বিয়ের আগে ভয়ে ‘পা ঠান্ডা’ হয়ে আসছে? ‘কোল্ড ফিটে’ ভুগছেন না তো?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৩ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই নিজের পছন্দের সঙ্গীকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন প্রতীতি জয়িতা জামিল। বিয়ে নিয়ে একদিকে যেমন উচ্ছ্বাস কাজ করছে, তেমনি কিছু উদ্বেগও আছে তার মধ্যে।
তিনি বলছেন, আমার নিয়মিত যে লাইফস্টাইল ছিল, সেখান থেকে একটু আলাদা লাইফস্টাইলে ঢুকতে হবে। তাছাড়া প্রতিদিনই পরিবারের বলছে, ‘বাসায় যা করো, ওইখানে করবে না’- এই যে বাইন্ডিংসগুলা, এগুলাতে একটু টেনশন থাকেই।
কেবল জয়িতা জামিলই না, বিয়ের আগ দিয়ে এমন সংশয়, উদ্বেগ কিংবা চাপ বোধ করেন প্রায় সবাই। আর এই বিষয়টিকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘কোল্ড ফিট’ বা ‘পা ঠান্ডা হয়ে আসা’।
‘কোল্ড ফিট’ কী?
‘কোল্ড ফিট’ মূলত একটি টার্ম, যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সঙ্গীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার আগে অনিশ্চিয়তার অনুভূতিকে বোঝায়। মূলত প্রতীকী অর্থে এই টার্মটির ব্যবহার হয়ে থাকে।
সাইকোলজিস্ট হাসিবুল আজিম আকাশ বলেন, কোল্ড ফিট তখনই হয়, যখন কোনো অজানা বিষয় নিয়ে ভয় বা উদ্বেগ কাজ করে। বিয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অনেক বেশি কাজ করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি পারবো কি না, আমার সঙ্গে এমনটা হবে কিনা এমন চিন্তা থেকেই ভয়টা কাজ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক ক্লিনিক্যাল সাইকোলিজিস্ট জোসেলিন চার্নার্সের মতে, বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মানুষ যে ভয়, সংশয় আর দুশ্চিন্তা কাজ করে তার একটি ‘আমব্রেলা টার্ম’ কোল্ড ফিট। কোল্ড ফিট হলে সম্পর্কে দুইজন কতটা মানানসই হবে কিংবা সম্পর্কটির স্থায়িত্ব কতদিন হবে এমন সব বিষয় নিয়ে উদ্বেগ কাজ করতে পারে।
মতবিরোধ, জীবনের ভিন্ন লক্ষ্য বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলাদা প্রত্যাশা নিয়ে উদ্বেগের মতো বিষয়গুলোও সিদ্ধান্তের ওপর অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলতে পারে।
জার্নাল অফ ফ্যামিলি সাইকোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সময়ের সাথে সাথে দাম্পত্য জীবনের সন্তুষ্টি কমতে থাকার সঙ্গে বিয়ের আগে থেকে থাকা সন্দেহের একটি সম্পর্ক রয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, এই ধরনের সংশয় থাকা স্বাভাবিক হলেও এটি হয়তো সবসময় এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই।
কোল্ড ফিটের লক্ষণগুলো কী?
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মঞ্জুরুল ইকরাম। এ বিষয়ে তিনি বলছেন, বিয়ের প্রস্তুতিসহ সব কিছু মিলিয়ে কখনও কখনও ‘প্রথম যে বিষয়টা আসে সেটা হলো বিয়ে করবো না।
এটি কোল্ড ফিটেরই একটি লক্ষণ। বিয়ের আগে কেউ কোল্ড ফিটে ভুগছেন কিনা তা বোঝার জন্য এমন আরও বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
যেমন, ব্যক্তির তীব্র সংশয়ের অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া।
অনেক সময় বিয়ের আগে ব্যক্তি নিজের এবং সঙ্গী- দুইজনের ভবিষ্যৎ নিয়েই সংশয়ে ভোগেন, যে যাকে পছন্দ করেছেন সে মানুষটা তার জন্যে ঠিক কিনা কিংবা বিয়ের জন্য সময়টা সঠিক কিনা।
এমনকি বিয়েই করতে চাচ্ছেন কিনা – এমন অনুভূতিও কাজ করে। এছাড়াও সারা জীবনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবার বিষয়টি নিয়েও এক ধরনের সংশয়ও কাজ করে।
কখনও কখনও বিয়ে ভাঙার মতো চিন্তাও মাথায় খেলা করে।
তবে সবার ক্ষেত্রে বিষয়গুলো যে খুব প্রকাশ্যে আসে, তেমনও না। অনেকের ক্ষেত্রে বিয়ের পরিকল্পনা ঘিরে তীব্র উদ্বেগে কাজ করে, কিন্তু সে নিজেই বুঝতে পারে না যে এটি ঘটছে কোল্ড ফিটের কারণে।
যেমন, বিয়েতে কোন রঙের পোশাক পরবেন কিংবা হানিমুনে কোথায় যাবেন – তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে কেউ যদি কান্নায় ভেঙে পড়ে তবে তা হয়তো সব বিষয় নিয়ে তার আরও নিখুঁত হতে চাওয়ার কারণে না, বরং বিয়ে নিয়ে ভয়ের কারণেই হচ্ছে।
আর সবশেষে সঙ্গীর সঙ্গে অনবরত ঝগড়া হতে পারে এবং অন্যান্য ব্যবহারগত পরিবর্তনও আসতে পারে।
ইকরাম বলছেন, স্ট্রেস বেসিক্যালি আমাদের দুজনকে নিয়েই, অন্য কিছু না। টেম্পার লুজ করার বিষয়টা ঘটছে, আগের চেয়ে একটু বেশি ফ্রিকুয়েন্ট এখন।
তার মতোই অনেকে বিয়ের আগে সঙ্গীর সঙ্গে বারবার মনোমালিন্যে জড়ান। বিয়ের আগে এই বিষয়গুলো একটু বেশিই ঘটে, কারণ কোল্ড ফিট।
বিয়ের আগে কোল্ড ফিট কেন হয়?
চার্নাসের মতে, ‘কোল্ড ফিট’ অনুভবের একটা কারণ হয়তোবা বিয়ে, যা জীবনের অনেক বড় একটি সিদ্ধান্ত। অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগের মধ্যে ভারসাম্যের অর্থ দাঁড়াতে পারে যে আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্তটি নিচ্ছে, যেমনটা নেয়া উচিৎ।
তিনি বলেন, যদি কোনো বড় চাকরির সাক্ষাৎকারের আগে আমরা বিচলিত না হই, তাহলে হয়তো আমরা সেই চাকরিটা পাওয়ার জন্য খুব একটা আগ্রহী নই। বিয়ে বিষয়টিকে আমি একইভাবে ভাবি; আমাদের একটু বিচলিত থাকা উচিত, ক্রিটিক্যালি চিন্তা করা উচিত এবং একে সব দিক থেকে বিশ্লেষণ করা উচিত।
এছাড়াও অজানার ভয়, বিয়ে সংক্রান্ত প্রস্তুতির চাপ, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া নিয়ে উদ্বেগ, দুইজনের মিল হওয়া না হওয়া এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্য আলাদা হতে পারার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনার কারণে কোল্ড ফিট হতে পারে।
এক্ষেত্রে বিয়ের আগে কেবল আনন্দ আর উদযাপনের বিষয়গুলোই তুলে ধরে এনিয়ে ভুল ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা সিনেমার একটি ভূমিকা থাকে বলেও মন্তব্য করেন চার্নার্স।
কোল্ড ফিটকে যেভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে
হাজারটা সংশয়ের মধ্যেও বিয়ে নিয়ে উচ্ছ্বসিত জয়িতা জামিল। ব্যক্তি হিসেবে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে কী অনুভব করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি এক্সাইটেড আমি আমার পার্টনারের সঙ্গে ফাইনালি থাকতে পারবো।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিয়ের আগে একইসঙ্গে সংশয় ও উচ্ছ্বসিত বোধ করা স্বাভাবিক।
সেক্ষেত্রে উদ্বেগ বা ভয়ের বিষয়গুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া এবং একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ সঙ্গীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা জরুরি।
মনোবিদ চার্নার্স বলছেন, সম্পর্কের একটি নেতিবাচক বিষয় হলো কোনো দম্পতি তাদের ভয় বা উদ্বেগ তাদের সঙ্গীকে জানাতে চায় না বা পারে না। যোগাযোগে এই ধরনের ঘাটতির অর্থ হয়তো সম্পর্কটি পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত না।
কাপল থেরাপিস্ট আকাশের মতে, বিয়ের আগে কিছু বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা জরুরি। বিয়ের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা হয়, দেখতে সুন্দর কিনা বা ভালো আয় করে কিনা। কিন্তু এটাই শেষ না। এক্ষেত্রে জীবনের দর্শন মেলা প্রয়োজন।
উদাহরণ দিয়ে আকাশ বলেন, কারো জন্যে যদি দেশে থাকা কিংবা সরকারি চাকরি করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, আর তার ভবিষ্যৎ সঙ্গীর ইচ্ছা থাকে দেশের বাইরে সেটেল করা- তবে পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ঝামেলা হবার শঙ্কা রয়েছে।
আবার কেউ যদি চান তার ভবিষ্যৎ সঙ্গী বিয়ের পর কাজ করবে না, কিন্তু তিনি যাকে বিয়ের কথা ভাবছেন, তার ইচ্ছা থাকে যে বিয়ের পরও কাজ চালিয়ে যাবেন সেক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এমন বিষয়গুলো যেন ভবিষ্যতে ঝামেলার উদ্রেক না করে, তা নিশ্চিত করতে আগেই নানামুখী আলোচনা করা প্রয়োজন।
এতে করে পরবর্তী সময়ে কোল্ড ফিট দেখা দিলেও, সহজেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এছাড়াও পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেও কোল্ড ফিট কাটানো যেতে পারে।
সবশেষে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া জরুরি। সম্পর্কে যে বিষয়গুলো সামনে আসছে তা কি সমাধান সম্ভব কিনা সে বিষয়েও বুঝতে হবে।
তবে...
তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোল্ড ফিটকে গুরুত্ব দেয়া দরকার আছে বলেই মত বিশ্লেষকদের। কখনো কখনো অমীমাংসিত বিষয়গুলোই সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। আবার ভবিষ্যৎ সঙ্গীকে যেমনটা আশা করেছিলেন, তাতে ফাঁক থেকে যেতে পারে। একা থেকে যাওয়ায় ভয় কিংবা সামাজিক চাপের কারণেও অনেকে বিয়ের মতো সিদ্ধান্তের দিকে আগান, যা একেবারেই ঠিক না।
এমন ক্ষেত্রে উদ্বেগের মুখোমুখি হবার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আকাশের ভাষ্য, আমাকে আগে জানতে হবে, আমার ভয়টা কী নিয়ে। প্রয়োজনে প্রফেশনাল হেল্পও নেয়া যেতে পারে। বিয়ে করার পর আক্ষেপ করার চেয়ে তার আগেই সরে যাওয়া ভালো বলে মত এই বিশেষজ্ঞের।
তিনি বলেন, ডিজাস্টার ক্রিয়েট করার চেয়ে আগে থেকেই প্রটেকশন নেয়া ভালো। এতে ভুল একটাই হলো যে বিয়ে করলাম না। কিন্তু বিয়ের পর এমন হলে নিজের সঙ্গে বাচ্চাদেরও ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়ে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা