অনুবাদ সাক্ষাৎকার
কবিতা বোঝায় প্রতিটি শব্দের মূল্য থাকতে হবে: শিফা সলতাগী সাফাদি
মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে দেওয়া হয় মার্কিন সাহিত্যের সম্মানজনক পুরস্কার ‘ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডস’। এবছর ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড’র ‘ইয়াং পিপলস লিটারেচার’ বিভাগে শিফা সলতাগী সাফাদি তার বই ‘কারিম বিটুইন’র জন্য পুরস্কার জিতেছেন। বইটি একজন সিরিয়ান-আমেরিকান মুসলিম বালকের গল্প, যে আমেরিকান সমাজে তার পরিচয়, বর্ণবাদ এবং বিচারবোধ নিয়ে সংগ্রাম করে, বিশেষত ২০১৭ সালের মুসলিম নিষেধাজ্ঞার সময়। বইটি শুধু ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং এটি সমসাময়িক ইসলামোফোবিয়া, আঞ্চলিক বৈষম্য এবং বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগ্রামের ওপরও আলোকপাত করে।
কারিম বিটুইন বইটি শুধু একটি হৃদয়স্পর্শী গল্পই নয়, বরং সিরিয়ান শরণার্থী এবং তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষিকা শিফা সলতাগী সাফাদির জীবনের একটি বিশাল অংশ বই! শিফা সিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিবাসী হয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। স্বামী এবং চার সন্তান নিয়ে বর্তমানে তিনি শিকাগোতে থাকেন। সাফাদি তার বিজয়ী বক্তৃতায় ধর্মীয় বৈচিত্র্য এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলেছেন।
বিশেষ করে চলমান গাজা সংকট এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর বৈষম্যের বিষয়টি উল্লেখ করে সবাইকে ন্যায়ের জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি সেসব মুসলিম লেখকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, যারা তার সাহস বাড়িয়েছিলেন এবং তার লেখার জন্য পথ তৈরি করেছিলেন। তিনি ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন!’ বলে তার বক্তব্য শেষ করেন। নিজের বই ‘কারিম বিটুইন’ নিয়ে রিডিং মিডল গ্রেড-এ প্রকাশিত তার সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন
আপনার বই কারিম বিটুইন ২০১৬ সালের প্রেক্ষাপটে রচিত, যেটা যুক্তরাষ্ট্রে সিরিয়ান-আমেরিকানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। আপনি কেন কারিমের কাহিনিকে এ সময়কালে স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
: সত্যি বলতে, একজন মুসলিম-আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, আমার জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল এবং আমি চাই সেই সময়ের অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে এবং তা স্মরণীয় করে রাখতে। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হন। তার প্রথম নির্বাহী আদেশগুলোর একটি ছিল সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে (যার মধ্যে আমার জন্মস্থান সিরিয়া রয়েছে) মানুষদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। তিনি এ মানুষদের বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকারক বলে অভিহিত করেন।
আমি এ বর্ণবাদী বক্তব্যে ভীষণভাবে মর্মাহত হই। এটি আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। তবে আমি এটাও মনে করি যে, অনেক মানুষ যারা এ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, তারা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমি তরুণ পাঠকদের দেখাতে চাই যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপনি কীভাবে দাঁড়াতে পারেন এবং আপনার কণ্ঠস্বর দিয়ে প্রতিবাদ করতে পারেন। মুসলিম নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে বারবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল এবং এটি অবশেষে বাতিল হয়।
বইয়ের প্রথমার্ধের কারিম আমার কাছে খুব একটা পছন্দনীয় নয়। তাকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য নাড়া দিতে ইচ্ছা করছিল। আপনি কেন এমন একটি চরিত্র নিয়ে লিখেছেন যে, এত ভুল করছে?
: কারিম অবশ্যই অনেক ভুল করে। প্রথম দিকে সে ভীষণভাবে হোঁচট খায়। তবে এটি তার চরিত্র বিকাশের অংশ। মাধ্যমিক স্কুলের বাচ্চারা অনেক সময়ই যুক্তিসংগত কাজ করে না। এ বয়সে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয় সমবয়সিদের সঙ্গে মিশে যাওয়া। আর কারিমের ক্ষেত্রে, তার বন্ধুরা দূরে চলে গেছে, সে ফুটবল খেলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, এবং এমন একটি সময়ে বসবাস করছে যখন মুসলিমরা খলনায়ক হিসাবে চিত্রিত হচ্ছে-সে বোঝার চেষ্টা করছে কীভাবে নিজের জায়গা তৈরি করা যায়।
প্রথমে, সে ভাবে তার সিরিয়ান পরিচয়কে দূরে সরিয়ে রাখলেই সে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু গল্পের মাধ্যমে সে পরিবর্তন ও উন্নতি করে এবং শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে যে, নিজের পক্ষে দাঁড়ানোই প্রকৃত বন্ধুত্ব ও প্রহণযোগ্যতা পাওয়ার উপায়। তবে আমি আশা করি পাঠকরা কারিমের এ ভুলটা লক্ষ করবে-তার নিজের পরিচয়কে দূরে সরিয়ে রাখা। কারণ এটি সত্যিই ভুল। আমি চাই বাচ্চারা জানুক, তাদের নিজেদের মতো করে থাকতে হবে-সমাজ বা বন্ধুদের নির্দেশমতো নয়!
আপনার বইটি পদ্য-ছন্দে লেখা, যা এ গল্পের শক্তিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। আপনি কি সব সময়ই পদ্য ও কবিতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন?
: অবশ্যই! আমি পদ্য খুব ভালোবাসি। আমি প্রচুর পদ্যের বই পড়ার চেষ্টা করি, এবং দ্য ক্রসওভার বইটি (ক্বামে আলেকজান্ডারের লেখা) আমাকে কারিম বিটুইন লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। সেই সুন্দর বইয়ে পদ্যকে যেভাবে কথামালার মতো ব্যবহার করা হয়েছে, তা আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে। কবিতা একটি অনুভূতিকে প্রকাশ করার অসাধারণ শক্তিশালী মাধ্যম, এবং আমি চেয়েছিলাম পাঠক যেন এ গল্পের প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করতে পারে।
কবিতাকে আরও ভালোবাসি এটি সংক্ষিপ্ত হওয়ায়। কবিতা বোঝায় প্রতিটি শব্দের মূল্য থাকতে হবে। আমি প্রতিটি স্তাবক এবং প্লটকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যথাযথ চেষ্টা করেছি। এবং এটি শিশুদের পড়ার মতো সহজ এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে চেয়েছি, বিশেষ করে যারা বই পড়তে আগ্রহী নয়।
আমি একজন ইংরেজি/ব্যাকরণপ্রেমী হিসাবে, এ বইয়ের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত বাগধারার খেলা দেখে আনন্দিত। আমি জানতে আগ্রহী কেন আপনি এটি অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
: কারণ আমিও একজন ব্যাকরণপ্রেমী! সত্যি বলতে, এটি কেবল কারিমের চরিত্রায়ণের অংশ। এটি দেখায় যে তার বন্ধু বানানো কঠিন হতে পারে। কারণ, সে জনপ্রিয় ছেলে নয়-সে বরং একটি বইপ্রেমী ছেলে (আমার মতো)। তাছাড়া, এটি আমাকে, একজন ইংরেজি শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে এবং বইটিতে কিছু শিখন অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ দিয়েছে- যা আমাকে আনন্দ দিয়েছে!
এ বইয়ের কিছু অধ্যায় ডান থেকে বামে আরবি ফরম্যাটে লেখা হয়েছে, এবং আমি মনে করি এটি খুব সুন্দর একটি শৈল্পিক পছন্দ। আপনি এমনটা কেন করেছেন?
: এর কারণ আরবি ডান থেকে বামে পড়া হয় এবং ইংরেজি বাম থেকে ডানে। আমি চেয়েছিলাম এ দুই দিকই যেন দেখায় কীভাবে কারিম এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যায় এবং এর মাঝে নিজেকে খুঁজে পায়। শেষে, যখন এ দুটি ব্যাপার মাঝখানে মিলে যায়, আমি চেয়েছিলাম এটি দেখাতে যে, সে ইংরেজি ও আরবি, সিরিয়ান ও আমেরিকান উভয় অংশেই নিজের অন্তর্গত জায়গা খুঁজে পায়।
আপনি বাচ্চাদের বই নিয়ে ব্লগও লেখেন (অথবা আগে লিখতেন)। অনেক বেশি বই লেখার অভিজ্ঞতা আপনার পড়ার জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে? সম্প্র্রতি মাধ্যমিক গ্রেডের কোন কোন বই আপনার ভালো লেগেছে?
: একজন পাঠক হিসাবে আমি বইয়ের যাত্রা শুরু করেছি। আমি পড়তে খুব ভালোবাসি। যখন আমি আমার বাচ্চাদের জন্য মুসলিম বই কিনতে শুরু করি, তখন আমার বোন আমাকে এগুলো অনলাইনে শেয়ার করতে বলেছিল। আমি রিভিউ করা শুরু করি, কিন্তু হঠাৎ করেই এর জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল- যা আমি আশা করিনি। অনেক মুসলিম অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের জন্য বই খুঁজতে চেয়েছিলেন এবং আমার রিভিউগুলো দেখে বোঝার চেষ্টা করতেন কোন বইগুলো তাদের পরিবারের সঙ্গে ভালো মানাবে।
তবে, সাম্প্রতিককালে, লেখালেখি আমার জীবনের অনেক বেশি সময় নিয়ে নিচ্ছে! লেখার জন্য অনেক সময় দিতে হয়, তাই আমি এখন কম বই পড়তে এবং রিভিউ করতে পারি। তবে আমি এখনো ভালোবাসা নিয়েই বই শেয়ার করার চেষ্টা করি, তাই হয়তো আমি এখন আমার সময়ের ব্যাপারে আরও সতর্ক হয়ে কাজ করি, কিন্তু এটাও হতে পারে যে আমার ফলোয়ারদের জন্য আরও যত্নশীল তালিকা তৈরি করি।
সম্প্রতি মধ্য-স্তরের যে বইটি আমার খুব ভালোলে গেছিল তা হলো-মলীহা সিদ্দিকীর অহু ডধু ণড়ঁ খড়ড়শ! এটি পড়তে দারুণ এবং এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। আমি প্রধান চরিত্র আইনিকে খুব ভালোবেসেছি এবং আমি চাই প্রতিটি তরুণ পাঠক এ বই পড়ে তাদের শরীরের ওপর নিজস্ব অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক এবং ক্ষমতাবান হোক!
আর আমি খুব আনন্দিত যে, আপনি আমার বইটি ভালোবেসেছেন এবং আশা করি আপনি ভবিষ্যতের বইগুলোও উপভোগ করবেন!
সূত্র: রিডিং মিডল গ্রেড