Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অনুগত, কিন্তু অবনত নয়

Icon

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অনুগত, কিন্তু অবনত নয়

পোর্শিয়া খুবই অনুগত। অনুগত সে মৃত পিতার, যার ইচ্ছা অনুযায়ী সে বিয়ে করে। অনুগত সে স্বামীর, যাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু পোর্শিয়া আবার অসম্মতও। সে নত হয় না, মেনে নেয় না। দ্যা মার্চেন্ট অব ভেনিসের যে সংস্কৃতি টাকা বোঝে, অন্যকিছু বোঝার আগে, সেখানে নিষ্ঠুর শায়লক ছুরি শানাচ্ছে এন্টনিওর বুক থেকে মাংস কেটে নেবে বলে। পোর্শিয়া উঠে দাঁড়ায়। সে বলে করুণার কথা। বিচারের চেয়ে যা বড় এবং শেষ পর্যন্ত পোর্শিয়াই জয়ী হয়। হেরে যায় শায়লক।

কেবল যে নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তা নয়, পোর্শিয়ার উত্থান পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। এ সত্যটা ভুললে তার ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না। পুরুষের জগৎ হিংসার, বিদ্বেষের, সংঘর্ষের এবং সেই সঙ্গে নির্বুদ্ধিতার। পোর্শিয়া প্রতিনিধি ভালোবাসার, মৈত্রীর এবং উদ্ভাবনী বুদ্ধির। পোর্শিয়া তার আশপাশের সব পুরুষের চেয়ে বড়। কোনো একদিক দিয়ে নয়, নানাদিক দিয়ে।

পোর্শিয়ার স্বামীর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হচ্ছে এন্টনিও। নিতান্তই ভালো মানুষ। তাই সে বিপদে পড়েছে। বিপদ নয়, ভয়ংকর বিপদ, রীতিমতো প্রাণ-সংশয় দেখা দিয়েছে। আসলেই। না, কারও সাধ্য নেই তাকে বাঁচাবে। এ খবর শোনামাত্রই শহরে ছুটে আসে পোর্শিয়া। আসে সে পুরুষের ছদ্মবেশে এবং আদালতে দাঁড়িয়ে যে-যুক্তি অন্য কেউ ভাবতেও পারেনি তা-ই উপস্থিত করে বিষণ্ন ও হতাশ এন্টনিওকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। এই যে একটা বড় কাজ এর মধ্য দিয়ে পোর্শিয়া যে শুধু একজন সজ্জন ব্যক্তির প্রাণ বাঁচাল তা নয়, একটি দ্বিতীয় মানবিক বক্তব্যও তুলে ধরল। বক্তব্যটা এই যে, বিপদে সাড়া দেওয়াটাই মানুষের মতো কাজ, অন্যকে বিপদে ফেলে নয়। মনুষ্যসমাজ এভাবেই বসবাসের যোগ্য হয়, নইলে তা অরণ্যেরও অধম হতো। তার প্রথম বক্তব্যটি ছিল এই যে, করুণার স্থান অনেক উঁচুতে, বিচারের তুলনায়ও। যা সে বোঝাতে চেয়েছিল জাতিবিদ্বেষী অন্ধ শায়লককে।

পোর্শিয়া দ্যা মার্চেন্ট অব ভেনিসের প্রধান চরিত্র নয়। নাটকের নামই বলে দিচ্ছে নায়ক হচ্ছে ভেনিসের এক সওদাগর। এ সওদাগরটি হচ্ছে ওই এন্টনিও, পোর্শিয়া এগিয়ে না এলে যার জীবন যেত। এন্টনিও অত্যন্ত ধনী, বোঝা যায় উত্তরাধিকার সূত্রে সে যা পেয়েছে তার সঙ্গে নিজেও যোগ করতে কার্পণ্য করেনি, পণ্যবাহী তার জাহাজ নোঙর করে পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে। ত্রিপলীতে, ইংল্যান্ড, ভারতবর্ষে, মেক্সিকোতে। বলতে গেলে সে একজন বিশ্ববণিক। বন্দর-নগর ভেনিসের লোকেরা টাকা বোঝে এবং টাকা খোঁজে। টাকার অভাব এন্টনিওর হওয়ার কথা নয়, কিন্তু এমনই ঘটনা ঘটল যে, অভিন্ন হৃদয় সখা বেসানিও যখন টাকা ধার চাইল এন্টনিওর হাতে তখন নগদ টাকা নেই, সব পুঁজি জাহাজে ভাসছে। ব্যবসায়ী মানুষদের বেলায় এরকম হয়েই থাকে। তারা টাকা পাঠায় টাকা ধরতে। এন্টনিও ঠিক করল ধার করবে। ব্যবসায়ীরা এটাও করে থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ের জন্য নয়, এন্টনিও ধার করবে বন্ধুর জন্য।

শহরের নামকরা সুদ ব্যবসায়ী হচ্ছে শায়লক। এন্টনিও গেল তার কাছে। তিন মাসের জন্য তিন হাজার টাকা ধার নেবে সে, যথোপযুক্ত সুদে। শায়লক জাত ইহুদি, তায় সুদখোর। এ নাটকের দ্বিতীয় বণিক সে, কিন্তু একেবারে ভিন্ন ধরনের।

শায়লকের অনেক অভিযোগ এন্টনিওর বিরুদ্ধে। অভিযোগ হিংস্র ঘৃণার আকার নিয়েছে। ভেতরে গড়ে উঠেছে প্রতিশোধের প্রচণ্ড স্পৃহা। অভিযোগের মূল উৎস দুটি। একটি সমষ্টিগত, অপরটি ব্যক্তিগত। ভেনিসের সমাজ বর্ণবাদী; সেখানে আধিপত্য খ্রিষ্টানদের, সংখ্যালঘু ইহুদিরা একাধারে অবহেলা ও ঘৃণার পাত্র। এন্টনিও প্রভাবশালী খ্রিষ্টান, ইহুদিদের সঙ্গে সে যে আচরণ করে সেটা মানবিক নয়। যেন কুকুর তারা, এভাবে দেখে সে ইহুদিদের। পারলে থুথু ছিটিয়ে দেয় গায়ে। কেন, ইহুদিরা কি মানুষ নয়? তাদের সুখ-দুঃখ নেই? অনুভব করার শক্তি নেই আর পাঁচটা মানুষের মতো? শায়লক তার মনের ভেতরে পুষে রেখেছে উত্তেজিত এ প্রশ্ন।

দ্বিতীয়ত এন্টনিও বিনা সুদে মানুষকে টাকা ধার দেয়। তাতে শায়লকের বেশ অসুবিধা। লোকে তার কাছে আসতে চায় না। ক্ষতি হয় ব্যবসায়ের। এও এক উৎস বিদ্বেষের। জাতিবৈরিতা ও ব্যক্তিবৈরিতা একত্র হয়ে ভীষণ রূপ নিয়েছে। অবদমিত ঠিকই, তবে অশান্ত।

এন্টনিওকে প্রার্থী হিসাবে পেয়ে শায়লক মহাখুশি। টাকা ধার? অবশ্যই দেবে। একশবার। না, সুদ লাগবে না। বিনা সুদে। শুধু একটা চুক্তিতে সই করতে হবে। তিন মাস পর যদি ওই টাকা শোধ করতে না পারে এন্টনিও তবে দেনার দায়ে তার শরীরের পছন্দ মতো যে কোনো জায়গা থেকে আধসের পরিমাণ মাংস কেটে নেবে শায়লক। তা সত্যি আর নেবে নাকি, মাংস দিয়ে কী করবে সে, বিক্রি করবে কোন বাজারে? এ চুক্তি শুধু বন্ধুত্ব স্থাপনের একটা নিমিত্ত মাত্র, অন্যকিছু নয়।

বেসানিও বাধা দিয়েছিল, কিন্তু অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এন্টনিও মোটেই ভয় পেল না, সই করল চুক্তিতে। তার জন্য এটা কোনো ঝুঁকির ব্যাপার নয়। এ নাটকে ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পোর্শিয়ার জন্য পাত্র ঠিক হয় লটারির মাধ্যমে। বেসানিও তাতে জয়ী হয়; পোর্শিয়াকে সে বিয়ে করে; আর ওই বিয়ের লটারিতে যোগ দেওয়ার জন্য টাকা খরচের প্রয়োজনেই সে হাত পেতেছিল বন্ধু এন্টনিওর কাছে। লটারি মাত্রেই ঝুঁকি এক প্রকারের। তাতে বেসানিও জয়ী হলো। তিনটি সিন্দুকের একটিতে রাখা হয়েছিল পোর্শিয়ার ছবি। পাত্রকে বলতে হবে কোন সিন্দুকটায় রক্ষিত আছে ওই ছবি। সিন্দুক তিনটির মধ্যে একটি সোনার, একটি রুপার, তৃতীয়টি সিসার। সিসার সিন্দুকের গায়ে লেখা ছিল, ‘আমাকে যে পছন্দ করবে তাকে তার সর্বস্ব দেওযার ঝুঁকি নিতে হবে।’ সেই সিন্দুকটিই পছন্দ করেছে বেসানিও। সর্বস্ব দেওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে এবং সেটার ভেতরেই পাওয়া গেছে পোর্শিয়ার ছবি।

পোর্শিয়া নিজেও ঝুঁকি নেয়। বেলমন্টে বাড়ি তার, ভেনিস থেকে কিছুটা দূরে, জাহাজে যেতে হয়। এন্টনিওর বিপদের খবর শুনে সে ঝুঁকি নেয়, পুরুষের ছদ্মবেশে ছদ্মপরিচয়ে গিয়ে হাজির হয় ভেনিসের আদালতে। ধরা পড়লে বিপদ ছিল।

ঝুঁকি নিয়ে বেসানিও বিপদে পড়েনি। পোর্শিয়াও নয়। কিন্তু মস্ত বিপদে পড়েছিল এন্টনিও। তিন মাস পার হয়ে গেছে, অথচ জাহাজ ফেরেনি। শায়লকের পাওনা টাকা যে শোধ করবে সে উপায় একেবারেই নেই। ওদিকে শায়লক শুনবে না, তার কথা একটাই, সে ন্যায়বিচার চায়। চুক্তির শর্ত মাফিক। সে এখন মাংস কেটে নেবে এন্টনিওর বুক থেকে। ছুরি শানাচ্ছে।

শুনে পোর্শিয়া কালবিলম্ব করেনি। ছুটে গেছে ভেনিসে। আইনজীবীর ছদ্মবেশে গিয়ে হাজির হয়েছে আদালতে। গিয়ে দেখে ভীষণ ব্যাপার। শায়লক একেবারেই নাছোড়বান্দা; তিন হাজার মুদ্রার পরিবর্তে দশ হাজার, বিশ হাজার, ত্রিশ হাজার, যত হাজার চায় তত হাজার দিতে রাজি আছে বেসানিও। কিন্তু শায়লক শুনবে না। সে বিচার চায়, অন্য কিছু চায় না। পোর্শিয়া করুণার কথা বলে। বলে করুণা হচ্ছে ঈশ্বরের গুণ। এ যখন ঝরে পড়ে বৃষ্টির মতো তখন ওই করুণা ধারা যে পায় তার তো লাভ হয়ই, হবেই, মহিমা বাড়ে তারও করুণা যে দেয়। পোর্শিয়ার এ বক্তব্য ভেনিসের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সে-সংস্কৃতিতে হিংসা ও বিদ্বেষ বড় প্রবল। সবাই নয় নিশ্চয়ই, তবু অনেকেই ঘৃণা করে একে অপরকে, কুকুর-বেড়ালভাবে পরস্পরকে।

এন্টনিও ঘৃণা করে শায়লককে। শায়লক যেমন ঘৃণা করে এন্টনিওকে। শায়লক সুযোগ পেয়েছে। এমন সুযোগ বারবার আসে না। সে চরম প্রতিশোধ নেবে। পোর্শিয়া ভেনিসের মেয়ে নয়, তার বসবাস বেলমন্টে, সুন্দর জায়গা সেটা, সেখানকার সংস্কৃতি মৈত্রীর ও সংগীতের। সে সংস্কৃতির বাণী বয়ে নিয়ে এসেছে যেন সে, ভেনিসে।

কিন্তু আনলে কী হবে, কাজ হয় না। শায়লক শোনে না। তার হৃদয় পাথরে তৈরি। আসলে পাথরও তত নির্মম নয় যত সে নির্মম। তার হাতে ধারালো ছুরি। আবেদনে অনুরোধে কাজ হলো না। তবে কাজ হলো বুদ্ধিতে। পোর্শিয়া বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি কেটে নিতে পারে আধ সের মাংস এন্টনিওর শরীর থেকে।’ তারপর মহোৎসাহে শায়লক যখন ছুরি হাতে এগিয়ে গেছে এন্টনিওর দিকে, তখন পোর্শিয়া বলল, ‘থাম, মাংস কাটবে ঠিকই কিন্তু খবরদার, এক ফোঁটাও রক্ত ঝরাতে পারবে না। রক্ত তোমার পাওনা নয়। যদি একবিন্দু রক্ত পড়ে তাহলে তুমি প্রাণ হারাবে, আর তোমার সমস্ত সম্পত্তি যাবে বাজেয়াপ্ত হয়ে।’ শায়লক থামল। বেঁচে গেল এন্টনিও। জয় হলো মানবিক সংস্কৃতির, পরাজয় হলো হিংসার।

পোর্শিয়া কেবল যে উষ্ণহৃদয় তা নয়, সে বুদ্ধিমতীও। তার সংস্কৃতিতে বুদ্ধিও আছে বড় একটা জায়গা নিয়ে। এন্টনিও অত্যন্ত হৃদয়বান, বেসানিও তা-ই, কিন্তু কেবল আবেগে তো কাজ হয় না, কাজ হচ্ছিল না, পোর্শিয়া বুদ্ধি যদি না খাটাত তাহলে এন্টনিও বাঁচত না। শায়লকের ছুরির নিচে প্রাণ যেত তার।

এন্টনিও নয়, শায়লকের প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম পোর্শিয়া। পোর্শিয়াই হারিয়ে দিল। হৃদয়বান পরাভূত করল হৃদয়হীনকে। বেসানিও মহাখুশি। এন্টনিও সদা বিষণ্ন; পোর্শিয়াও বিষণ্ন হয়, কিন্তু আবার উজ্জ্বলও হয়ে ওঠে, তার স্বভাবগত পরিহাসপ্রিয়তায়। নাটকে সেই সবচেয়ে প্রাণবন্ত। নিঃসন্দেহে। পাণিপ্রার্থীদের হাবভাব নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করেছে সে; স্বামীকে দেয় বোকা বানিয়ে। ওকালতির পুরস্কার হিসাবে অন্যকিছু নেবে না, স্বামীর আঙুলের আংটিটি ছাড়া। যে-আংটি সে-ই উপহার দিয়েছিল বেসানিওকে এবং যেটি হাতে নিয়ে উত্তেজিত হৃদয় বেসানিও বলেছিল, প্রাণ যাবে, তবু আংটি হাতছাড়া হবে না। পোর্শিয়ার দেখাদেখি সঙ্গিনী নেরিসাও আংটি চেয়ে নেয় তার নিজের স্বামীর কাছ থেকে। দুই স্বামীর কেউই আংটি দিতে প্রস্তুত নয়। কিন্তু বাধ্য হয় দিতে। নিরুপায় দুই পুরুষ বোকা বনে যায় নিজ নিজ স্ত্রীর হাতে।

কর্তৃত্বও পোর্শিয়ারই। তার পেছনে দেশ-বিদেশের রাজপুত্ররা ঘুর ঘুর করে; বিয়ে করতে চায়, কেননা যেমন সে সুন্দরী তেমনি সে ধনী। ভেনিসের আদালতে বেসানিও যে টাকার থলি নিয়ে বারবার উঠে দাঁড়ায়, বলে, যত লাগে দেব, তবু এন্টনিওকে রেহাই দাও, সে-টাকা বেসানিওর নিজের নয়, টাকাটা পোর্শিয়ার। কেমনভাবে বোকা বানিয়ে দেয় পোর্শিয়া সমগ্র পুরুষ সমাজকে। এন্টনিওকে বাঁচার বুদ্ধি কোনো পুরুষের মাথায় তো আসেইনি, পুরুষের ছদ্মবেশের অন্তরালে পোর্শিয়া যে একজন রমণী এটাও কোনো পুরুষ ধরতে পারেনি, তার স্বামীও নয়। চেনা চেনা ঠেকে হয়তো, তবু চেনে না। বোঝা যায় অভিনয়েও সে অত্যন্ত পারদর্শী, গলার স্বরটিও ফেলেছে লুকিয়ে।

পোর্শিয়া বলে, থামো। তিনবার বলেছে সে ও-কথা। একবার বেসানিওকে, দুবার শায়লককে। বেসানিওকে যে থামতে বলেছে সেটা ভালোবেসে। থামো, এত তাড়া কিসের, কদিন পরই না হয় লটারির ঝুঁকিটা নেবে। বিয়ের আগে বেসানিওর উদ্দেশে এ ছিল বক্তব্য। আদালতে শায়লককে বলে, ‘থামো তুমি মাংস পাবে রক্ত পাবে না।’ তারপর শায়লক যখন পালিয়ে যেতে চায়, লেজ গুটিয়ে পরাজয় মেনে নিয়ে; তখন আবার বলে পোর্শিয়া, ‘থামো পালাবে কোথায়, তুমি ভেনিসের একজন নাগরিককে হত্যা করতে চেয়েছিলে, তোমার বিচার হবে।’ হ্যাঁ, পোর্শিয়াই বলে, অন্যরা শোনে। যেমন তারা শুনেছিল আগের ওই কথাটা।

নাটকের সরকারি নায়ক এন্টনিওই। এন্টনিওর শত্রু হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে শায়লক, কিন্তু আসলে পোর্শিয়া অনেকটা উঁচুতে, এন্টনিও এবং শায়লক উভয়ের তুলনায়।

আবার সে বিদ্রোহীও নয়, প্রথাগত অর্থে। পতাকা নেই হাতে, ঔদ্ধত্য নেই আচরণে। বরং অত্যন্ত অনুগত সে, পিতার ও স্বামীর। পিতার বিধান মেনে নিয়েছে নীরবে; পিতার নির্দেশ অনুযায়ী তাকেই বিয়ে করবে যে জিতবে লটারিতে। সোজা কথা। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বলে কিছু নেই। শায়লকের মেয়ে জেসিকা ঘর ছেড়ে সোনাদানা সব নিয়ে বিধর্মী প্রেমিকের হাত ধরে পালায়, পোর্শিয়ার ক্ষেত্রে এমন কাজ অকল্পনীয়। বেসানিওকে স্বামী হিসাবে পেয়ে আনন্দে অত্যন্ত উৎফুল্ল পোর্শিয়া। স্বামীকে সে বলে, ‘হায়, আমি যদি আমার চেয়ে দশগুণ বেশি সুন্দরী হতাম, দশ হাজার গুণ ধনী, তাহলেও তার সবটাই নিবেদন করতাম তোমাকে খুশি করার জন্য। তোমার কাছে মূল্যবান হওয়ার জন্য আমার গুণ যদি বাড়ত, বাড়ত যদি আমার বন্ধুর সংখ্যা তাহলে আরও আনন্দ হতো আমার। আমি তো সামান্য নারী, আমি অশিক্ষিত, না আছে আমার অনুশীলন, না আছে অভ্যাস; ভরসা আমার একটাই, সেটা এই যে শিখার বয়সটা আমার পার হয়ে যায়নি।’

প্রেমিকের কথা, অনুগতের কথা। এ অনুগতের মধ্যে থেকেই সে উঠে যায় ওপরে। হারিয়ে দেয় অর্থের আধিপত্যকে, হারিয়ে দেয় পুরুষের আধিপত্যকেও। যুগপৎ। শায়লক পরাভূত, পরাভূত অন্য পুরুষেরাও।

কিন্তু পোর্শিয়া মানুষই একজন, দেবী নয়। তার একাকিত্ব ও বিষণ্নতাটা আমরা দেখি। দেখি তার নিষ্ঠুরতাও। আদালতে শায়লক যখন হেরে গেছে, সবাই তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, শায়লকের প্রাপ্য টাকা শোধ করে দিতেও গররাজি নয় বেসানিওরা, তখন থামাল কিন্তু পোর্শিয়াই। আইনের একটি ধারা দেখিয়ে দিল। শায়লক যেহেতু উদ্যত হয়েছিল নরহত্যায় সে জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। আইনের বিধান সেটাই। তার অর্ধেক সম্পত্তি চলে যাবে রাষ্ট্রের কাছে, অর্ধেক পাবে এন্টনিও। তারপরও সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হবে কিনা তা ঠিক করবেন ডিউক নিজে। শেষ পর্যন্ত রফা হলো এই যে, শায়লক ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হবে এবং তার মৃত্যুর পর তার সব সম্পত্তি চলে যাবে তার পলাতক মেয়ে ও মেয়ের খ্রিষ্টান স্বামীর কাছে। বিনিময়ে সে প্রাণ ভিক্ষা পাবে।

শেকস্পিয়রের সময়ে ইহুদিকে খ্রিষ্টান হতে বাধ্য করাটা খুব বড় নিষ্ঠুরতা বলে গণ্য হতো না, এ কথা বলা হয়। কিন্তু শেকস্পিয়র তো সবকিছু তার কালের মানদণ্ডে বিচার করছিলেন না, একটি সর্বজনীন মানদণ্ডও ছিল তার কাছে। যার বিচারে কাউকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করাটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর কাজ বটে। পোর্শিয়া ক্ষমার কথা, করুণার কথা খুব করে বলেছে, আদালতে তার কণ্ঠস্বর ছিল বড়ই আবেগপূর্ণ; কিন্তু পরাভূত শায়লককে শাস্তি দেওয়ার কথাটা সে যে তুলল, ক্ষমার কথা ভুলে গিয়ে, করুণার কথা বিস্মৃত হয়ে তাতে বোঝা গেল যতই যা হোক পোর্শিয়াও মানুষই একজন, তার মধ্যেও নিষ্ঠুরতা রয়েছে এবং সুযোগের সদ্ব্যবহারে সে কুণ্ঠিত নয়। বহু গুণে গুণান্বিত পোর্শিয়া মানবিক বর্বরতার ঊর্ধ্বে নয়। আর তাতেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, পোর্শিয়া মানুষ বটে, রূপকথার নায়িকা নয়। চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে এবং কলঙ্ক না থাকলে চাঁদ চাঁদ হয় না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম