রান্নায় মসলা ব্যবহারে স্বাস্থ্য সুরক্ষা
আখতারুন নাহার আলো
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম
নিত্যদিনের রান্নায় আমরা নির্দিষ্ট কিছু মসলা ব্যবহার করি। এর বাইরে ঈদের দিনে, বিশেষ খাবার তৈরিতে বাড়তি কিছু মসলার ব্যবহার হয়, যা খাবারের স্বাদ, সুঘ্রাণ ও পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। এ মসলাগুলোর মধ্যে আছে-মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, জিরা, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, গোলমরিচ, জায়ফল, জয়ত্রী, পোস্তদানা, শাহ্জিরা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা, আলুবোখারা, বাদাম, নারিকেল, মৌরি, হিং, মাওয়া, সরিষা ইত্যাদি। কয়েকটি মসলার গুণাগুণ এখানে দেওয়া হলো-
▶ মরিচ : মরিচে আছে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ‘সি’ ও ‘এ’। মরিচ ফুসফুসের জন্য ভালো এবং জমাট রক্তকে দ্রবীভূত করে। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমিয়ে দেয়। মরিচ চর্বিমুক্ত, তাই স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এটি ইনসুলিন ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় বলে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এতে ব্রেনের এন্ডোরফিন বেড়ে যায় বলে মন ভালো থাকে। মরিচ মাইগ্রেন, মাথাব্যথা, সায়নোসাইটিস ও আর্থ্রাইটিসের সমস্যা থেকে মুক্ত রাখে।
▶ হলুদ : এটি যে কোনো জীবাণুর বিষক্রিয়াকে ধ্বংস করে। হলুদ ক্ষত সারাতে সাহায্য করে বলে অ্যান্টিবায়োটিক হিসাবে কাজ করে। এটি পাকস্থলীর প্রদাহ কমায়, আর্থ্রাইটিসের ব্যথা দূর করে, সর্দি-কাশিতে উপকারী। প্রস্রাবে জ্বালা করলে এক চা-চামচ কাঁচা হলুদের রস মধু বা চিনি দিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। লৌহ বেশি আছে বলে রক্তস্বল্পতায় উপকারী। হলুদ স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
▶ ধনিয়া : এতে থাকে ভিটামিন কে, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি হাড়ের ব্যথা দূর করে।
▶ জিরা : এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে, যা হজমে সাহায্য করে। দেহে লৌহের জোগান দেয়। ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করে।
▶ আদা : আদা অস্টিওপোরোসিস বা হার ক্ষয়ে উপকারী। এটি হজমকারক। রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে। কাশি ও বমিভাব কমায়। সর্দি-কাশিতে আদা-চা বেশ উপকারী। মাংস নরম করতে আদার জুড়ি নেই।
▶ রসুন : রসুনে আছে গন্ধক বা সালফারযুক্ত যৌগ। এতে আছে এনজাইম, ভিটামিন ‘বি’ এবং বিভিন্ন দরকারি ধাতু। এটি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে, সর্দি-কাশি সারায়, অ্যাকজিমা দূর করে, ঘাম হতে সাহয্য করে। এর এলিসিন নামক পদার্থটি রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও রক্তে শর্করা কমায়। এছাড়া মানসিক চাপ ও শ্বাসকষ্ট কমায়, স্নায়বিক সমস্যা রোধ করে। শরীরের পরজীবী ধ্বংস করে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
▶ পেঁয়াজ : মধুর সঙ্গে পেঁয়াজের রস মিশিয়ে খেলে কফ দূর হয়। এটি হজমকারক ও জমাট রক্তকে তরল করতে কার্যকর। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অস্টিওপোরোসিস, উচ্চ কোলেস্টেরল কমাতে পেঁয়াজ সাহায্য করে। এটি অকাল বার্ধক্য রোধ করে। প্রতিদিন অর্ধেকটা কাঁচা পেঁয়াজ খেলে ৩০ শতাংশ রক্তের ভালো করলেস্টেরল এইচডিএল বেড়ে যায়। এছাড়া রক্তস্বল্পতা, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, প্রস্রাবের সংক্রমণ, গাউট এবং আর্থ্রাইটিসে পেঁয়াজের ভূমিকা কার্যকর।
▶ গোলমরিচ : এতে আছে ম্যাঙ্গানিজ, যা হাড়, ক্ষত সারানো ও বিপাক ক্রিয়ায় কাজে লাগে। আরও আছে ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, পটাশিয়াম, ফলিক অ্যাসিড ও খাদ্য আঁশ। এতে ক্যালরি কম থাকে।
▶ জায়ফল ও জয়ত্রী : এতে আছে প্রচুর আঁশ। হজমে সাহায্য করে। মাংস সিদ্ধ ও সুঘ্রাণের জন্য এ মসলা ব্যবহার করা হয়। এর ব্যবহার খুব পরিমাণে করা হয়। গর্ভবতীদের এ মসলা না খাওয়াই ভালো। জায়ফলের ওপরের খোসাগুলোই জয়ত্রী। ফল পাকলে খোসা কমলা রং ধারণ করে। তারপর খোসা ছাড়িয়ে নিলে সেটা জয়ত্রী হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
▶ পোস্তদানা : ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও আঁশযুক্ত মসলা। এতে পর্যাপ্ত ম্যাঙ্গানিজ ও লৌহ আছে। সেজন্য রক্তের হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে। ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড ও অলিয়িক অ্যাসিডের জন্য রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে ও হৃদরোগে উন্নতি ঘটায়। এটি অনিদ্রা দূর করে, হাড় মজবুত করে। হজমে সাহায্য করে। মুখের ঘা সারায়, কিডনিতে পাথর হতে বাধা দেয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে। মানসিক অবসাদ দূর করে। এটা নিরামিষে দিলে স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।
▶ এলাচ : বদ হজম ও পেট ফাঁপায় কার্যকর। আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম। হার্ট, মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং লিভারের সুরক্ষা দেয়। হজমে সাহায্য করে। ব্রঙ্কাইটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে।
▶ দারুচিনি : দারুচিনি খাবারে সুগন্ধ বাড়ায়। বায়ুনাশক, উদ্দীপক, অ্যান্টিসেপটিক এবং ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলে বা সর্দি-কাঁশিতে দারুচিনি সিদ্ধ পানি খেলে উপকার হয়। এটি হজম শক্তি বাড়ায় ও যন্ত্রণা নিবারণ করে।
▶ লবঙ্গ : সর্দি-কাঁশিতে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। গলার স্বর ভালো রাখতে এবং দাঁত মজবুত ও সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে লবঙ্গ তেল ব্যবহার করা হয়। লবঙ্গের তেলে ইউজেনল নামক একটি রাসায়নিক আছে যা ব্যথা কমাতে ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে।
▶ তেজপাতা : খাবারকে সুঘ্রাণযুক্ত করে। কাশি সারাতে ভালো কাজ করে। এতে আছে ভিটামিন এ, বি-৬, সি। এগুলোর জন্যই তেজপাতা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি হজমে সহায়ক। তেজপাতা চা ডায়রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
▶ আলুবোখারা : এটি টক-মিষ্টি। হজমক্রিয়া ঠিক রাখে এবং ত্বক উজ্জ্বল রাখে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে এবং কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
▶ বাদাম : সব ধরনের বাদামে আছে ওমেগা-৩, ওমেগা-৬, ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ‘বি’ ও ভিটামিন ‘ই’। এসব উপাদান স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। চিনাবাদাম মস্তিষ্কের যেমন উন্নতি ঘটায় তেমনি ত্বক ভালো রাখে। কাঠবাদাম অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে। আখরোটকে বাদামের রাজা বলা হয়। এটি রক্তনালির উন্নতি ঘটায়। ফলে হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকে। বাদামে প্রচুর প্রোটিন আছে।
▶ কিশমিশ : কিশমিশে লৌহ ও ক্যালসিয়াম প্রচুর আছে। শিশুদের কোষ্টকাঠিন্য দূর করার জন্য প্রতিদিন ৫-৬টা ভিজানো কিশমিশ দিতে হবে। কিশমিশ কোলেস্টেরল কমায়। এতে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি।
▶ নারিকেল : ঈদের রান্নায় কম-বেশি নারিকেল ব্যবহার করা হয়। নারিকেলের দুধ গরুর দুধের চেয়েও উপকারী। এটি বুদ্ধিবৃত্তি বাড়ায় এবং মাথা ব্যথায় উপকার করে।
▶ দই : দই সহজপাচ্য। এটি দেহে প্রোবায়োটিক হিসাবে কাজ করে। যা দেহ থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে শরীরকে সতেজ রাখে। রোগ-জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। দই মিট টেন্ডারাইজার হিসাবে কাজ করে মাংসকে হজম হতে সাহায্য করে। খাবারের স্বাদ বাড়ায়। দইয়ে আছে প্রচুর ক্যালরি যা অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া নিঃস্বরণ করে।
লেখক : চিফ নিউট্রিশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান (অব.), বারডেম। সভাপতি, ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী ও অ্যাডভান্স হাসপাতাল, ঢাকা।