২০, ১০:৩১ পিএম

২০২০ সালে আমাদের চেতনা হোক দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার চেতনা

১৯৭০ সালের ১২-১৩ নভেম্বরে ঘটেছিল ভোলা ঘূর্ণিঝড় যা এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্নিঝড়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। এছাড়া এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরও জরুরি ত্রাণের ব্যবস্থা করেনি। 
ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বীকার করে সরকার দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণেই ত্রাণকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। 

বাংলার জনগণ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ তোলেন এবং অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করে। একই সাথে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রাদেশিকভাবে জয়লাভ করে এবং ঘটনাপ্রবাহে ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা একটি দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ছিল ৩১৩ টি। এর মধ্যে সাধারণ আসন ছিল ৩০০ টি এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ছিল ১৩ টি। ৩১৩ আসনের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৬৯ টি। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৪৪ টি। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ পূর্ব-পাকিস্তানের ১৬৯ টি সাধারণ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ মোট ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে। 

অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ১৩৮ টি সাধারণ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ সর্বমোট ৮৮ টি আসন পায়। এতকিছুর পরও একটি বিষয়ের ওপর আমি মুগ্ধ হয়েছি তা হলো ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পাকিস্তান আমাদের ওপর অন্যায়, অত্যাচার, ধর্ষণ, খুন সব করেছে তখন তবে ভোট চুরি বা জনগণকে ভোট দিতে বাঁধা দেয়নি। বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ স্বাধীন হতে চায়। স্বাধীন হতে চেয়েছিলাম আমরা নহাটাবাসীও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এসেছিল জীবনে তখন। কারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিন সেই মুক্তিযুদ্ধে? বাংলার মানুষ, নহাটার মানুষ। নহাটা মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি গ্রাম। 

গ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে নবগঙ্গা নদী। দক্ষিণে নড়াইল জেলা। তখন একটি কাঁচা রাস্তার (গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোড) মাধ্যমে নহাটার সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল। এ এলাকায় পাকিস্তানিদের কোনো স্থায়ী ঘাঁটি ছিল না। কিন্তু তারা নিয়মিত টহল দিত। কারণ নহাটায় তখন বেশ কয়েকজন নামকরা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিল সে খবর পাকবাহিনী জানত। তৎকালীন যারা এলাকার কৃতিত্ব সন্তান ছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন আমার নিকটতম (বাবা, চাচা এবং ভাইয়েরা) তাদের দলনেতা ছিলেন চাচা নজির মিয়া এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা ছিলেন চাচা গোলাম ইয়াকুব মিয়া।

গোলাম ইয়াকুব মিয়া আনসার বাহিনীতে চাকরি করতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মাগুরায় প্রতিরোধযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নহাটায় কয়েকবার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ও রণকৌশলে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয় এবং পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ করে এবং আমাদের পুরো নহাটা বাজার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

এমনকি পাক বাহিনী নহাটা হাইস্কুলে সরাসরি ঘাঁটি তৈরি করে। পাক সেনা ও রাজাকার নৌকাযোগে নবগঙ্গা নদী দিয়ে নহাটায় প্রায়ই এসেছে। মো. গোলাম ইয়াকুব ক্ষুদ্র দল নিয়ে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানিদের আকস্মিক আক্রমণ করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন শুরু হয় এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। 

সরাসরি যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের বেশির ভাগই মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন আমার নিজের পরিবারে তাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম মৃধা, কর্নেল হান্নান মৃধা উল্লেখযোগ্য। 
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. গোলাম ইয়াকুবকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। দুঃখের বিষয় সেই স্বাধীনতার সাধ এখন আর নাই। পাকিস্তানিদের মেরে দেশ স্বাধীন করে চাচা বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছিলেন। 

আজ যারা লুটপাট, দুর্নীতি বা অনীতি করছে তারাও কিন্তু আমার সেই কাছের এবং দূরের আত্মীয়স্বজন। তাদেরকে আমরা আর পাকিস্তানিদের মত মারতে বা বিতাড়িত করতে পারছিনা কারণ যে দিকে তাকাই দেখছি এরা আমারই সেই আপনজন। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠেছি। দেখেছি কিভাবে পরিবার এবং গ্রামের সবাই পরাধীন দেশকে স্বাধীন করেছে। ছোটবেলার সেই চেতনা এখনও কাজ করছে মনে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। তারপর কত বছর হয়ে গেল, পরিবর্তন হয়েছে অনেক আমাদের।

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের নিষ্ঠুরতার কারণে আমরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদেরকে যেমন তাড়িয়েছিলাম ঠিক তেমনি করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদেরকে রুখে দাড়াতে হবে। যদিও মায়া মমতায় জড়াজড়ি করে রয়েছে নিজের আপনজন হৃদয়ের মাঝে। তারপরও কিভাবে এদেরকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে এটাই এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা চলছে, পালিত হবে আর কয়েকদিন পরে। দিনটিতে কতকিছু করা হবে শুনেছি। আমি শুধু একটি বাণী শুনতে চাই সবার থেকে তা হোল দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বাণী। এ বাণী সত্যি হবে সেদিন, যেদিন সুইডেনের মত ডিজিটাল বাংলায় ক্যাশ টাকা ছাড়া কেনাবেচা হবে।

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম