ইনতেজার হুসেইনের বাস্তি: উপন্যাসের অনন্যপাঠ

ফিরোজ শাহরিয়ার
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:২৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
একটা দেশভাগ, একটা ইতিহাস; কিছু বেদনাময় সম্পর্ক; ধর্ম, প্রেম, ভাঙন।এক শহরের গল্পে চলে আসে রাজনীতির কাটাকুটি চাল; দিল্লি, লাহোর, ঢাকা। স্বাধীনতা আর অধীনতা।
ইনতেজার হুসেইনের বাস্তির গল্প ঘরে ফিরতে চাওয়া মানুষের গল্প। রূপনগর, বিয়াসপুর, মিরাঠ, ধনপুর। আত্মর আত্মা, গুহা, নির্জন বন আর এক সাবিরা।
উপন্যাসের নায়ক জাকির তার নতুন চোখ, পৃথিবী, আসমান, মাটি আর বৃক্ষরা তার কাছে নতুন। জাকির বড় হয়, দিনে দিনে বদলে যায় তার জগৎ। নীলকণ্ঠ, কাঠঠোকরা, ময়ূর, পায়রা, কাঠবিড়ালি, টিয়ার গল্পে ঢুকে যায় বিধ্বংসী মিছিলের রাগী স্লোগান, গুলির শব্দ। চারপাশে তাকিয়ে দেখে ধ্বংসোন্মুখ চারপাশ।
মুসলিম পরিচয় এ এক বড় সংশয়, প্রাণের ভারতবর্ষ এত সহজে কি ছাড়া যায়! শুরু হয় কাঁটাতারের নতুন জীবন।
একাত্তরের ডিসেম্বর মাসে ডায়েরি লেখা শুরু করে গল্পের নায়ক জাকির। সাতচল্লিশ, ঊনসত্তর ও একাত্তর পেরিয়ে জাকির আসে পাঠকের মনের দরজায় ঠাঁই-ঠিকানাহীন বাস্তুহারা হয়ে। যে শহরে ঘরদোরহীন বেকারের অর্থহীন দিনাতিপাত সেখানে আফজাল সময় কাটায় অস্থির বাতুলতায় মদে ও প্রলাপে, ইরফান ঝাঁজে।
সালামত আর আজমল ওরা শুধুই ‘ইন্টেলেকচুয়াল’, শিরাজে বসে দিনাতিপাত হয় ওদের শিল্প-সাহিত্য তর্কে, জাওয়ার তাদের মাঝে অল্প বয়সী পণ্ডিত। জ্ঞানের তালাশে শরাবে কাটায় দিন, খোঁজে অভিজ্ঞতা, সঙ্গে গাঁজা, আফিম ও ভাং।
পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস তাদের বয়ানে ‘গণ্ডগোল’। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া না হওয়ার ভালো আর মন্দগত দিকে তারা পৌঁছে যায় চরম দ্বিধায়, ভুলে ভালো হলো, নাকি ভালোয় ভুল হলো এই প্রশ্নের অমীমাংসিত জিজ্ঞাসায় বাস্তির গল্প শেষ হয়। আর সে জিজ্ঞাসা রয়ে যায় পাঠক মনেও।
ইনতেজার হুসেইন মূলত ছোটগল্পকার। গল্প বলতে জানেন বলেই গল্পের ভেতরে ছড়িয়ে রাখেন বাস্তব-অতিবাস্তবের ইন্দ্রজাল। জাকিরের জটিল মনোবিশ্লেষণে যেসকল গল্প ঘুরেফিরে আসে তার জন্য পাঠকের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর ধর্মীয় গল্পের সঙ্গে পরিচয় থাকা লাগে।
লঘুতে গুরু চাল অথবা গুরুতে লঘুবাক ইনতেজারের আখ্যান বয়ান বৈশিষ্ট্য, গভীর চিন্তার অতলস্পর্শী অনুভবে ইনতেজার হুসেইন অনন্য।
মহাভারত, রামায়ণ, উপনিষদ, পঞ্চতন্ত্র, কথা সরিৎসাগর, জাতককথা, সুফিগল্প, আলিফ লায়লা, পশুপাখিদের বুলচাল—কালিলা ওয়া দিমনা, নবিদের কেচ্ছাকাহিনি, কারবালার ঘটনা বা আখ্যান, শেক্সপিয়রের নাটক আর নানি আম্মার কাছ থেকে শোনা গল্পে পরিপূর্ণ যার ঝুলি তার গল্প পাঠকের কাছে বহুরৈখিক ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠবে একথা বলাই বাহুল্য।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ইনতেজার হুসেইনকে মান্টোর পর আধুনিক উর্দু সাহিত্যের সবচে’ শক্তিশালী লেখক বলে আখ্যায়িত করেছে। যদিও আমার কাছে মান্টোর চেয়ে ইনতেজারই বেশি প্রিয়, কেননা পৌরাণিক আখ্যান, মোহময় গল্পের বয়ান, নারী-পুরুষের প্রেম-অপ্রেম, হিন্দু-মুসলমানের মিলন-বিচ্ছেদে তিনি এককথায় অতুলনীয় আখ্যানকার।
ইঙ্গিতে, প্রতীকে উপন্যাসটির বর্ণনরীতি শুধু পাঠক নয় মননশীল লেখকদেরও টেনে নেবে এক বিষ্ময়কর চিন্তার জগতে।
দ্য হিন্দুর মতে, বাস্তি দেশভাগের উপর রচিত সম্ভবত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এ উপন্যাস এমন এক উপন্যাস যা উর্দুভাষী অভিবাসীদের স্থায়ীভাবে শেকড়চ্যুত হওয়ার বেদনার সাথে সাথে পরিবেশন করেছে বাংলাদেশের জন্মগাঁথাও।
সাতান্নর সিপাহি বিপ্লব, সাতচল্লিশের দেশভাগ, পয়ষট্টির ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের বাঙালির সংগ্রাম তথা ভারতবর্ষের বসতির খণ্ডবিখণ্ডের ইতিহাসের এক অখণ্ড দলিল এই বাস্তি উপন্যাস।
উর্দু ভাষার আমেজ ও মেজাজকে অবিকৃত রেখে সেটিকে ঝরঝরে বাংলায় অনুবাদ করে শৈল্পিক কুশলতার কাজটি সম্পন্ন করেছেন সালেহ ফুয়াদ, যিনি বাঙালি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একজন মহান উপমহাদেশীয় লেখকের সাথে। অনুবাদককে অভিনন্দন!
দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। ২০৬ পৃষ্ঠার বইটি ৪০০ টাকা মলাটমূল্য ধরা হয়েছে। প্রকাশক ঐতিহ্য। বইটি পাওয়া যাবে রকমারী ডটকমেও।