Logo
Logo
×

সাহিত্য

‘ইংরেজি আর রাজকীয় ভাষা নেই’

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ০১:১১ পিএম

‘ইংরেজি আর রাজকীয় ভাষা নেই’

ছবি: যুগান্তর

চিন্তক ও মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব ড. সৌমিত্র শেখর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। 

বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত ড. শেখর সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক হিসাবে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন (১৯৯৭) রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। 

প্রকাশিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ’, ‘কলকাতা; বাংলাভাষা : সাহিত্য’ (যৌথ), ‘বাংলাভাষা : ব্যাকরণ ও প্রায়োগিক বাংলা’ (যৌথ), নজরুল-কবিতার পাঠভেদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ‘সিভিল সোসাইটি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, সত্যেন সেনের উপন্যাসে জীবন ও শিল্পের মিথস্ক্রিয়া, ‘ভাষার প্রাণ ভাষার বিতর্ক’। 

ড. শেখর বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ ভাষা-সমিতির জীবন-সদস্য। 

গবেষণার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিনস অ্যাওয়ার্ড ও ময়েনউদ্দিন ফাউন্ডেশন পদক লাভ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: জুননু রাইন

যুগান্তর: দীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন এবং সাহিত্যের অধ্যাপনাও করছেন। এ সাহিত্য যাপনের অভিজ্ঞতায় গত বিশ বছরের আলোকে সাহিত্যের বিশেষ কী পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

সৌমিত্র শেখর: নতুন শতকে বিশ্বের সাহিত্য যেমন, দেশের সাহিত্যও তেমনি বেশ নতুন গতিমুখ সঞ্চার করেছে। বিশ্ব সাহিত্যের মধ্যে ইংরেজির কথাই যদি ধরি, দেখব, রাজকীয় ভাষার তকমা থেকে একে নামিয়ে স্বদেশের ভাষায় পরিণত করেছেন অনেক লেখক প্রায় দেশেই। 

তাই ইংরেজি ব্রিটিশ সাহিত্যের পাশাপাশি কমনওয়েল্থ সাহিত্য নামেও একটি ধারা রচিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি সাহিত্য কিংবা ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্য অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি সাহিত্য তাদের স্বদেশি ইংরেজি সাহিত্যেই পরিণত হয়। 

বাংলাদেশে এটি এখনো ‘ডাঙ্গর’ হয়নি, হাঁটিহাঁটি পা-পা করছে। অনেকে লিখছেন, আলোচনা উঠছে, কিন্তু সময় নিয়ে ধরে থাকছে না। চীন দেশে ইংরেজি চর্চা এখন অনেকটা মুক্ত হয়েছে। আগামী দুই দশক পর চীনেও ইংরেজি সাহিত্য দাঁড়াবে নতুনভাবে। 

কিন্তু প্রবণতার কথা যদি ধরি, ইংরেজি আর রাজকীয় ভাষা নেই, সাহিত্যে এর কৌলীন্যও নেই আগের মতো। নিজ সমাজের ছোটখাটো বিষয়ও লেখায় আসছে। তাই প্রান্তজনের জীবনেতিহাস যেমন, তেমনি দলিতজনের কথাও তুলে ধরা হচ্ছে ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যে। 

সালমান রুশদি, ঝুম্পা লাহিড়ী, অমিতাভ ঘোষের চেয়ে বিজয় টেন্ডুলকর বা ওমপুরী বাল্মীকি নতুনধারা সৃষ্টি করেছেন। আর এ নবধারাটি তারা সৃষ্টি করতে পারছেন বিশ্বচৈতন্যে তাত্ত্বিক বিবর্তনের কারণে। 

প্রভাবটি বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যেও পড়েছে। বিংশ শতাব্দী ‘র‌্যাপিং পেপারে’ সম্পূর্ণ মুড়ে ফেলা যায়নি সত্য কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যচর্চায় সাহিত্যিকরা ভিন্ন শক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। 

আত্মশক্তি নিয়ে লিখছেন লেখককুল; পত্রিকায় প্রকাশনার ধার আর ধারছেন না। হাতে আন্তর্জালিক (ইন্টারনেট) প্রকাশ-মাধ্যম থাকায় লেখক নিজেকে স্বয়ম্ভু মনে করছেন। এতে পূর্বতনদের অস্বীকার করার প্রবণতাও যেমন প্রকাশ পাচ্ছে, তেমনি স্বেচ্ছাচারী ‘আবোলতাবোল’ও যে সৃষ্টি হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। 

কিন্তু সৃষ্টির যেন ঝরনাধারা ছুটেছে, লেখকের যেন মিছিল নেমে এসেছে সাহিত্য সরণিতে। স্বাদেশিকতার ব্যাপারটি আগে থেকেই অন্তর্গত ধর্মীয় লাল ফিতে-নীল ফিতেতে খানিকটা জড়িয়ে ছিলই; আগে সেটি হতো ‘স্বাতন্ত্র্যে’র নামে, এখনো তা হয় ‘স্বদেশ সাহিত্যে’র নামে। 

তবে, পাশ্চাত্যের তত্ত্ব প্রয়োগের চাপ থেকে মুক্ত এ সময়ের লেখককুল, যা বিগত শতকের নয়ের দশকে ‘মাথা-পাগলা’র রূপ নিয়েছিল! ‘ছিঁড়া খেতায় শুইয়া ওমর খৈয়ামের লগে স্বপ্ন দ্যাখতাছি’ জাতীয় বইয়ের নাম সে সময় কোনো কোনো কবি দিয়েছেন। 

অবশ্য, তত্ত্ব-ট্যাবলেট খাওয়া সেই ‘মাথা-পাগলা’রা আবার আলোচনায় আসতে চান শব্দের গায়ে কাদা-বিষ্ঠা কী সব ‘লাগালাগি’ করে। কিন্তু নতুন যুগের নবীন সাহিত্যচারীরা এতে আনন্দিত হন না, বিবমিষাই বোধ করেন। এ পরিবর্তনটি সুখের। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য যে একটি বাস্তবসম্মত কিন্তু শিল্পপ্লাবী রূপ নিতে যাচ্ছে, এটি তারই ইঙ্গিত।     

যুগান্তর: করোনা পরিস্থিতিতে অথবা করোনা পরবর্তী সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে?

সৌমিত্র শেখর: প্রথম কথা শাশ্বতবোধের কোনো পরিবর্তন হবে না। যেমন, আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’-এ মহামারি থামলে বলা হলো, প্লেগের আসা-যাওয়া মানুষের হৃদয়ের হার্দ্যকি অনুভূতিকে, তার অপরিমেয় প্রেমতৃষ্ণাকে সামান্যও নষ্ট করতে পারে না। -এটাই সত্য। 

এবার করোনাকালেও তেমনি হয়েছে; করোনা-উত্তরকালেও মানুষের প্রেমবোধ একই থাকবে। তবে হ্যাঁ, প্রকাশের পরিবর্তন হবে। ‘ডি-টেক্সট’ হয়ে আসবে অনেক কিছু। 

যেমন, রবীন্দ্রনাথের একটি গান আছে, ওরে ও গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল-; সলিল চৌধুরীর গান আছে, পথে এবার নামো সাথি পথেই হবে পথ চেনা। বিখ্যাত সেই লেখাগুলো রাতারাতি ‘অচল মুদ্রা’য় পরিণত হয়েছিল। ২০২০-এর এপ্রিল থেকে সেই গানগুলোর আবেদন ছিল বিপরীত। এমনকি ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’- কার্ল মার্কসের বইয়ে যে ধ্রুব বাক্যটি লেখা ছিল সতত, সেটির উল্টো পাঠ লেখা হয়েছে করোনাকালে: দুনিয়ার মজদুর, ঘরে থাকো, পৃথক হও! 

ফলে, করোনা নতুন অভিজ্ঞতায় লেখকদের মধ্যে নতুন চেতনা জন্ম দিয়েছে আর সে কারণেই নবসাহিত্য ও পল্লবিত সংস্কৃতির উত্থান ঘটতে পারে।  

যুগান্তর: আমাদের সামাজিক ইতিহাসের নিরিখে (’৭১-পরবর্তী) মননশীলতার উন্নতি বা অবনতি সম্পর্কে ২০২০ সালে এসে কী বলবেন?

সৌমিত্র শেখর: মনটা মরে গেলে মননের প্রশ্নই তো অবান্তর। এখন মানুষের মন সজীব নয়, বেশ দুর্বল। মননশীল সৃষ্টি হলো খেজুরের গুড়ের মতো- মন থেকে ফোঁটা ফোঁটা রস সংগ্রহ করে কড়া পাকে তা তৈরি করতে হয়। 

আর মন বাঁচে, পরিপুষ্ট হয় গভীর অধ্যয়ন, সর্বোচ্চ সংবেদন আর পরিধিমুক্ত অনুশীলনের মাধ্যমে। এখন সময় কোথায়? 

অল্পেতে বাজার মাত করার নানা কায়দা মানুষের হাতে। সরকারি বইকেনা প্রকল্পে বই ঢুকানোর কায়দা জানা থাকলে প্রতি বছর বই বের করার প্রকাশকও তৈরি! 

ফলে বই পাঠকের হাতে পৌঁছাক বা না-পৌঁছাক অথবা তারা পড়–ন বা না-পড়–ন প্রতি বছর মিডিয়া কাঁপানোর অস্ত্র হিসেবে প্রচ্ছদচিত্র ঘুরতে থাকে ফোনে ফোনে। 

গভীর অধ্যয়ের সঙ্গে সর্বোচ্চ সংবেদনযুক্ত করার ব্যাপারটি এখন আর নেই। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গল্প-উপন্যাসগ্রন্থ বছরে বছরে বের হলেও প্রবন্ধগ্রন্থগুলো বের হয়েছে বেশ সময় নিয়ে। 

যেমন- ‘পরিচয়’ বের হয়েছে ১৯১৬-এ, ‘মানুষের ধর্ম’ প্রকাশ হয়েছে ১৯৩৩ সালে, ‘কালান্তর’ বের হয় ১৯৩৭-এ, আবার ‘সভ্যতার সংকট’ প্রকাশ পায় ১৯৪১ সালে। মাঝে ছোটখাটো প্রবন্ধের বই বের হয়েছে সত্য কিন্তু যেগুলো রবীন্দ্রনাথকে বিদ্বৎসমাজে বিশেষ স্থান এনে দিয়েছে, সেই প্রবন্ধের বইগুলো লিখতে সময় লেগেছে সেই বড় লেখকেরও। 

কারণ, দীর্ঘদিন ধরে অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতার জারণ না হলে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হয় না। এখনকার লেখকদের হাতে সে সময় নেই। ফলে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়লেও, মননের দিকে খরাই বিরাজমান। 

আগে যেখানে লেখককুল বানানো কালিতে কলম চুবিয়ে লিখতেন এখন সেখানে ল্যাপটপে আঙুল ছুঁইয়ে সে কাজ করেন। 

প্রযুক্তি বা অবকাঠামোগত এ পরিবর্তন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অধ্যয়নের সময় অধিকাংশেরই নেই, প্রকাশের তাড়ায় শশব্যস্ত তারা। তাই আমাদের সামাজিক ইতিহাসের নিরিখে মানুষের বৌদ্ধিক জাগরণে এখনকার মননশীল লেখককুল পূর্বসূরিদের তুলনায় সক্ষমভাবে অবদান রাখতে পারছেন না।

যুগান্তর: বাংলাভাষার কোন গ্রন্থগুলো অন্য ভাষায় অনুবাদ হওয়া দরকার মনে করেন?

সৌমিত্র শেখর: অন্য ভাষা বলতে প্রথমে ইংরেজি, তারপর ইউরোপীয় ভাষা। চাইনিজ ম্যান্ডারিনে হলে ভালো। কারণ, অনেক মানুষ সে ভাষা ব্যবহার করেন। 

কিন্তু চায়নায় বই প্রচার ও বিপণন নীতির কারণে অনূদিত ম্যান্ডারিন ভাষার বই সবার হাতে পৌঁছবে না। যা হোক, আমার কাছে মনে হয়, বাঙালির মরমি রচনাগুলো অনূদিত হয়ে বাইরের পাঠকদের সামনে আসা দরকার। 

সে ক্ষেত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগের নির্বাচিত কবিতা এবং বাউল ও লোকদর্শনের গীতিভাবযুক্ত রচনা উল্লেখযোগ্য। ভিন্ন দেশে এগুলোরই সমাদর বেশি। 

মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ যে নোবেল পুরস্কার পেলেন, তার প্রধান কারণ কিন্তু ‘গীতাঞ্জলি’র মরমিভাব। ছোটগল্প বা উপন্যাস- যা কিনা মূলত পশ্চিমেরই র্ফম- সেগুলোর প্রতি একটু পরে মনোযোগ দেওয়াই ভালো। 

যুগান্তর: বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যে ভালো লেখকের অভাব নাকি ভালো মানের পাঠকের অভাব?

সৌমিত্র শেখর: পাঠক ঠিকই আছে, স্বল্পতা ভালো লেখকের। একে ‘অভাব’ও বলা যায়। অবশ্য ভালো লেখক কম বলেই তারা ‘ভালো’। রবীন্দ্রনাথের কথায়- তা না হলে নিজেদের ভিড়ে তারাও হয়ে যেতেন মাঝারি! 

গদ্যসাহিত্য ও কাব্যসাহিত্য দু’ক্ষেত্রেই তরুণদের মধ্যে অনেকে ভালো লেখার চেষ্টায় আছেন। কিন্তু কারও কারও মধ্যে নিজেকে নিয়ে আত্মম্ভরিতার প্রকাশ বেশ অরুচিকর লাগে।  

যুগান্তর: যাদের লেখা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, জীবিত এমন তিনজন লেখকের নাম-

সৌমিত্র শেখর: যতীন সরকার, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিনা হোসেন।

যুগান্তর: লেখক হিসেবে বহুল আলোচিত কিন্তু আপনার বিবেচনায় এদের নিয়ে এতটা আলোচনা হওয়ার কিছু নেই এমন তিনজন লেখকের নাম।

সৌমিত্র শেখর: নাম বলার প্রয়োজনবোধ করি না। লেখক হিসেবে ‘বহুল আলোচিত’ ব্যাপারটি সর্বত্র, সর্বদেশেই সাম্প্রতিক সাহিত্যে থাকে। সময়ই শ্রেষ্ঠ বিচারক। আমাদের দেশে আকবর হোসেন নামে একজন লেখক ছিলেন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। 

১৯৫০ সালে তার লেখা উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ লাখো কপির ওপর বিক্রি হয়েছে। এ উপন্যাসের টাকায় তিনি ঢাকায় বাড়ি করেছেন বলে জানা যায়। একজন মুসলিম কুমারীর গর্ভে বিয়ে-বহির্ভূত সন্তান- সদ্য নয়া-পাকিস্তানে বিষয় হিসেবে ছিল ‘হটকেক’। 

এরপর একই ধারায় প্রায় দেড় ডজন উপন্যাস তিনি লেখেন। কিন্তু কুড়ি বছরের মধ্যে তিনি হারিয়ে যান। আশির দশকে তার মৃত্যু হলে খুব কম সংখ্যক লোক সে সংবাদ নেন। ফলে ‘বহুল আলোচনা’ বা নানাভাবে ‘ইমোশন ব্ল্যাকমেইল’ করে বিক্রি বাড়ানোতে লেখকের নগদ আর্থিক লাভ হতে পারে কিন্তু মহাকালে তার স্থায়িত্ব সামান্যই। 

আমাদের দেশে কোনো কোনো লেখক বইয়ের নামে ‘প্রেম’ বা ‘ভালোবাসা’ শব্দ প্রয়োগ করে উপর্যুপরি বই লিখে ভাত-মাংসের জোগান নিয়েছেন। তারাও আজ বেঁচে। পাঠক তো সে বইগুলোর নাম ভুলেই গেছেন, তাদেরও বোধকরি মনে নেই। 

এগুলো ‘পপুলার ডেইলি সোপ’- লেখকও জানেন, জেনেই নানা রংঢং করেন; মিথ্যে ‘অ্যাডভান্স সেল’-এর বুলিতে গুরুত্ব বাড়াতে চেষ্টা করেন। গুরুত্বপূর্ণ লেখকেরা কালে তারকামণ্ডলে বৃহস্পতির মতো বড় ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, নিজের বিজ্ঞাপন নিজের করতে হয় না।

যুগান্তর: এখানে গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা কী কম আলোচিত? যদি সেটা হয়, তাহলে কী কী কারণে হচ্ছে? এমন তিনটি সমস্যার কথা উল্লেখ করুন :

সৌমিত্র শেখর: কম আলোচিত। কারণ স্পষ্ট : আলোচনা-প্রকাশের ক্ষেত্র কী? প্রকাশনা? সে তো টাকাওয়ালাদের রক্ষাঢাল হিসেবে প্রকাশ পায়! তাই সামরিক বা প্রশাসনিক অধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা বড় লেখক হিসেবে এক দশকের মধ্যে ‘ভূলোক-দুলোক-গোলক ভেদিয়া’ প্রকাশ হন! 

অথচ, তাদের উত্থানের ধারাবাহিক ইতিহাস নেই। শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকাগুলোও তাই। শুধু অর্থ ও মালিকানার কারণে প্রথিতযশা ও জাতীয় অধ্যাপকের নামের ওপর মুদ্রিত হয় ব্যবসায়ীর নামসুরত। 

মীর মশাররফ হোসেন বলেছিলেন: হে অর্থ, পাতকী অর্থ, তুমিই সব সর্বনাশের মূল! -আজ সেটিই দেখা যাচ্ছে। তাই ‘সিরিয়াস’ ও ‘মেজর’ লেখকরা অলোচনার পাদপ্রদীপে আসেন না। তরুণেরাও দ্রুত আলোচনায় আসতে চান, চিত্তলোক জয় তাদের উদ্দেশ্য থাকে না। 

কারণ, সাহিত্যের প্রাথমিক পুরস্কারগুলো বিত্তবানদের হাতে। পুরস্কার হিসেবে পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতে তুলে দিয়ে অন্তর্জালে (ইন্টারনেটে) বছরব্যাপী সেই অনুষ্ঠানের ফটো যদি প্রদর্শন করা হয়, সেই প্রচারের লোভে তরুণেরা পড়তেই পারেন। 

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তরুণদের জন্য কোনো পুরস্কার প্রবর্তিত নেই! তাই, লেখার চেয়ে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের করে বিচারক হিসেবে থাকতে পারেন এমন গোটা কুড়িজনের জন্য ‘বিশেষ সংখ্যা’ বের করার ইঁদুর দৌড়েও ব্যস্ত অনেক তরুণ লেখক। 

গুরুত্বপূর্ণ তরুণ লেখকেরা আলোচনার অন্তরালেই থেকে যান। আবার বিশেষ ‘ঘারানা’ না হলেও আলোচনায় আসা যায় না। এটিও একটি সংকট।

যুগান্তর : সাহিত্য থেকে হওয়া আপনার দেখা সেরা সিনেমা।

সৌমিত্র শেখর : ছবির নাম : ‘ডক্টর ঝিভাগো’। রুশ লেখক ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত বোরিস পেস্তারনাক লিখিত একই নামের উপন্যাস (১৯৫৭ সালে প্রকাশিত) বিশ্বজুড়ে বিতর্ক তোলে। ডেভিড লিনের পরিচালনায় এটি কয়েক বছর পরে চলচ্চিত্র হিসেবে দর্শকের সামনে আসে।

যুগান্তর: জীবিত একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের নাম বলুন।

সৌমিত্র শেখর: শেখ হাসিনা।

যুগান্তর: দুই বাংলার সাহিত্যে তুলনা করলে বর্তমানে আমরা কোন বিভাগে এগিয়ে কোন বিভাগে পিছিয়ে?

সৌমিত্র শেখর: দুই বাংলা বলে কিছু নেই। সেভাবে বললে, বাংলা অনেক স্থানে: ত্রিপুরা, আসাম, ইউরোপ-আমেরিকার বাংলাকে অস্বীকার করব কীভাবে? আসলে, পশ্চিমবঙ্গের গদ্য সাহিত্য অনেক এগিয়ে, আমরা কাব্য সাহিত্যে অনেক দূর এগিয়েছি- বিশেষ করে সাম্প্রতিক কাব্য সাহিত্য।

যুগান্তর: একজন অগ্রজ এবং একজন অনুজ লেখকের নাম বলুন, যারা বাংলা সাহিত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সৌমিত্র শেখর: অগ্রজ লেখক হাসান আজিজুল হক আর অনুজদের মধ্যে একাধিক।

যুগান্তর: এমন দুটি বই, যা অবশ্যই পড়া উচিত বলে পাঠককে পরামর্শ দেবেন।

সৌমিত্র শেখর: বিশ্ব সাহিত্য থেকে : আমেরিকান লেখক অর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন দ্য সি’ নামের খুব ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস আর বাংলা সাহিত্য থেকে: রবীন্দ্রনাথের ‘সং অফারিংস্’-এর বাংলা কবিতাগুলো।

যুগান্তর: লেখক না হলে কী হতে চাইতেন।

সৌমিত্র শেখর: তরুণ বয়সে বাবার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছাড়তে চেয়েছিলাম এবং আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। 

যুগান্তর: গানে আছে ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’- আপনার জীবনে কয়বার এসেছিল?

সৌমিত্র শেখর: বহুবার। এখনো আসে। বিয়ের পর প্রেম হলো বদ্ধ ঘরে জানালার ধারে বসে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা। তাতে শরীর ভেজে না কিন্তু কখনো কখনো মধ্যমা, তর্জনী হালকা সিক্ত হয়। বৃষ্টিরও বুঝি মন্দ লাগে না!

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম