গরমের সময় অনেক রসালো ফল পাওয়া যায়। এ ফল আমাদের দেহে পানির অভাব পূরণের পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন কাজে লাগে। এ সময় পাওয়া যায় আম, কাঁঠাল, জাম, তালের শাঁস, লিচু, বাঙ্গি, তরমুজ, জামরুল ইত্যাদি।
* আম
স্বাদ ও গুণের জন্য আমকে ফলের রাজা বলা হয়। ক্যারোটিন সমৃদ্ধ এ ফল ত্বকের মসৃণতা, চুলের উজ্জ্বলতা ও চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এতে আছে ভিটামিন এ, সি, শর্করা, পটাশিয়াম। আম পাকার সঙ্গে সঙ্গে এটি শর্করা দিতে পূর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ গ্লুকোজ, ফ্রুকস্টোজ ও সুক্রোজ বেশি পরিমাণে থাকে। আমের আকারের ওপর এর ক্যালরি নির্ভর করে। একটি মাঝারি মাপের আমে প্রায় ৫০-১০০ ক্যালরি থাকে। এই ফল শরীরকে ঠান্ডা রাখে। প্রচুর আঁশ থাকে বলে এটা পরিপাকতন্ত্রের ওপর ভালো কাজ করে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। যাদের রক্তে পটাশিয়াম বেশি আছে, তাদের এর পরিমাণ বুঝে আম খাওয়া উচিত। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে দিনে মাঝারি মাপের দুটি আম খেতে পারেন। তবে সেটাও একসঙ্গে নয়। হৃদরোগীরা আম খেলে কোনো ক্ষতি নেই। এই ফল দ্রুত হজম ও শোষণ হয়। এজন্য ছোট শিশুদের আম দিলে ভালো হয়। আম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কাঁচা আমে শর্করা ও পেকটিনের পরিমাণ বেশি। গ্যালিক অ্যাসিডের জন্য কাঁচা আম টক স্বাদযুক্ত হয়।
* কাঁঠাল
কাঁঠাল বেশ শক্তিদায়ক ফল। এতে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। যাদের ওজন কম ও দুর্বল স্বাস্থ্যের তারা কাঁঠাল খেলে উপকার পাবেন। এটি রসালো, রুচিকর ও আঁশযুক্ত। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের জন্য এটি ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এতে ক্যালসিয়ামও প্রচুর আছে। কাঁচা-পাকা কাঁঠাল এবং কাঁঠালের বিচি পুষ্টিকর ও স্বাদযুক্ত। এতে ক্যারোটিন আছে ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম। সকাল ও বিকালের নাশতায় কাঁঠাল-মুড়ি বেশ উপাদেয় ও স্বাস্থ্যকর নাশতা।
* জাম
জামের রসে কিছুটা কষভাব রয়েছে। অম্লধর্মী এ ফলের রসে আছে এক ধরনের বিশেষ এনজাইম। যা ত্বকের দাগ ওঠাতে অব্যর্থ। লৌহ বেশি আছে বলে জাম রক্তস্বল্পতায় উপকারী। অন্যান্য খনিজ পদার্থের পাশাপাশি এতে অক্সালিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে বলে কিডনিতে পাথর হলে না খাওয়াই ভালো। আবার জাম বায়ুবর্ধক বলে উচ্চরক্তচাপের রোগীদের সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। পাকা জামের রস পাকস্থলী ও যকৃতকে সুস্থ রাখে। এদিকে জৈব অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি বলে পেটে গ্যাস সৃষ্টি হয় ও পেট ভার বোধ হয়। জামের ফুল, ফল, পাতা, ছাল, শেকড় সব কিছুই বনৌষধিতে ব্যবহৃত হয়। জামের বিচির গুঁড়া ডায়াবেটিক রোগীর চিনির পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে।
* তালের শাঁস
এটি রসালো, সুস্বাদু ও ঠান্ডা। এটি দেহে শীতল আমেজ আনে ও শরীরে পানির অভাব পূরণ করে। শর্করা ও ক্যালরি কম থাকে বলে ডায়াবেটিসে খেতে বাধা নেই। এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ফল। তাল শাঁস কোষের ক্ষয়রোধ করে তারুণ্য ধরে রাখে। দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও হাড় ক্ষয় রোধ করে। রোদে পোড়া ত্বকে যে একটা লালচে ভাব পড়ে সেটা দূর করতে পারে তালের শাঁস। এছাড়া চিকেনপক্স হলে ত্বকে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় তা নিরাময় করে ও পক্সের দাগ দূর করে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
* লিচু
এটি তৃষ্ণা নিবারক। শরীরকে শীতল ও সতেজ রাখে। লিভার ও ব্রেনকে সুরক্ষা দেয়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তে চর্বির পরিমাণ কমায়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ লিচুতে ভালো পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে।
* বাঙ্গি
হলুদ রঙের ক্যারোটিনযুক্ত এ ফলটি বেশ মিষ্টি হয়ে থাকে। বাঙ্গির জুস ওজন কমায়। কারণ এতে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে। অল্প খেলেও পেট ভরে যায়। বাঙ্গি মূত্র ও মূত্রথলির প্রদাহ রোধ করে। কোষ্ঠবদ্ধতা, অ্যাসিডিটি ও পেপটিক আলসারে বাঙ্গি কার্যকর। এটি আঁশযুক্ত এবং ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এতে ভিটামিন এ, ফোলেট, পটাশিয়াম ও সামান্য পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন সি আছে। বাঙ্গির অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, শরীরের তাপমাত্রা কমায়, ক্লান্তি দূর করে, রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় ও হাড় ক্ষয় রোধ করে।
* তরমুজ
তরমুজে আছে দুটি এমাইনো অ্যাসিড। একটি এল-আর্জিনাইন অন্যটি এল-সাইট্রলিন। এগুলো রক্তের চাপ বেশি থাকলে তা কমিয়ে স্বাভাবিকে নিয়ে আসে। তরমুজে ক্যালরি কম, তবে পুষ্টিগুণ বেশি। এতে আছে লৌহ, লাইকোপেন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম। তরমুজ রক্তস্বল্পতা ও রাতকানা রোগে ভালো ফল দেয়। প্রস্রাবের জ্বালা-পোড়া, অর্থাৎ প্রস্রাবের সংক্রমণ কমায়। কিডনি সবল রাখতেও তরমুজের রস সাহায্য করে। টাইফয়েডের রোগীকে বারবার তরমুজের রস দিলে জ্বরের মাত্রা কমে আসে। লাইকোপেনের জন্য ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি শরীরকে ঠান্ডা রাখে, ক্লান্তি দূর করে, ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো রাখে। এছাড়া পেশির ব্যথা ও প্রদাহ কমায়, শরীরকে হাইড্রেট রাখে ও ত্বকে উজ্জ্বলতা আনে। ক্রমাগত ঘামের ফলে শরীর থেকে যে পানি বেরিয়ে যায়, সেটা পূরণ করতে পারে তরমুজের রস। তরমুজের ভেতরের তাপমাত্রা জীবাণু বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বলে তরমুজ কেটে বেশিক্ষণ বাইরে ফেলে রাখা ঠিক নয়।
* জামরুল
এই ফলের রং ও আকৃতি বেশ সুন্দর। এটি রসালো ও পুষ্টিকর। এতে জলীয় অংশ বেশি থাকে বলে ক্যালরি ও শর্করা কম। এ জন্য ডায়াবেটিস রোগে জামরুল বেশি খাওয়া যায়। রক্তে সোডিয়াম বেড়ে গেলে এটি সোডিয়াম কমাতে সাহায্য করে। এটি আঁশসমৃদ্ধ ও হজমে সহায়ক।
গ্রীষ্মের সব ফলই পুষ্টিকর। আঁশযুক্ত ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এগুলো দেহে কোনো না কোনো কাজে আসে। এ কারণে প্রতিদিনই একটি বা দুটি ফল খাবারের তালিকায় রাখলে ভালো হয়।
লেখক : চিফ নিউট্রিশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান (অব.), বারডেম। সভাপতি, ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী ও অ্যাডভান্স হাসপাতাল, ঢাকা।