প্রাপ্তি ও হাহাকারে হুমায়ূন আহমেদ
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
কামরুল হাসান বাদল
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![প্রাপ্তি ও হাহাকারে হুমায়ূন আহমেদ](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/11/15/Humaun-6737034a771c3.jpg)
হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
‘রাত নয়টার দিকে অমানুষিক যন্ত্রণার মাঝে আমার সন্তানের জন্ম হলো, আমার আর তারপর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান হলো ঘরভরা মানুষ। হইচই-চেঁচামেচিতে কান পাতা যায় না। আমার ভাইবোনেরা ধাক্কাধাক্কি করে বাচ্চা দেখছে। আনন্দ-উল্লাসে ঘর ভরপুর। ছেলে হয়েছে শুনতে পেলাম কিন্তু একনজর বাচ্চাকে দেখতে পারলাম না।
নিজ থেকে দেখতে চাব এত বড় নির্লজ্জ কাজ করি কেমন করে? আমাকে নিজের বিছানায় শুইয়ে বাচ্চাকে এনে দেওয়া হলো, মাথাভরা কালো চুল, টকটকে ফর্সা গায়ের রং, চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ভাবখানা কী? বলছিলে না আমার মুখ দেখবে না? এখন? আমার বুকের ভেতর নড়েচড়ে গেল আমার প্রথম ছেলের মুখ দেখে। তখনো আমি জানতাম না আমার এ ছেলে এককালে হুমায়ূন আহমেদ নামে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসাবে সুপরিচিত হবে।’
মা আয়েশা ফয়েজ তার ‘জীবন যে রকম’ গ্রন্থে প্রথম সন্তান হুমায়ূন আহমেদের জন্মক্ষণটি তুলে ধরেছেন এভাবে।
‘বাচ্চার নাম রাখা হলো কাজল। কাজলের জন্মের খবর জানিয়ে তার বাবাকে টেলিগ্রাম করা হলো পরদিন ভোরে। তার তখন খুব কাজের চাপ। আসতে পারল না। অন্যরা এলো।
কাজলের বাবা বাচ্চা দেখতে আসার সুযোগ পেলো এক মাস পর। তার খুব মেয়ের শখ ছিল।- আমার সঙ্গে যখন প্রথম নিরিবিলি দেখা হলো প্রথমেই বলল,
কাজলের ভাগ্য গণনা করে ফেলেছি।
কীভাবে করলে?
বই পত্র কিনে পড়াশোনা করেছিলাম।
কী আছে ভাগ্যে?
অনেক বিখ্যাত হবে তোমার ছেলে। জানো রানি এলিজাবেথের ছেলে আর তোমার ছেলের জন্ম একই দিনে, একই লগ্নে?
আমি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসলাম, কোথায় রানি এলিজাবেথ আর কোথায় আমি। কাজলের বাবা গম্ভীর হয়ে বলল, রানির ছেলে বিখ্যাত হবে বাবা মায়ের নামে, আর আমার ছেলে বিখ্যাত হবে তার নিজের যোগ্যতায়, তুমি দেখে নিও।’
এমন অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করা, পেশায় পুলিশ অফিসার, লোকটি কেমন ছিলেন? হুমায়ূনের লেখার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। “আমার ছোট ভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার লেখা প্রথম গ্রন্থ কপোট্রনিক সুখ দুঃখের উৎসর্গপত্রে লিখেছে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভালোমানুষটি বেছে নিতে বললে আমি আমার বাবাকে বেছে নেব।’ বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখকরা সব সময় আবেগের বাড়াবাড়ি করেন। আমার ভাইয়ের এ উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত ধরে নিতে খানিকটা অসুবিধা আছে। সে যদি লিখত পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ আমার বাবা এবং মা তাহলে আবেগের ব্যাপারটি চলে আসত। সে তা না করে বাবার কথাই লিখেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটির মধ্যে মাকে ধরেনি। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে তার উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত নয়। চিন্তাভাবনা করে লেখা। ইকবালকে আমি যতটুকু চিনি সে চিন্তাভাবনা না করে কখনো কিছু বলে না এবং লেখেও না।”
তার মৃত্যুর পর বিভিন্নজনের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এ লেখকের বিচিত্র জীবনযাপন, ভাবনা, আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পেরেছে দেশের অগণিত মানুষ। হুমায়ূন আহমেদ, তার পরিবার ও তার ছেলেবেলার কাহিনিগুলো বেশ চমকপ্রদ। মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন তার বাবা। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষদের মধ্যে একজন কিনা জানি না, তবে বিচিত্র একজন মানুষ, তা বলতে পারি। তার মতো খেয়ালি, তার মতো আবেগবান মানুষ এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আবেগ ছাড়াও তার চরিত্রে আরও সব বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। তিনি ছিলেন জন স্টেইনবেকের উপন্যাস থেকে উঠে আসা এক রহস্যময় চরিত্র। সবার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। রাত প্রায় বারোটা। রংমহল সিনেমা হল থেকে সেকেন্ড শো ছবি দেখে বাবা এবং মা রিকশা করে ফিরছেন। বড় একটা দিঘির পাশ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে। মা হঠাৎ বললেন, আচ্ছা দেখো কী সুন্দর দিঘি। টলটল করছে পানি। ইচ্ছা করছে পানিতে গোসল করি। বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রিকশা থামাও। রিকশাওয়ালা থামল। বাবা বললেন চলো দিঘিতে গোসল করি। মা হতভম্ব। এই গভীর রাতে দিঘিতে নেমে গোসল করবেন কি? নিতান্ত পাগল না হলে কেউ এ রকম বলে? মা বললেন কী বলছ তুমি। বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, দ্যাখো আয়েশা একটাই আমাদের জীবন। এই এক জীবনে আমাদের বেশির ভাগ সাধই অপূর্ণ থাকবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব সাধ আছে যা মেটানো যায় তা মেটানোই ভালো। তুমি আসো আমার সঙ্গে। বাবা হাত ধরে মাকে নামালেন। স্তম্ভিত রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে দেখল হাত ধরাধরি করে দুজন নেমে গেল দিঘিতে।’
এ গল্প যতবার আমার মা করেন ততবার তার চোখে পানি এসে যায়। তার নিজের ধারণা। তার জীবনে যে অল্প কিছু শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এসেছিল ওই দিঘিতে অবগাহন তার মধ্যে একটি।
হুমায়ূন আহমেদ সারা জীবন তার লেখালেখির মাধ্যমে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধ, ঘটনা, দুঃখ বেদনা, হাসি ও আনন্দের চিত্রই শুধু তুলে ধরেছেন তার গল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রে। আর এখানেই তার অসাধারণত্ব, যেভাবে কেউ লেখেননি আগে, যে ভাষায় কেউ বলেননি আগে, যে ঘটনা কেউ তুলে ধরেননি আগে, যে রসবোধের পরিচয় দেননি আগে, এত সহজ করে বর্ণনা করেননি আগে হুমায়ূন তাই করেছিলেন। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এ হুমায়ূন, বাদশাহ হুমায়ূনের তুলনায় কম শক্তিমান ছিলেন না। চলেছেন সম্রাটের মতো, যখন যা ইচ্ছা তাই করেছেন।
মৃত্যুর আগে কেউ কেউ কি তা জেনে যায় খুব অবচেতন মনে? আমরা এমন অনেককে দেখেছি মৃত্যুর আগে আগে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটাতে। হুমায়ূন আহমেদের ইনট্যুইশন কি এমন কিছু ধারণা দিয়েছিল? না হলে ‘মেঘের ওপর বাড়ি’ লিখলেন কেন ওভাবে? উপন্যাসটি একটি মৃত মানুষের দেখা বর্ণনা। শুরুটা এ রকম, ‘আমি মারা গেছি, নাকি মারা যাচ্ছি এখনো বুঝতে পারছি না। মনে হয় মারা গেছি। মৃত অবস্থা থেকে অলৌকিকভাবে যারা বেঁচে ওঠে, তাদের মৃত্যু অভিজ্ঞতা হয়। এর নাম NDE (Near death Experience)। বাংলায় ‘মৃত্যু অভিজ্ঞতা’ এ বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যার জন্য যখন আমি এ উপন্যাস লিখি, তখন ক্যানসার নামক জটিল ব্যাধি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। এ খবরটা আমি জানি না। ক্যানসার সংসার পেতেছে কোলনে, সেখান থেকে রক্তের ভেতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার অবচেতন মন কি এ খবরটি পেয়েছে? আমার ধারণা পেয়েছে। যে কারণে আমি উপন্যাস ফেঁদেছি একজন মৃত মানুষের জবানীতে। উপন্যাসে এক মহিলার কথা আছে, যার হয়েছে কোলন ক্যানসার। সেই ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। বাসা বেঁধেছে লিভারে, ফুসফুসে। হঠাৎ এসব কেন লিখলাম? জগৎ অতি রহস্যময়।’
রবীন্দ্র পাগল, বৃষ্টি পাগল, প্রকৃতি ও মানুষ পাগল এ লোকটি-সারা জীবন পৃথিবীর রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও অনেকবার অনেক জায়গায় বলেছেন, ‘কোথাও একটি রহস্য আছে। তার এ উপন্যাসের শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, (মৃত্যু অভিজ্ঞতা যাদের হয়) তারা সবাই দেখে, লম্বা এক সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। অন্তহীন যাত্রার শেষের দিকে
খানিকটা আলো দেখা যায়। আলো আসে সুড়ঙ্গের শেষ মাথা থেকে। এ আলোর চুম্বকের মতো আকর্ষণী ক্ষমতা। কঠিন আকর্ষণে অন্ধের মতো আলোর দিকে এগিয়ে যেতে হয়।’
এ উপন্যাসের শেষটি হয়েছে এভাবে। ‘চারদিক কেমন জানি গুটিয়ে সিলিন্ডারের মতো হয়ে যাচ্ছে। সিলিন্ডারের শেষ প্রান্তে আলোর বন্যা। সেই আলোয় ভয়াবহ চৌম্বক শক্তি। আমি আলোর দিকে ছুটে যাচ্ছি। আমি পেছনে ফিরে বললাম পৃথিবীর মানুষেরা তোমরা ভালো থেক, সুখে থেকো। আমি ছুটে যাচ্ছি আলোর দিকে। আমি জানি আমাকে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। অসীম কখনো শেষ হয় না। তাহলে যাত্রা শেষ হবে কীভাবে? কে বলে দেবে আমাকে।’
আলোর দিকে ছুটে গিয়েছেন হুমায়ূন। জীবনকালেও যিনি ছিলেন আলোকময় তারকা। আজ আকাশে কোনো নক্ষত্র নেই, একটি নক্ষত্র খসে গেলে তাদের শোকে ও মৌনতায় ব্রহ্মাণ্ডে অন্ধকারের স্তূপ- অন্ধকারে বসে ভাবছি, অনেক দুঃখ ও কষ্টে, হতাশা ও বেদনায় প্রাপ্তি ও হাহাকারে আমাদের দীর্ঘকাল নির্মল আনন্দ দান করেছিলেন তিনি। যা সত্যিই খুব কঠিন কাজ। বাংলাভাষার কজন লেখকই তা পেরেছিলেন।