‘রেড মিট’ শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর
অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক
প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৪, ১০:৩২ এএম
কিছুদিন পরই মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব কুবরানি ঈদ। এ সময় মুসলিমরা পশু (গরু, ছাগল, দুম্বা) কুরবানির মাধ্যমে স্রষ্টাকে খুশি করার চেষ্টা করেন। ফলে এ সময় খাদ্য তালিকায় ‘রেড মিট’ বা লাল মাংস খাওয়ার পরিমাণও বেড়ে যায়। এ লাল মাংস স্বাস্থের জন্য কতটা ক্ষতিকর বা হৃদরোগীরা কী পরিমাণ খেতে পারবেন তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক
‘রেড মিট’ বা লাল মাংস সাধারণত পশুর মাংসে বিশেষ করে গরুর মাংসে পাওয়া যায়। লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত মাংস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, লাল মাংসে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে এটি গ্রহণে পেটের নাড়ির ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ মাংস পাকস্থলী, অগ্নাশয়, খাদ্যনালি ও অন্ত্রের ক্যানসার সৃষ্টি করে। তবে লাল মাংস বা গরুর মাংস প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানে পূর্ণ। এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন বা লোহা পাওয়া যায়, যা গর্ভবতী, বাড়ন্ত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে। এ লোহা বা আয়রন সহজে অন্ত্রে শোষিত হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি১২ আছে, যা রক্ত তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এ মাংসে প্রচুর পরিমাণে উন্নতমানের প্রোটিন পাওয়া যায় যা দেহ গঠনে সাহায্য করে। গরুর মাংসে প্রচুর পরিমাণে জিংক নামক মিনারেল বা খনিজ পদার্থ থাকে, যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। চর্বি ছাড়া গরুর মাংসে অর্থাৎ লিনকাট মাংসে যেহেতু চর্বির পরিমাণ অনেক কম থাকে ও প্রচুর প্রোটিন থাকে, তাই তিন আউন্স চর্বি ছাড়া মাংসে মাত্র ১৮০ ক্যালরি শক্তি থাকে এবং এতে ১০টিরও বেশি জরুরি খাদ্য উপাদান থাকে।
যারা বেশি বেশি লাল মাংস, মিষ্টি জাতীয় খাবার ও ফ্রেন্স ফ্রাই বা আলু ভাজা খান তাদের হৃদরোগ, ক্যানসার ও অন্য কিছু কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। লিনকাট বা চর্বি ছাড়া মাংসে অর্থাৎ ৩ আউন্স পরিমাণ মাংসে ১০ গ্রামের কম মোট চর্বি, ৪.৫ গ্রামের কম সম্পৃক্ত চর্বি ও ৯৫ মিলিগ্রামের কম কোলেস্টেরল থাকে। তাই গরুর মাংস কেনার সময় লেবেল দেখে কিনতে হবে, যদি মাংস প্রাইম ধরনের হয় তবে এটি সুস্বাদু ও নরম হলেও এতে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ অনেক বেশি। সিলেক্ট গ্রেডে অর্থাৎ লিনকাট মাংসে চর্বির মাত্রা কম থাকে। তাছাড়া গরু পালনের সময় শস্যদানা বেশি খাওয়ানো হলে সেসব গরুর মাংসে চর্বি বেশি থাকে। অন্যদিকে যেসব গরু পালনের সময় বিভিন্ন ধরনের ঘাস বেশি খাওয়ানো হয়, সেগুলোর মাংসে চর্বি কম থাকে ও বেশি পরিমাণে হৃদবান্ধব ‘ওমেগা-৩’ অসম্পৃক্ত চর্বি বেশি থাকে।
সাদা মাংসে মায়োগ্লোবিন নামে এক ধরনের আয়রন বা লোহাযুক্ত প্রোটিন কম থাকে। আয়রনের রং যেহেতু লাল তাই মায়োগ্লোবিন কম থাকার জন্য সাদা মাংসের রং হালকা থাকে। সাদা মাংস সাধারণত পোল্ট্রি অর্থাৎ মুরগি ও টার্কির কিছু কিছু অংশে যেমন বুকের মাংসপেশিতে পাওয়া যায়, কিন্তু পায়ের রানের মাংসে আবার মায়োগ্লোবিন বেশি থাকায় মাংসের রং লাল। লাল মাংসে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল বা সম্পৃক্ত চর্বি সাদা মাংসের তুলনায় বেশি থাকে। কিন্তু যে পাখি উড়ে যেমন হাঁস তাদের বুকের মাংসেও মায়োগ্লোবিন বেশি থাকায় মাংসপেশি লাল। মাছের মাংস সাদা মাংস।
* কম চর্বিযুক্ত খাবার কী কী
কম চর্বিযুক্ত খাবার হলো যাতে সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে। যেহেতু চর্বি জাতীয় খাবারে ক্যালরি অনেক বেশি থাকে, তাই অধিক চর্বিযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। অধিক চর্বিযুক্ত খাবার ওজন বাড়ানোর পাশাপাশি রক্তের চর্বির মাত্রা কিছুটা বাড়ায় ও রক্তে খারাপ চর্বির মাত্রা বাড়িয়ে রক্তনালিতে চর্বির আস্তর বা প্ল্যাক তৈরি করে হৃদযন্ত্রের করোনারি ধমনিতে ও অন্য রক্তনালিতে ব্লক তৈরি করতে পারে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য বা ওজন কমানোর জন্য ও হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য বা হৃদরোগ হলে কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবারের পাশাপাশি কম চর্বিযুক্ত খাবার খেতে হবে।
খাবারে চর্বি জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমালে মোট ক্যালরির পরিমাণ কমবে। অতি কম চর্বিযুক্ত খাবার হলো যদি মোট ক্যালরির শতকরা ১৫ ভাগের কম চর্বি জাতীয় খাবার থেকে আসে। অধিক চর্বিযুক্ত খাবারেও সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বেশি থাকতে পারে কারণ সব চর্বিতেই কিছু না কিছু সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। তাই কোনো ব্যক্তি যদি মাত্র শতকরা ২০ ভাগ সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করেন তাহলেও তার মোট ক্যালরির শতকরা ৭ শতাংশ সম্পৃক্ত চর্বি থেকে আসবে। একজন ব্যক্তির মোট ক্যালরির ৩৫ ভাগের বেশি চর্বিযুক্ত খাবার থাকা যাবে না। খাবারে মোট ক্যালরি থেকে চর্বির মাত্রা শতকরা ৩৫-৪০ ভাগ থেকে কমিয়ে ১৫-২০ ভাগ করলে রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল যেমন এলডিএল ও টোটাল কোলেস্টেরলের মাত্রা শতকরা ১০-২০ ভাগ কমে যাবে।
রক্তে সাধারণত চার ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। এর মধ্যে ট্রাইগ্লিসেরাইড, এলডিএল ও টোটাল কোলেস্টেরল বেশি থাকলে তা হৃদরোগের জন্য ঝুঁকি, আর রক্তে এইচডিএল বেশি থাকলে তা হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো ও হৃদরোগ প্রতিরোধক। অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার যেমন সামুদ্রিক মাছ, ওলিভ অয়েল খেলে রক্তে ভালো কোলেস্টেরল বা এইচডিএল বাড়ে। কম চর্বিযুক্ত খাবার ও সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার কমালেও রক্তে এলডিএল কোলেস্টেরল বা খারাপ কোলেস্টেরল তেমন নাও কমতে পারে। অধিক চর্বিযুক্ত বা খুবই কম চর্বিযুক্ত খাবার কোনোটাই তেমন ভালো নয়, তাই মধ্য পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
রক্তনালির ব্লক দূর করার জন্য খাবারের তেমন ভূমিকা নেই। রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি থাকলে যদিও ব্লক হওয়ার ঝুঁকি বেশি তথাপি খাবারে চর্বির পরিমাণ রক্তের চর্বির মাত্রাকে মাত্র ১০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি ৯০ শতাংশ চর্বি শরীরে লিভারে ও অন্য অঙ্গে বেশি পরিমাণ তৈরি হয় ফলে রক্তে চর্বির মাত্রা বাড়ে। এ কারণে ব্লকের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে খাবারের চর্বির মাত্রার চেয়ে ওষুধের ভূমিকাও আছে।
* চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া কি একদম নিষেধ
চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া উচিত। বিশেষ করে সম্পৃক্ত চর্বি যা সাধারণত প্রাণিজজাতীয় খাবারে বেশি থাকে, তা ছাড়া উদ্ভিদ জাত বিশেষ করে পাম তেল ও নারিকেল তেল বর্জনীয় কারণ এতে বেশি পরিমাণে সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। কিন্তু মাছের তেল বিশেষত সামুদ্রিক মাছের তেল ও উদ্ভিজ তেল যেমন সানফ্লাওয়ার ওয়েল, স্যাপাওয়ার ওয়েল, সংবিলা ওয়েলে প্রচুর পরিমাণে অসম্পৃক্ত চর্বি থাকে। ফলে এতে ওমেগা-৩ ফ্যাট এসিড বেশি থাকে যা হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। তাই তেল বা চর্বিযুক্ত খাবার পুরোপুরি বাদ দেওয়া ঠিক নয়। কিছু ভিটামিন যেমন এ, ডি, ই, কে শুধু চর্বির মাধ্যমেই শরীরে প্রবেশ করে। ফলে একদম তেল ছাড়া বা চর্বি ছাড়া খাবার খেলে শরীরে ওইসব ভিটামিনের অভাব দেখা দেয় ও জটিলতা বাড়ে। জটিলতা হিসাবে রাতকানা রোগ, অস্টিওপোরেসিস ও হাড়ে ক্যালসিয়াম কমে হাড় দুর্বল হওয়া ও সহজে ভেঙে পড়া, যৌন দুর্বলতাসহ ত্বকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। খাবারে চর্বি ও তেল সম্পূর্ণ বন্ধ করলে খাবারের স্বাদ কমে যায়, খাবারের পরিমাণ কম গ্রহণ করলে অপুষ্টি দেখা দেয় তখন অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাবারের উপাদানের অভাব হতে পারে।