মুনতাসীর মামুনের ‘স্মৃতিরেখায়’ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস
আবুল বাশার নাহিদ
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:২৩ এএম
ফাইল ছবি
জীবনের বহু স্মৃতিরেখা কালের ধুলোয় অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায় অদৃশ্যে। যারা অমাবস্যার অন্ধকারেও ভোরের আলোর প্রত্যয়ী তাদের স্মৃতিরেখা কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠে। তারা সাধারণের বৃত্তে থেকেই অসাধাণ হয়ে উঠেন।
জনমানুষ এসব কালোত্তীর্ণ মানুষের স্মৃতি অভিজ্ঞতায় প্রেরণা-নির্দেশনা খুঁজে ফেরেন। জীবনের খেরোখাতায় শব্দের ক্যানভাসে তারা তুলে আনেন বহমান সময়ের স্থিরচিত্র। যেমন ভাস্কর তার সৃষ্টি কর্মে ফুটিয়ে তুলেন সময়ের গল্প।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিগত পঞ্চাশ বছরের কর্ম জীবনের নানা আঙিনায় বহুমাত্রিক শৈল্পিক চিত্ররূপময় স্মৃতির কবিতায় রেখা এঁকেছেন। জীবনে হেঁটেছেন বহু পথ আর এঁকেছেন শৈল্পিক নানান ছবি।
যিনি একাধারে ছাত্র রাজনীতিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, চিত্র সমালোচক, শিশু সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, সংগঠক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার আর কিংবদন্তী ঐতিহাসিক ।
মুনতাসীর মামুন বিগত পাঁচ দশকে কাজ করেছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা একাডেমিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদের সাথে। তাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে এঁকেছেন বহু রঙিন স্মৃতি ।
তার কলমের আল্পনায় ফুটে উঠে বাংলাদেশের বিগত পঞ্চাশ বছরের সাংস্কৃতিক বহু ক্যানভাসের আলপনা।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস বিনির্মাণে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের স্মৃতিচারণমূলক ‘স্মৃতিরেখা’ গ্রন্থটি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।
যা সুবর্ণ প্রকাশনী থেকে ২০১৯ সালের একুশে বই মেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের বিগত পাঁচ দশকের প্রায় প্রতিটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মযজ্ঞে তিনি জড়িত ছিলেন।
কাজ করেছেন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সাথে। তাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে স্মৃতির থলিতে জমিয়েছেন বহু স্মৃতি আলপনা। তাতে যেমন রয়েছে সুখস্মৃতি তেমনি রয়েছে রাষ্ট্র যন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলার দ্রোহের দিনগুলির গল্প।
সেসব স্মৃতি তিনি বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় কলাম আকারে তুলে ধরেছেন। সে লেখাগুলোর সমন্বয়েই ৩২০ পাতার ‘স্মৃতিরেখা’ গ্রন্থটি। বইটিতে তিনি ছাব্বিশ জন ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করেছেন।
যাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি, স্থপতি, বিচারপতি ও রাজনীতিবিদ; যাদের সাথে তিনি বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন।
বইটি শুরু হয়েছে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে স্মৃতিচারণ দিয়ে। অধ্যাপক মামুন তার স্বভাবসুলভ সাবলীল ভাষায় আব্দুর রাজ্জাকের সাথে স্মৃতির চিত্র তুলে ধরেন। যদিও এটি তাদের দুজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান ছিল; কিন্তু তার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে তৎকালীন শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক, আব্দুর রাজ্জাকের রাষ্ট্রভাবনা, সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবনা।
শব্দের জাদুতে অধ্যাপক মামুন ভিন্ন এক আব্দুর রাজ্জাককে তুলে আনেন। পাঠক শুধু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের গল্পই শুনবে না বরং তার গল্পের ভিতর দিয়ে বিগত পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তর দশকের বাঙালি সমাজের বিভিন্ন গল্পের সাথে পরিচিত হবে।
লেখকের ভাষায় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মতো। বাঙালি সমাজের প্রখ্যাত এ বুদ্ধিজীবীকে লেখক যেভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তা এককথায় অনন্য।
সমসাময়িক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রদের মাঝে আব্দুর রাজ্জাককে জানার যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, অধ্যাপক মামুনের এ স্মৃতিচারণ লেখা তাকে জানার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে। যদিও তিনি এ লেখাগুলো অনেক আগেই লিখেছেন।
লেখক তুলে ধরেছেন শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্র। শব্দের কল্পচিত্রে তিনি দেখিয়েছেন পশ্চিম বাংলার রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সদস্য হয়েও কীভাবে প্রগতিশীল চিত্রশিল্পী হয়ে উঠেন।
লেখক শিল্পী কামরুল হাসানের জবানিতে ফুটিয়ে তুলেছেন আর্ট স্কুলে পড়ার গল্প, গোরস্থানের নকশা করে টাকা উপার্জন, টাকার অভাবে নয়মাইল পাড়ি দিয়ে কাজ করা, জয়নুল আবেদিনের সাথে সম্পর্ক ও জীবনের টানাপোড়েনের গল্প।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বিখ্যাত পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ তিনি কীভাবে আঁকলেন তার বর্ণনাও লেখক এঁকেছেন সাবলীল ভঙ্গিতে।
কামরুল হাসানের গল্প বলার সাথে সাথে লেখক বাংলাদেশের শিল্প চর্চার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফলে আলোচনাটি শুধু কামরুল হাসানে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং বাংলাদেশের শিল্প চর্চার ইতিহাস জানার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
আর লেখকের মন্তব্যে ‘কামরুল হাসান, যাকে বাদ দিয়ে আমাদের শিল্প চর্চার ইতিহাস তো বটেই সাংস্কৃতিক ইতিহাসও লেখা যাবে না।’
অধ্যাপক মামুন কবি সুফিয়া কামালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেন ‘সবাই বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে তার মরদেহের সামনে। চোখ অশ্রুতে টলমল। কিন্তু তিনি তো বিহ্বল হননি কখনও শোকে। কান্নায় ভেঙে পড়েননি কখনও।’
কীভাবে কবি সুফিয়া কামাল ১৯৫২ সাল পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, কীভাবে তিনি ‘খালাম্মা’ হয়ে উঠলেন তার বিবরণ পাওয়া যায় লেখনিতে। আপাদমস্তক বাঙালি ধার্মিক রমণী, অসম্ভব অসাম্প্রদায়িক সুফিয়া কামাল ছিলেন প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসকের সময় গণতন্ত্রমনা মানুষের আশ্রয়স্থল। লেখক দেখিয়েছেন সর্বদা সাধারণ থাকতে চাওয়া সুফিয়া কামাল কীভাবে জনমানুষের কাছে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন।
অধ্যাপক মামুন আলোচনা করেছেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম শিক্ষা সচিবের পদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার গল্প, পরবর্তী প্রগতিশীল এবং মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের প্রতিটি গল্পে কবীর চৌধুরী কীভাবে লেখক তথা এ দেশের প্রগতিশীল মানুষের বটবৃক্ষের ভূমিকা পালন করেছেন; তা দেখিয়েছেন।
অধ্যাপক মামুন স্মৃতিচারণ করেছেন তার শিক্ষক অধ্যাপক সালাহউদ্দিনকে নিয়ে। তাকে নিয়ে আলোচনা শুধু শিক্ষক-ছাত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং পাঠক তাদের আলোচনার মধ্য দিয়ে পাবেন সামাজিক ইতিহাস, কথ্য ইতিহাস, আর ইতিহাসের নানান দিকের সহজপাঠ।
তিনি আলোচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শহীদ শিক্ষকদের নিয়ে। স্মৃতিচারণ করেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে। যিনি তার শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু কাজে লেখক তার সাথে জড়িত ছিলেন।
তার স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে শুধু সিরাজুল ইসলামকেই জানা যায় না বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংস্কৃতির সাথে পরিচয় মেলে।
অধ্যাপক মামুন স্মৃতিরেখায় চিত্র এঁকেছেন জাহানারা ইমামের। কতশতস্মৃতির পাণ্ডুলিপিতে ......... স্পষ্ট হয়ে উঠে শহিদ রুমির প্রতি তার ব্যাকুলতা, মুক্তিযুদ্ধে বদলে যাওয়া জীবন, আবার প্রয়োজনেই রাজপথের বিক্ষুব্ধ দিনগুলিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বাস্তবায়নে তার অসামান্য ত্যাগের স্মৃতি পাঠকের চোখ জলে ঝাপসা করে দেবে।
স্মৃতির স্কেচে তুলে এনেছেন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক শিল্পী ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীকে।
শিল্পী হাসেম খানকে নিয়ে লেখায় গত পাঁচ দশকে লেখক ও তিনি কতশত বিচিত্র ধরনের কাজ একসাথে করেছেন তার চিত্রগল্প পাওয়া যায় স্মৃতিরেখায়।
পাঠক জানতে পারবেন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঢাকা জাদুঘর, আদিবাসীদের নিয়ে জাদুঘর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘টাকার জাদুঘর’, গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, গণহত্যা-বধ্যভূমিতে ফলক স্থাপন, ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে নির্মিত ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান’, ত্রিপুরার জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে একটি কক্ষ, বাংলাদেশের প্রথম থিমেটিক ক্যালেন্ডারের পরিকল্পনা, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের সম্মান জানানোর প্রস্তাব, জাতীয় জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্যালারি, ১৯৭১ সালের গণহত্যা নির্যাতন বিষয়ক ৭১টি ডাকটিকিট প্রকাশসহ কত শত কাজের উদ্যোগের সাথে তারা জড়িত ছিলেন।
এসব কাজের তাগিদে তারা সারাদেশ চষে বেরিয়েছেন। স্কেচ করেছেন আর বই বের করেছেন। তাদের তুলি আর কলমে ফুটে উঠেছে অপরূপ বাংলার নৈসর্গিক চিত্ররেখার গল্প যা পাঠককে নতুন এক জগতের সন্ধান দিবে।
অধ্যাপক মামুন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল গাফফার চৌধুরীর । তিনি তার পাঁচ দশকের জীবনের গল্প বলেছেন। যার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস।
বিশেষত গত শতকের পঞ্চাশের দশক এবং ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নানা অজানা অধ্যায়ের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বলেছেন তার ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিখ্যাত গানের স্মৃতি গল্প, শুনিয়েছেন ১৯৭১ এ সাংবাদিক হিসেবে তার ভূমিকার গল্প।
লেখক স্মৃতিচারণ করেছেন বিচিত্রা পত্রিকার গল্প। যেখানে শাহাদাত চৌধুরী সাথে তাদের স্মৃতির চিত্র এঁকেছেন। তার এই চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ব্যাপক পরিচিত ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার নানা গল্প’ যা বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে।
লেখক গল্প বলেছেন রাজনীতিবিদ আবুল মাল আব্দুল মুহিতের। রাজনীতির বাইরেও নতুন এক মুহিতকে পাঠক খুঁজে পাবেন এখানে।
স্মৃতির আলপনায় খুঁজে ফিরেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়াকে। লিখেছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরকে নিয়ে।
অধ্যাপক মামুন স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান, বিচারপতি কে এম সোবহান, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক ও শিল্পী কাজি হাসান হাবিবকে নিয়ে।
যারা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস জানতে আগ্রহী, সেসব পাঠকের জন্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের "স্মৃতিরেখা" বইটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বইটি যেমন সুখপাঠ্য তেমনি তথ্যবহুল।
লেখক: আবুল বাশার নাহিদ, লেকচারার, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী