
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০২:০৩ পিএম
জন্মের প্রথম কয়েক বছরের স্মৃতি কেন মনে রাখতে পারি না?
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫৮ পিএম

আরও পড়ুন
আপনি কি কখনো গভীরভাবে ভেবেছেন, কেন আপনি জন্মের পরের কয়েক বছরের কোনো স্মৃতি মনে করতে পারেন না? যেমন—দোলনায় থাকার মুহূর্ত কিংবা প্রথম জন্মদিনের কেকের স্বাদ?
সম্ভবত, সেই স্মৃতিগুলো আসল নয়। কয়েক দশকের গবেষণা বলছে, বেশিরভাগ মানুষ জীবনের প্রথম কয়েক বছরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মনে রাখতে পারেন না।
তবে, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় নতুন প্রমাণ পাওয়া গেছে, শিশুরা জন্মের পর থেকেই তাদের চারপাশের পৃথিবীকে গ্রহণ করে এবং অনেক আগে থেকেই (পূর্বের ভাবা সময়) স্মৃতি তৈরি করতে শুরু করে।
গবেষণাটিতে যা পাওয়া গেছে
চলতি মাসে ‘সায়েন্স জার্নাল’-এ প্রকাশিত ইয়েল এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১২ মাস বয়সি শিশুরাও হিপোক্যাম্পাস (যেখানে মস্তিষ্কের নতুন নিউরন তৈরি হয়) ব্যবহার করে স্মৃতি তৈরি করতে পারে। মস্তিষ্কের এই অংশটি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এই গবেষণায় গবেষকরা বিশেষভাবে শিশুদের জন্য তৈরি একটি ব্রেন স্ক্যান ব্যবহার করেন; যা এক সেশনেই শিশুর জেগে থাকা অবস্থায় মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়। এতে দেখা হয়, শিশুদের মস্তিষ্ক কোনো ব্যক্তির মুখ ও বস্তু দেখলে কেমন প্রতিক্রিয়া জানায়। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাবা-মা শিশুদের কাছে থাকার কারণে তারা শান্ত ও সতর্ক থাকে।
গবেষণায়, ৪ থেকে ২৫ মাস বয়সি ২৬ শিশুকে বিভিন্ন ছবি দেখানো হয়। দেখা গেছে, কোনো নির্দিষ্ট ছবি প্রথমবার দেখার সময় শিশুর হিপোক্যাম্পাস যত বেশি সক্রিয় ছিল, পরে একই ছবি আবার নতুন একটি ছবির পাশে রাখলে শিশুটি সেই পরিচিত ছবিটির দিকেই বেশি সময় তাকিয়ে থাকত—যার মানে হলো, সে ছবিটি চিনতে পেরেছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের পোস্টডক্টোরাল গবেষক এবং এ গবেষণাটির প্রধান লেখক ট্রিস্টান ইয়েটস বলেন, ‘আমাদের ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, শিশুর মস্তিষ্কে স্মৃতি তৈরির সক্ষমতা রয়েছে– তবে এই স্মৃতিগুলো কতদিন স্থায়ী হয়, তা এখনও একটি খোলা প্রশ্ন হিসেবে থেকে গেছে।’
এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন, একটি জাগ্রত শিশুর মস্তিষ্কে কিভাবে একটি স্মৃতি তৈরি হতে শুরু করে। আগের গবেষণাগুলো ছিল পরোক্ষ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে; যেমন—শিশুরা কিছু পরিচিত জিনিসে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এবার সরাসরি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এর আগের বেশিরভাগ গবেষণা শিশুদের ঘুমের সময় করা হয়েছিল, যার ফলে জেগে থাকা অবস্থার স্মৃতি তৈরির ব্যাপারে গবেষণায় সীমাবদ্ধতা ছিল।
এই গবেষণা শৈশবের স্মৃতি সম্পর্কে কী বলে?
এই গবেষণার ফলাফল নতুন একটি ইঙ্গিত দিয়েছে। তা হলো- এপিসোডিক মেমোরি (কোনো একটি ঘটনা এবং তার প্রেক্ষাপট মনে রাখার স্মৃতি) পূর্বে ধারণার চেয়ে অনেক আগেই বিকাশ লাভ করতে শুরু করে।
এর আগে মনে করা হতো এই ধরনের স্মৃতি গঠন শিশুর ১৮-২৪ মাস বয়স হওয়ার পর গঠন শুরু করে। যদিও এই গবেষণায় সবচেয়ে স্পষ্ট প্রভাব দেখা গেছে ১২ মাস বা তার বেশি বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে; তবে এর প্রমাণ আরও ছোট শিশুদের মধ্যেও দেখা গেছে।
কোন বয়স থেকে স্মৃতি তৈরি হয়?
এই গবেষণায় উঠে এসেছে, মাত্র ২-৩ মাস বয়স থেকেই শিশুরা সীমিত ধরনের স্মৃতি তৈরি করতে শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে ইমপ্লিসিট মেমোরি (যেমন মোটর স্কিল বা নড়াচড়া শেখা)। এই মেমোরিটি শিশুদের ভাষা, মুখাবয়ব ও দৈনন্দিন নিয়মিত ঘটনার ধরন বুঝতে সাহায্য করে।
তবে এপিসোডিক মেমোরি (নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা এবং সেটি কোথায় ও কখন ঘটেছে তা মনে রাখতে সাহায্য করে) তৈরি হতে আরও বেশি সময় নেয়। এর জন্য হিপোক্যাম্পাস নামক মস্তিষ্কের একটি অংশের পরিপক্বতা প্রয়োজন।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরাল সায়েন্সের অধ্যাপক ক্রিস্টিনা মারিয়া আলবেরিনি জানান, শৈশবে হিপোক্যাম্পাস স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণের ক্ষমতা অর্জনের সময়টি একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ সময়’ হতে পারে। এই সময়টি শুধু স্মৃতির জন্য নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত এবং ভবিষ্যতে স্মৃতি বা জ্ঞান সংক্রান্ত সমস্যার জন্যও তা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
তবে মনে করা হয়, শৈশবে তৈরি হওয়া স্মৃতিগুলো খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আর এই কারণেই বড় হয়ে আমরা সেসব স্মৃতি মনে রাখতে পারি না।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটে চলমান এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ মাস বয়সি শিশুরা কোন খেলনাটি কোন রুমে ছিল তা ছয় মাস পর্যন্ত মনে রাখতে পারে, তবে আরও ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে এই স্মৃতি মাত্র এক মাস স্থায়ী হয়।
কেন আমরা শৈশবের কিছুই মনে রাখতে পারি না?
মানুষের প্রাকৃতিকভাবে শৈশবকালীন ব্যক্তিগত এসব স্মৃতি ভুলে যাওয়ার প্রবণতাকে বলা হয় ‘ইনফ্যান্টাইল অ্যামনেশিয়া’।
আগে মনে করা হতো, শিশুর মস্তিষ্ক তখনও পরিপক্ব নয় বলে তারা স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তারা স্মৃতি তৈরি করে ঠিকই—তবে প্রশ্ন হলো, কেন এই স্মৃতিগুলো পরবর্তীতে আমরা স্মরণ করতে পারি না?
বিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যায় বলেন, শিশুর মস্তিষ্কে দ্রুত নিউরোজেনেসিস হয়—অর্থাৎ নতুন নিউরনের দ্রুত সৃষ্টি। এই দ্রুত গঠন সম্ভবত পুরোনো স্মৃতিকে বাধাগ্রস্ত করে।
প্রাণীদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যখন শিশু ইঁদুরের নিউরোজেনেসিস ধীর করে দেওয়া হয়, তখন তারা প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুরের মতো দীর্ঘ সময় স্মৃতি ধরে রাখতে পারে।
আরেকটি তত্ত্ব বলছে, এপিসোডিক মেমোরি গঠনের জন্য ভাষা এবং আত্মপরিচয়ের বোধ প্রয়োজন। যেহেতু এই বিষয়গুলো তিন বা চার বছর বয়সের আগে গড়ে ওঠে না, তাই তখনকার স্মৃতি গঠিত হলেও তা সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধার করা হয় না।
কিছু গবেষক মনে করেন, এই ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বিকাশের জন্য উপকারী। অতীতের ছোট ছোট স্মৃতি ধরে রাখার বদলে, মস্তিষ্ক তখন সাধারণ জ্ঞান গঠনে মনোনিবেশ করে—যেমন, পৃথিবী কিভাবে কাজ করে, সমাজের নিয়ম-রীতি ইত্যাদি।
কেউ কি সত্যিই শিশুকালের স্মৃতি মনে করতে পারেন?
কিছু মানুষ দাবি করেন, তারা শিশু থাকা অবস্থার ঘটনা মনে করতে পারেন। তবে গবেষণা বলছে, এগুলো প্রকৃত এপিসোডিক স্মৃতি নয়।
ইয়েল ও কলাম্বিয়ার গবেষণা অনুযায়ী, এই বিশ্বাস সাধারণত একটি মানসিক প্রক্রিয়ার ফলে হয়; যাকে বলে ‘সোর্স মিসঅ্যাট্রিবিউশন’।
ধরা যাক, কেউ মনে করছেন তিনি তার প্রথম চুল কাটার সময় কেঁদেছিলেন। তবে এই তথ্যটি সে হয়তো কোনো ছবি, গল্প কিংবা পরিবারের মুখে শুনেছিল এবং পরে এটিকে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে মনে করছেন।
শিশুকালের ভিডিও, পারিবারিক গল্প বা প্রাথমিক বিকাশকে ঘিরে সংস্কৃতির গুরুত্ব এসব ভ্রান্ত স্মৃতিগুলো গড়ে তুলতে পারে।
বর্তমানে ইয়েলে একটি নতুন গবেষণা চলছে যেখানে বাবা-মা তাদের শিশুকে নিয়মিত ভিডিও করছেন—কখনো শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে আবার কখনো মাথায় ক্যামেরা লাগিয়ে। পরে এই ভিডিওগুলো বড় হয়ে যাওয়া শিশুদের দেখানো হবে—তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ দেখে বোঝার চেষ্টা করা হবে, তারা সেই স্মৃতি চিনতে পারে কিনা।
ভবিষ্যতে কি শৈশবের স্মৃতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে—শৈশবের স্মৃতি কি পুরোপুরি মুছে যায়, নাকি শুধু অনুপলব্ধ হয়ে পড়ে?
গবেষক ইয়েটস বলেন, এই নতুন গবেষণায় এর উত্তর না মিললেও ইয়েল ল্যাবের অন্য গবেষণায় দেখা গেছে—শৈশবে তৈরি স্মৃতি ছোটবেলায় মনে রাখা গেলেও বয়স বাড়লে তা হারিয়ে যায়।
তিনি বলেন,‘আমার কাছে এই ভাবনাটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় যে, আমাদের শৈশবের কিছু স্মৃতি হয়তো এখনো আমাদের মস্তিষ্কে কোনো না কোনোভাবে রয়ে গেছে।’
প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুরের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, অপটোজেনেটিক্স নামক একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইঁদুরের শৈশবের স্মৃতি ফিরিয়ে আনা গেছে। এটি নির্দিষ্ট স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্কের কোষ শনাক্তের পর আলো ব্যবহার করে সেই কোষগুলো সক্রিয় করা হয়; যার ফলে ইঁদুর সেই স্মৃতিকে মনে করতে পারে।
এই প্রযুক্তি এখনো মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়নি; তবে এটি ইঙ্গিত দেয়—সমস্যা স্মৃতির অস্তিত্বে নয় বরং স্মৃতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া।
টরন্টোর দ্য হস্পিটাল ফর সিক চিলড্রেন-এর প্রধান গবেষক পল ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড বলেন, হয়তো এমন কিছু স্বাভাবিক পরিস্থিতি রয়েছে, যেগুলো এই প্রাথমিক স্মৃতিগুলোকে আবার মনে পড়তে সাহায্য করতে পারে।’
সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো মনোবিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করতেন, প্রাথমিক স্মৃতি হারিয়ে যায় না বরং অবচেতন মনের গভীরে চাপা পড়ে থাকে এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে (যেমন মনোচিকিৎসার মাধ্যমে) তা আবার ফিরে আসতে পারে।
তবে ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড এটিকে একটি ‘বিতর্কিত বিষয়’ বলে উল্লেখ করেন; কারণ এই ধরনের উদ্ধারকৃত স্মৃতির সত্যতা যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন।