Logo
Logo
×

সাহিত্য

অবিচল মুক্তকণ্ঠের স্বয়ম্ভু কবি লুইস গ্লুক

Icon

সেলিম আকন্দ

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:২২ পিএম

অবিচল মুক্তকণ্ঠের স্বয়ম্ভু কবি লুইস গ্লুক

বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম বিশুদ্ধ কবি লুইস গ্লুক। অবিচল মুক্তকণ্ঠের স্বয়ম্ভু কবি হিসাবে তিনি অতুলনীয়। আত্মজৈবনিক ছাঁচে সরলতা ও সজতার সঙ্গে নিজস্ব শৈলী-সহগে ব্যক্তির অনুভব পুঞ্জকে, পরিবার, সমাজ ও দেশকে ছাড়িয়ে বিশ্বজনীনতা দানে তিনি তুলনা রহিত। 

তার কবিতায় উঠে এসেছে মানবজীবনের বিভিন্ন সংকট, সম্ভাবনা, ভয়ভীতি, আশা-আর্তি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, পুরাণ, মিথ, ঐতিহ্য এবং মোটিফের নানা অনুষঙ্গ। জীবনকে নানাভাবে দেখানোর ক্ষেত্রে তিনি খুঁজে পেয়েছেন আত্মজৈবনিকতার সঙ্গে ধ্রুপদী মিথে ও মোটিফের গূঢ় আন্তঃসম্পর্ক। 

তার কবিতায় অনেকেই রাইনের মারিয়া রিলকে এবং এমিলি ডিকিনশনের উত্তরাধিকারকে খুঁজে পান। এ বিবেচনায় তিনি নিজেকে গ্রিক রোমান তথা পশ্চিমা বিশ্বের মূলধারার কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি বলে মনে হয়; বরং ব্যক্তির সংগ্রামকে ইউরোপীয় পুরাণ ও মোটিফের সঙ্গে সংলগ্ন করে আত্ম-আবিষ্কারে প্রয়াস পেয়েছেন তিনি। 

দ্য ভয়েস অব ডিডো, পার্সেফোন, ইউরিডাস, কিংবা অ্যায়াবান্ডান্ড, দ্য পানিশড, দ্য ব্রিত্রেইড এর সবই হলো কবির সে আত্মরূপের মুখোশস্বরূপ; যা সদাই পরিবর্তিত হচ্ছে, ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছে সর্বজনীন। মূলত তিনি তার কবিতায় আত্ম-উন্মোচন, আত্ম-প্রকাশ, আর স্বপ্ন ও বিভ্রমের হিসাব মেলাতে একান্তভাবে মগ্ন। এ বিভ্রম থেকে জেগে ওঠতে তার যে লড়াই ও সংগ্রাম তা যে কাউকে হার মানাবে। 

তার অসামান্য কাব্যকণ্ঠ এবং নিরাভরণ সৌন্দর্যবোধ মূলত ব্যক্তিসত্তাকে সর্বজনীন কর তোলে। তার সৃষ্টির মূলে রয়েছে স্পষ্টবাদিতা। সত্যের স্বরূপ প্রকাশে তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে তার চমৎকার ও নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পারিবারিক সম্পর্কের সেই একান্ত বিষয়গুলোকে তিনি সর্বজনীন করে তুলেছেন। 

মানুষ, প্রকৃতি, মিথ-ঐতিহ্য থেকে প্রেরণা নিয়ে বিশ্বজনীন হওয়ার একান্ত চেষ্টা ছিল তার। তাকে বলা হয় ‘অভ্রান্ত কাব্যিক কণ্ঠের’ কবি। স্বকণ্ঠের এ ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্য ২০২০ সালে তিনি সাহিত্যে মর্যাদাপূর্ণ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। 

নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে তিনি ষোড়শ নারী, যিনি সাহিত্যের এ সম্মাননা অর্জন করেছেন এবং ১৯৯৩ সালে টনি মরিসনের পর সাহিত্যে নোবেল পাওয়া প্রথম আমেরিকান নারী। সুইডিশ একাডেমি তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে ‘কেবল যাপিতজীবনের উত্থান-পতন আর নৈরাজ্যই গ্লুকের কবিতার আধার নয়, তিনি আমূল বদলে যাওয়া পুনর্জন্মের কবি’। 

নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যায়ান্ডারসন অলসন বলেছেন, ‘গ্লুকের কাব্যভাষা অকপট, আপসহীন, সেখানে আছে কৌতুক, আবার কটাক্ষের দংশন’।

লুইস গ্লুক তার কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে সংখ্যার দিকে মনোনিবেশ করেননি, মানের দিকে প্রযত্ন থেকেছেন। সে কারণে ১৯৬২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৫৮ বছরের সাহিত্যিক জীবনে তিনি মাত্র ১২টি কাব্যগ্রন্থ, ২টি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। 

তার রচিত গ্রন্থগুলো হলো ফার্স্টবর্ন (১৯৬৮), দ্য হাউজ অন মার্শল্যান্ড (১৯৭৫), দ্য গার্ডেন (১৯৭৬), ডিসেন্ডিং ফিগার (১৯৮০), দ্য ট্রায়াম্ফ অব অ্যাকিলিস (১৯৮৫), অ্যারার‌্যাট (১৯৯০), দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ (১৯৯২), প্রুফস অ্যান্ড থিওরিজ (১৯৯৪), দ্য ফার্স্ট ফোর লুকস অব পোয়েমস (১৯৯৫), মিডল্যান্ডস (১৯৯৬), ভিটা নোভা (১৯৯৯), দ্য সেভেন এইজেস (২০০১), অক্টোবর (২০০৪), অ্যাভার্নো (২০০৬), অ্যা ভিলেজ লাইফ (২০০৯), পোয়েমস ১৯৬২-২০১২ (২০১২), ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট (২০১৪), অ্যামেরিকান অরিজিনালিটি (২০১৭)।

লুইস গ্লুক ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল নিউইয়র্ক সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং লং আইল্যান্ডে বেড়ে ওঠেন। তিনি হাইস্কুলে পড়ার সময় এনোরেক্সিয়া নার্ভোসায় ভুগতে থাকেন এবং পরে পারিবারিক পরিচর্যা ও আপন আত্মবিশ্বাস বলে এ অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেন। তিনি সারা লরেন্স কলেজ এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন; কিন্তু কোনো ডিগ্রি অর্জন করেননি। 

কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কবিতা শিখিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক অধ্যাপক এবং রোজেনক্রাঞ্জ লেখক; বসবাস করেন ম্যাসাচুসেটস-এর কেমব্রিজে।

শৈশবে গ্লুকের বাবা-মা তাকে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি এবং জোয়ান অব আর্ক এর জীবনীর মতো ক্লাসিক গল্পগুলো শিখিয়েছেন। খুব অল্প বয়সেই গ্লুক কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। ভাষাগত নির্ভুলতা এবং কৌতুকপূর্ণ সুরের গীতিকবিতার জন্য গ্লুক সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তিনি তার কবিতায় আত্মজৈবনিক পদ্ধতি এবং ব্যক্তির অন্তরঙ্গ বিষয়গুলো উপস্থাপনে প্রয়াস পেয়েছেন এবং ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাবলী দ্বারা তিনি বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তার কাজ মূলত ‘থিমেটিক্যালি’ বৈচিত্র্যময় প্রাচুর্যে ভরপুর। 

তিনি ট্রমাতে মনোনিবেশিত ছিলেন এবং মৃত্যু, ক্ষতি, প্রত্যাখ্যান, সম্পর্কে ব্যর্থতা ও নিরাময়ের একত্রীকরণের প্রচেষ্টা সম্পর্কে তিনি তার পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে লিখেছেন। তার প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থগুলো ব্যক্তিগত প্রেমের বিষয়, বিপর্যয়, পারিবারিক লড়াই এবং অস্তিত্বের হতাশায় ঘনায়মান থাকলেও আশাবাদের আর্তিতে আকীর্ণ ছিল। ১৯৬৮ সালে গ্লুকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফার্স্টবর্ন’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমালোচকদের নজর কাড়েন। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘দ্য হাউজ অন মার্শল্যান্ড’ প্রকাশের পর এটিকে অনেক সমালোচক যুগোপযোগী ও যুগান্তকারী সৃষ্টি বলে অভিহিত করেছেন। 

এ গ্রন্থ প্রকাশের পরপর বোদ্ধা সাহিত্য সমালোচকরা তার মধ্যে একটি ‘স্বতন্ত্র কণ্ঠ’ আবিষ্কার করেন। তার দ্য গার্ডেন কাব্যগ্রন্থ আলাদা সুর ও বিষয়বস্তুর কারণে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তার ‘দ্য ট্রায়াম্ফ অব অ্যাকিলিস’ প্রকাশের পর লেখক ও সমালোচক লিজ রোজেনবার্গ এটিকে ‘পরিষ্কার’, ‘বিশুদ্ধ’ এবং ‘তীক্ষ্ন’ সৃষ্টি হিসাবে আখ্যায়িত করেন। 

সমালোচক পিটার স্টিট গ্লুককে ‘আমাদের বয়সের গুরুত্বপূর্ণ কবি’ হিসাবে অভিহিত করেন। পিতার মৃত্যু বেদনায় ব্যথিত কবি গ্লুককে অ্যারার‌্যাট কাব্যগ্রন্থ রচনায় উৎসাহিত করেছিল। অ্যারার‌্যাট প্রকাশের পর গ্লুকের পাঠক সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ গ্রন্থে কবির কাব্যভাষার ভঙ্গিতে তিনটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পারিবারিক জীবন, নিরাভরণ বৌদ্ধিক বিভা আর কবিতার জাল বুননের সূক্ষ্ম কারুকাজ প্রজ্বলতায় যেন প্রকীর্ণ হয়ে ওঠে। তার অ্যারার‌্যাট কাব্যগ্রন্থকে সমালোচক ডুইট গার্নার ‘গত পঁচিশ বছরে প্রকাশিত আমেরিকান কবিতার সর্বাধিক নৃশংস ও দুঃখভরা’ বই বলে অভিহিত করেছেন। 

সমালোচকরা গ্লুকের ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ’ কাব্যগ্রন্থকে উদ্যানের পুষ্পরাজির সঙ্গে তুলনা করে এটিকে ‘দুর্দান্ত সৌন্দর্যের কবিতা’ বলে অভিহিত করেছেন। সমালোচক এলিজাবেথ লুন্ড এটিকে ‘একটি মাইলস্টোন কাজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ গ্রন্থের জন্য গ্লুক সর্বাধিক কবি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার ‘মিডোল্যান্ডস ‘কাব্যগ্রন্থের উপকরণ তিনি গ্রিক ও রোমান পুরাণ থেকে গ্রহণ করেছেন। ‘ভিটানোভা’ কাব্যগ্রন্থটি ব্যক্তিগত স্বপ্ন এবং ধ্রুপদী পৌরাণিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতীক থেকে জাত। 

‘দ্য সেভেন এইজেস’ এ কবির জীবনজুড়ে, তার প্রথম স্মৃতি থেকে মৃত্যুর মনন পর্যন্ত, ভাবনা-চেতনার অপার আকুতির সঙ্গে মিথ-মোটিফের অবিমিশ্র সংশ্লেষ সন্নিবেশিত হয়েছে। ‘অ্যাভার্নো’ গ্রন্থে তিনি পার্সেফোন পুরাণ কে এর ‘টাচস্টোন’ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এ গ্রন্থের কবিতাগুলো মা-মেয়ের মধ্যে বন্ধন, কবিদের বৃদ্ধ হওয়ার ভয় এবং আধুনিক সময়ের পার্সেফোনের একটি বিবরণকে ঘিরে রয়েছে। ‘অ্যা ভিলেজ লাইফ’ গ্রন্থটি নিরাভরণ সৌন্দর্যের আভায় বিভাষিত। এ গ্রন্থে একজন মহৎ কবি যা বলতে পারেন, তার চেয়ে বেশি কিছু বলেছেন গ্লুক।

গ্লুকের আরেকটি কাব্যিক বাস্তবতা হলো প্রকৃতি। ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ’ কাব্যগ্রন্থে এমন একটি বাগানের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, যেখানে ফুলগুলো বুদ্ধিমান, তারা ‘ইমোটিভ’ কণ্ঠ দেয়। ‘দ্য হাউজ অন মার্শল্যান্ড’ গ্রন্থটিও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। গ্লুক কবিতায় মনোবিশ্লেষণের শরণ নিয়েছেন। গ্লুকের নির্বাচিত কবিতা ১৯৬২-২০১২ সমালোচকদের দুর্দান্ত প্রশংসা অর্জন করেছিল। 

সমালোচক এডাম প্লানকোট লিখেছেন, ‘এটি এমন এক কবির প্রতিকৃতি, যিনি বেশ ভালো তন্ময়তায় তাড়িত হয়ে দুর্দান্তভাবে লিখেছেন’। লুইস গ্লুক মূলত নিভৃতচারী। তিনি নিজেকে কোনো বিশেষ অভিধায় দেখতে চান না। নিজেকে ফেমিনিস্ট বলতেও নারাজ তিনি; বরং জীবন ও মৃত্যুর শাশ্বত রহস্য আর প্রকৃতির অনিঃশেষ রহস্যময়তাকেই খুঁজে চলেন তার কাব্যে। তার কবিতার সরল সুরের কূটাভাস পাঠককে চমকে দেয়। পরিবারের চেনা মানুষগুলোর আন্তঃসম্পর্কে চোরা বেদনার একটা চাঁছাছোলা চিত্রায়ণ রীতিমতো ধাক্কা দেয়, সেখানে থাকে না কোনো কাব্য অলঙ্কার; অকপট উচ্চারণে এবং উচ্চকণ্ঠের সৌন্দর্যে তা দ্রবীভূত ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে।

২০০৩ সালে গ্লুককে ১২তম মার্কিন কবি বিজয়ীর অভিধা দেওয়া হয়। এ বছর তাকে ইয়াং সিরিজ অফ ইয়ুঞ্জার কবিদের জন্য বিচারক মনোনীত করা হয়। তার রচনা ‘প্রুফস এবং থিওরিজ’কে ননফিকশনের জন্য পেন/মার্থা এলব্রান্ড এওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। 

পুলিৎজার (১৯৯৩), ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড (২০১৪) এবং বলিঞ্জেন ছাড়াও তিনি তার অসামান্য অবদানের জন্য ইউএস পোয়েট লরিয়েট (২০০৩-২০০৪), ল্যানন সাহিত্য পুরস্কার, সারা তাসডাল স্মৃতি পুরস্কার, এমআইটি বার্ষিক পদক, আমেরিকান একাডেমি অফ আর্টস এন্ড লেটার্স স্বর্ণ পদকসহ বহু পদকে ভূষিত হন। 

এ বছর নোবেল প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তার মুকুটে নয়া পালক শোভা ছড়াল। এ প্রসঙ্গে সমালোচক Vincent Dowd এর মন্তব্য একান্তই প্রাসঙ্গিক, ‘Even in their own country, few poets achieve true fame with the public in their own lifetime. But Louise Gluck has been awardedalmost every prize an American poet might hope for.

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম