Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

পূর্ববঙ্গে কচুরিপানা

Icon

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পূর্ববঙ্গে কচুরিপানা

কচুরিপানার সঙ্গে পরিচিত নন, এমনটা খুঁজে পাওয়া ভার। এটি এমন একটি ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, যা বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং দ্রুত প্রজনন ক্ষমতার জন্য এটি সুপরিচিত। কচুরিপানা নিয়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস। পূর্ববঙ্গে একটা সময় কচুরিপানার প্রকোপ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, এটি নিধনের জন্য বিশেষ আইনও প্রণয়ন করতে হয়েছে। গাণিতিক সমস্যা থেকে শুরু করে লোকগীতি, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কবিতাতেও স্থান করে নিয়েছে কচুরিপানা।

‘প্রবাসী’ (শ্রাবণ ১৩৬১) পত্রিকায় স্থান পেয়েছে কচুরিপানার সচিত্র প্রতিবেদন। শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মিত্র তো ‘কচুরি পানা’ শিরোনামে ৫৫ পৃষ্ঠার গোটা একখানা পুস্তিকাই রচনা করেছেন! সে কালের পাঠ্যবইতে সংযুক্ত ছিল কচুরিপানা নিয়ে অঙ্ক-‘একটি পুকুরে কচুরিপানা প্রতিদিন দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পায়। এভাবে ৬০ দিনে পুকুরটি কচুরিপানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ১৫ দিনে পুকুরটির কত অংশ কচুরিপানায় পরিপূর্ণ হবে?’ এ গণনা সে সময়ে কচুরিপানার দ্রুত বিস্তারের বিষয়টিকেই মনে করিয়ে দেয়। লোকগীতেও কচুরিপানার উপস্থিতি লক্ষণীয় ‘থাকিলে ডোবাখানা, হবে কচুরিপানা, বাঘে হরিণে খানা একসাথে খাবে না ও মরি, স্বভাব তো কখনো যাবে না!’

পূর্ববঙ্গে কচুরিপানার বিকাশ

কচুরিপানার প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৮৯০-এর দশকে ফ্লোরিডায়, ১৮৯৫ সালে কুইন্সল্যান্ডে, ১৯০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়, ১৯০৮ সালে কোচিনে এবং ১৯১৩ সালে মায়ানমারে। ১৯০৮ সালের ২১ মার্চ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘দ্য লিটারারি ডাইজেস্ট’ পত্রিকায় যা উদ্ধৃত হয়েছে। এ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ ছিল যার শিরোনাম ছিল, ‘অ্যান আনসলভড প্রবলেম অব দ্য ওয়াটার হায়াসিন্থ’। বিশ শতকের গোড়ার দিকে স্কটিশ অভিবাসী এবং নারায়ণগঞ্জের পাট ব্যবসায়ী জর্জ মরগানের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে কচুরিপানা এসেছে বলে ধারণা করা হয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার সময় তিনি ফুল ও পাতার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এ উদ্ভিদটি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। অপর আরেকটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা হলো, ১৮৯০-এর দশকে ব্রাজিল থেকে কচুরিপানা কলকাতার বোটানিক গার্ডেনে আনা হয়। ঢাকার কিছু নারী এ ফুলে আকৃষ্ট হয়ে তাদের বাগানে এ আগাছার আগমন ঘটান।

বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলায় এ আগাছাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণে একে ‘জার্ম্মান পানা’ বলা হতো। সৌরভ (শ্রাবণ ১৩২৬) পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে ‘জার্ম্মান পানা’র বিস্তারিত বিবরণ। এটি জার্মানদের একটি ষড়যন্ত্র হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে তারা ভারতীয় জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে ব্রিটিশদের দুর্বল করতে চেয়েছিল। ইতিহাসবিদ ইফতেখার ইকবালের একটি গবেষণার শিরোনাম হলো-‘ফাইটিং উইথ অ্যা উইড: দ্য ওয়াটার হায়াসিন্থ, দ্য স্টেট অ্যান্ড দ্য পাবলিক স্কোয়ার’। নানা দেশব্যাপী কচুরিপানা বিকাশের বিবিধ তথ্য তার গবেষণায় উঠে এসেছে।

কচুরিপানা মোকাবিলা ও নির্মূলের কৌশল

১৯১৪ সালে কচুরিপানার ব্যাপক সংক্রমণের ফলে কৃষকদের জন্য জমিতে পাট কাটা কঠিন হয়ে পড়ে। পাটবাহী নৌকাগুলো খালপথে চলাচলে বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল। তখন নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি লর্ড কারমাইকেলের সঙ্গে এ সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। সমস্যা মোকাবিলায় সরকার কৃষি বিভাগের অধীনে একটি পৃথক বিভাগ গঠন করে। ১৯১৭-১৮ সালে কচুরিপানার ছাই, সার হিসাবে ব্যবহারের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, বড় পরিসরে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ছাইয়ের পটাশ উপাদান এতটাই কম যে, এটি স্থানীয় এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও সার হিসাবে ব্যয়সাপেক্ষ হবে। এ ধরনের উৎপাদন শুধু সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমেই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাপক পরিমাণের আর্থিক ব্যয় কতটা ফলপ্রসু হবে, সেটা নিয়ে তখন বিবেচনা করা হয়। ১৯১৮ সালে, বাংলা সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সব কমিশনার এবং রেলওয়ে কোম্পানিসহ অন্যান্য জনসেবামূলক সংস্থাগুলোকে কচুরিপানা নির্মূল করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেয়। ১৯২০ সালে ঢাকার কালেক্টর, পঞ্চায়েত সভাপতিদের মাধ্যমে কচুরিপানার বিরুদ্ধে একটি অভিযান শুরু করেন এবং একটি ‘কচুরিপানা দিবস’ চালু করেন। ১৯২১ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি পঞ্চায়েত সম্মেলন আয়োজন করা হয় এবং এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যারা কচুরিপানা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হবে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। বঙ্গীয় আইন পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যেখানে বলা হয়, জেলা বোর্ড সম্মেলনের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো আইন প্রণয়নের আগে, সরকারকে সরকারি ও বেসরকারি সদস্য এবং স্যার জে.সি. বসু ও স্যার পি.সি. রায়ের মতো বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। এ কমিটি কচুরিপানা মোকাবিলা ও নির্মূল করার কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করবে। তৎকালীন সরকারের ফাইবার বিশেষজ্ঞ কেনেথ ম্যাকলিন একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ওয়াটার হায়াসিন্থ, অ্যা সিরিয়াস পেস্ট ইন বেঙ্গল’। আলোচ্য অনুচ্ছেদে উল্লিখিত তথ্যগুলো তার গবেষণার অংশ। ১৯২২ সালে ‘দ্য এগ্রিকালচারাল জার্নাল অব ইন্ডিয়া’তে এ গবেষণা প্রকাশিত হয়।

আইন প্রণয়ন

কচুরিপানা কমিটির প্রতিবেদনের শুরুতে উদ্ভিদটির জীবনচক্র এবং বংশবিস্তারের পদ্ধতি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরামর্শ দেওয়া হয়। অতঃপর এটি নিয়ন্ত্রণের বাস্তবসম্মত উপায় খুঁজতে বলা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন উপায়ে এর অর্থনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে গবেষণা করা উচিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এবং অবশেষে প্রতিবেদনে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এ প্রেক্ষিতে কচুরিপানা নির্মূল আইন-১৯৩৬ প্রণীত হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে সব বড় রাজনৈতিক দল কচুরিপানা নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৩৭ সালে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন দলটি ক্ষমতায় আসার পর নির্মূল প্রচেষ্টা আরও জোরদার হয়।

কচুরিপানা সপ্তাহ

১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ সরকার ‘কচুরিপানা সপ্তাহ’ উদযাপনের উদ্যোগ নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গ জুড়ে একযোগে এবং সমন্বিতভাবে কচুরিপানা নির্মূল অভিযান পরিচালনা। সে কালের দ্বি-সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আহমদী’তে এ সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ‘কচুরিপানা সপ্তাহ’ উদযাপন উপলক্ষে গ্রাম কমিটিকে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। কমিটির প্রতি নির্দেশনা ছিল যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে তাদেরকে দিয়ে কচুরিপানা ধ্বংস করা। পানা ধ্বংসের জন্য নির্ধারিত স্থানগুলোর তালিকা প্রস্তুত করে, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠান হয়। অনাবাদী জমিতে তাজা বা শুকনা যে কোনো ধরনের পানা ধ্বংসের দায়িত্ব বর্তায় গ্রাম কমিটির ওপর। পানা অপসারণের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। কচুরিপানা সপ্তাহের শেষে পানা পোড়ানোর একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয় এবং ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিটি গ্রামে গিয়ে নিশ্চিত করে যে, পানা পোড়ানো হয়েছে। যদিও এ উদ্যোগের ফলে বিশাল এলাকা থেকে আগাছা নির্মূল সম্ভব হয়েছিল, তথাপি কিছুকাল পর পরিকল্পিত উদ্যম হ্রাস পায়। চাষাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষক এবং গ্রামবাসীরা আবারও কচুরিপানা সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকে। ‘কচুরিপানা সপ্তাহ’ উদযাপন ছিল সে কালের শাসক দলের জন্য একটি কৌশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কিন্তু এটি ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়। কারণ, এ সমস্যাটি শুধু রাজনৈতিক ছিল না, এটি জৈবিক এবং পরিবেশগতও ছিল। এ উদ্ভিদটির বৃদ্ধিকে সমর্থনকারী পরিবেশগত ব্যবস্থার পরিবর্তন বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

পানার বিস্তার থামাতে ব্যর্থ হয় ‘আইন’

চাষিরা সাধারণত নিয়ম করে ফাল্গুন এবং চৈত্র মাসে অর্থাৎ বসন্তকালে কচুরিপানা ধ্বংস করত। তবে বর্ষাকালে উদ্ভিদটি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলে দরিদ্র কৃষকদের ফসল নষ্ট করত। ১৯৪৬ সালের একটি হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, কচুরিপানার কারণে বছরে মাছ এবং ফসলের নিদেনপক্ষে ১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কচুরিপানা ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং অন্যান্য জলজ-সম্পর্কিত রোগের উৎস ছিল। মাছের প্রাপ্যতা কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এটি জনসাধারণের পুষ্টিতেও প্রভাব ফেলে। পানীয় জলের দূষণ ঘটানোর পাশাপাশি এটি বর্ষাকালে পুকুরে বেড়ে উঠতে থাকায়, মাছের মজুদও হুমকির মুখে পড়ে। এর উপস্থিতি পূর্ববঙ্গে মাছ উৎপাদনের তীব্র হ্রাসের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। মানবস্বাস্থ্যের পাশাপাশি গবাদি পশুস্বাস্থ্যের ওপরও এর প্রভাব পড়ে। এসব পর্যবেক্ষণ করে তৎকালীন বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে. ডোনোভান মন্তব্য করেছিলেন, তিনি পৃথিবীর নানা দেশে যত গবাদি পশু দেখেছেন তন্মধ্যে পূর্ববঙ্গের গবাদি পশুর অবস্থা সবচেয়ে করুণ।

১৯৬০ সালেও কচুরিপানার নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি পূর্ববঙ্গ। ‘ন্যাচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ওয়াটার হায়াসিন্থ: অ্যা কার্স অর অ্যা ক্রপ?’ শীর্ষক নিবন্ধটি তার উদাহরণ। একবিংশ শতকের তৃতীয় শতকে এসেও, জলজ এ আগাছাটি বাংলাদেশে বিশেষ করে হাওর ও বিল এলাকায় বিদ্যমান। তবে এটি এখন আর চাষাবাদ বা নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির অন্যতম কারণ নয়। বর্তমানে উদ্ভিদটি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়, প্রধানত সার হিসাবে; বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে যখন খড়ের অভাব হয়, তখন এর পাতা পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। শুকনা কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হয় নানাবিধ হস্তশিল্প, যা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। একটি আগাছা প্রজাতি যে একই সঙ্গে সম্পদ এবং সমস্যা হতে পারে তার সেরা উদাহরণ হলো কচুরিপানা। এটি উদ্ভিদ জগতের ‘সিন্ডেরেলা’ হিসাবে প্রশংসা পেতে পারে। আশা করা যায়, খুব বেশি দিন আর তাকে অভিশপ্তের অপবাদ সইতে হবে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম