Logo
Logo
×

লাইফ স্টাইল

নাফাখুম রোমাঞ্চ : শেষ পর্ব

পাহাড়ের আনন্দাশ্রু নাফাখুম, জল-পাথুরে রেমাক্রি ও সর্বসুন্দরী তিন্দু

Icon

শাহনেওয়াজ খান

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১০:২৮ পিএম

পাহাড়ের আনন্দাশ্রু নাফাখুম, জল-পাথুরে রেমাক্রি ও সর্বসুন্দরী তিন্দু

ভোরের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আশা জাগাচ্ছিল। খানিকবাদে সব শঙ্কা দূর করে বৃষ্টি উধাও। ওদিকে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস থাকলেও ঝড়ো হাওয়া বা ভারী বৃষ্টি না থাকায় বিপদসংকেতও ঢিলেঢালা করা হয়েছে। খুশিতে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে ভ্রমণের মূল আকর্ষণ নাফাখুম জলপ্রপাতের পথে বেরুলাম। কাঁদাময় রাস্তায় দু-তিনটা পাহাড় পেরুনোর পর ঝিরিপথের দেখা। নাফাখুম পৌঁছার আগে আর কোনো পাহাড় ডিঙাতে হবে না। ঝিরিপথ ধরে হেঁটে গেলেই জলপ্রপাত। এই ঝিরি রেমাক্রি খালেরই একটা অংশ, যার পানি গিয়ে আছড়ে পড়ছে নাফাখুমে।

ঝিরিপথে নামতেই মন ও শরীরে যেন প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। চারদিকে সবুজ অরণ্যে ঢাকা বিশাল বিশাল পাহাড়, মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা শান্ত ঠান্ডা পানির ঝিরি। অল্প পানিতে পা ভেজানোর সাথে সাথে হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। সুন্দর এই সকালটা সবাইকে চনমনে করে দিলো। মনে হচ্ছে, সফরের তিনদিনে এসে পাহাড়ি সৌন্দর্যকে নতুন করে আবিষ্কার করছি। শরীর-মন-চোখ একসঙ্গে সবই যেন প্রশান্তি লাভ করছে। দুদিন কষ্টমিশ্রিত সৌন্দর্য দেখানোর পর আজ যেন শুধু সৌন্দর্য আর শ্রান্তিদায়ক রূপ মেলে ধরেছে প্রকৃতি। আল্লাহর দয়ায় আকাশও সহায় হলো। থামিয়ে দিয়েছে বৃষ্টি। প্রকৃতি আপন করে নেওয়ায় এই সফরে প্রথমবারের মতো থেমে থেমে, হেসে-খেলে চলছি।

দুই পাশে পাহাড়, মাঝে ঝিরি—অপূর্ব এই পথ ধরে হাঁটতে হয় ঘণ্টা দুয়েক। ঝিরির পাশে ও তলদেশে রয়েছে অজস্র ছোট-বড় পাথর। পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা ঝিরিতে চাইলে গা ডুবিয়েও নেওয়া যায়। পাথরের উপরে বসে প্রবহমান পানিতে পা এলিয়ে দেওয়া বা শুয়ে থাকার স্বাদ না নিলেই নয়। এখানে এসে মনে পড়বে সিলেটের বিছানাকান্দিকে। এ যেন পাহাড়ের বুকে আরেক বিছানাকান্দি! জায়গায় জায়গায় দেখা মিলছে ঝরনার। মূলত বৃষ্টির কারণে পাহাড় থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে সৃষ্টি করেছে এসব ঝরনার। পরিষ্কার ও সুমিষ্ট এই পানি তেষ্টা মেটায় পথিকের। স্থানীয়রাও ব্যবহার করে এই পানি। এসব ঝরনার কারণেই এই পথে পানি না নিয়ে শুধু বোতল সাথে রাখলেই চলে। কিছুদূর পরপরই পড়বে ঝরনা, সংগ্রহ করা যায় সুপেয় পানি।

খানিকবাদে হঠাৎ তুলনামূলক বেশি পানির ঝিরিতে এসে পড়লাম। আরেকটু হাঁটতেই পানি ঝরে পড়ার শব্দ। যত কাছে যাচ্ছি শব্দ তত বাড়ছে। কাছাকাছি যেতে অন্য কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না। এমনকি পাশের কাউকে কিছু বললেও কাছে গিয়ে জোরে জোরে বলতে হচ্ছে। পাশ ফিরতেই দেখা নাফাখুমের! প্রায় ৩০ ফুট উঁচু থেকে প্রচণ্ড বেগে ঝরে পড়া এই জলপ্রপাতকে কেউ কেউ কেন বাংলার নায়াগ্রা বলে তার যথার্থতা পেলাম এখানে এসে। সত্যিই এ যেন আরেক নায়াগ্রা ফলস! বেগবান এই জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে উড়ে গেলো তিনদিনের সব ক্লান্তি। সৌন্দর্যে বিমোহিত চোখ যেন সরতে চাচ্ছে না। শুধু দেখার জন্যই কিছুক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম! পাহাড় যেন তার সব খুশি বিলিয়ে দিচ্ছে এই অশ্রুর মধ্য দিয়ে! আমাদের কাছে যা অপরূপ সুন্দরী নাফাখুম। সাধারণ এক ঝিরিই যেন অসাধারণ হয়ে ধরা দিচ্ছে এখানে। কয়েক ফুট উচ্চতা আর আঁকাবাঁকা পাথরই সৃষ্টি করছে নতুন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের! 

ঝরে পড়া পানিতে রৌদ্রের আলোয় তৈরি হয় রং-বেরংয়ের খেলা। প্রচুর পানি ঝরে পড়ায় নিচে তৈরি হয়েছে বিশাল খাদ। তাই এখানে ঝরনার নিচে গোসল করা যায় না। সাঁতরাতে চাইলে নামতে হয় ঝরনার কিছুটা দূরে গিয়ে। প্রথমে জলপ্রপাতের উপরের অংশে গিয়ে বসলাম। ঝরনার পানি ছিটকে আসছে। এরপর সাহস করে আরেকটু কাছে, ঠিক জলপ্রপাতের পানি ঝরে পড়ার স্থানে গিয়ে বসলাম। পাথরের উপর বসে এক মুহূর্তও বেখেয়াল হওয়ার উপায় নেই। একটু এদিক-সেদিক হলেই পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে পড়ব ঝরনার খাদে। সৌন্দর্যের সঙ্গে পদে পদে বিপদ—একেই বুঝি বলে ভয়ঙ্কর সুন্দর।

জলপ্রপাতের পাশের পাহাড়েই স্থানীয়দের ঘরে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে খানিকটা ঘুরে চলে আসলাম নাফাখুমের কাছে। আসলে মন এখানেই থাকতে চাইছে, ঝরনা যেন টেনে নিয়ে আসছে। এরই মাঝে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। তাই ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় কাটানোর সাহস হলো না। কারণ, রেমাক্রি হয়ে আজই ফিরতে হবে। বিকালের আগে থানচি পৌঁছাতে না পারলে হারাতে হবে চাঁন্দের গাড়ি, ঢাকাগামী বাস—সব। সুখস্মৃতি সঙ্গে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম রেমাক্রি বাজারের উদ্দেশে। ছোট ছোট পাহাড় ও ঝিরিপথ পেরিয়ে যাচ্ছি। ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে নাফাখুমের শব্দ। ঝিরিপথের কোথাও কোথাও পানি অনেক বেশি, নিচে পাথর। বৃষ্টির কারণে স্রোত ক্রমশ বাড়ছে। কোথাও পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ছে পানিতে। হাঁটতে হচ্ছে খুবই সাবধানে, একটু এদিক-সেদিক হলেই বিপদ। কেউ কেউ পড়ে ব্যথা পেয়েছেন। পাথরে লেগে কারও কারও হাত-পা কিছুটা কেটে গেছে। আমিও একবার পানির স্রোতের কারণে ঠিকমতো পাথরের উপর পা ফেলতে না পেরে পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। পেছনে থাকা অপর এক পর্যটক ধরে ফেলায় রক্ষা।

যতই সামনে যাচ্ছি, ততই বড় বড় পাহাড় কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছে। ঝিরির পাশে তুলনামূলক নিচু এলাকা চোখে পড়ছে। গবাদি পশু, জুমচাষের দেখাও মিলছে। বুঝতে পারছি, এদিকে জনবসতি বেশ। দূর থেকেই দেখা মিললো রেমাক্রি বাজারের। সুন্দর দিনের ধারা বজায় রেখে প্রকৃতি তার আরেক সৌন্দর্যকে মেলে ধরলো। বিশাল এলাকাজুড়ে সারি সারি পাথর বিছিয়ে আছে, উপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বয়ে যাচ্ছি পানি। আছড়ে পড়ছে নদীর বুকে। এখানেই মিলেছে রেমাক্রি খাল ও সাঙ্গু নদী। নদী ও খালের এই মিলনস্থলে গোসল না করলে যেন ভ্রমণই অপূর্ণ থেকে যাবে! পাথরে গা এলিয়ে শুয়ে পড়তেই উপর দিয়ে বয়ে যায় পানি। এ এক অপূর্ব অনুভূতি! মনে হচ্ছিল কয়েক ঘণ্টা এভাবে শুয়ে থাকি। কিন্তু ফেরার তাড়নায় মাত্র আধ ঘণ্টায় সারতে হলো গোসল। পাথরের উপর বসে থাকা পর্যটকের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। বেশ খানিক দূরে পাথরের উপর বসে গা ভেজানোর যুতসই জায়গাও মিললো। যেকোনো জায়গায় বসে পড়লে স্রোতে ভেসে যাওয়ার শঙ্কা আছে।

রেমাক্রি-সাঙ্গুর মোহনায় পাহাড়ের উপর পর্যটকদের থাকার জায়গা রয়েছে। এখান থেকে পাহাড়, নদী ও খালের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এখানেই রয়েছে ছোট-বড় নানা ট্রলার, যেগুলো যায় থানচি সদর পর্যন্ত। গোসল শেষে আমাদের জন্য ভাড়া করে রাখা ট্রলারে উঠলাম। নাফাখুম থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা হেঁটে রেমাক্রি পৌঁছার পর ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। কিন্তু ফেরার তাড়নায় সিদ্ধান্ত হলো থানচি গিয়ে খাব। ক্ষুধা নিয়ে শুরু হলো ট্রলার ভ্রমণ। সাঙ্গু নদী দিয়ে তিন্দু হয়ে পৌঁছাব থানচি সদর। এই সেই তিন্দু যার কথা শুনে আসছি বহুদিন ধরে।

আবারও পাথুরে নদী উপর দিয়ে বয়ে চলা। এবার ভিন্ন পথ, ভিন্ন আবহ। দুই পাশে বিশাল বিশাল পাহাড়, মাঝে ছুটে চলছে ট্রলার। মনে হচ্ছে, পাহাড়গুলো চিড়ে আলাদা করে পথ তৈরি করেছে সাঙ্গু। আর সাঙ্গুর বুক চিড়ে চলছি আমরা। কোথাও কোথাও নদীর দুই পাড়ে বিছিয়ে আছে অজস্র সাদা পাথর। ঠিক সিলেটের ভোলাগঞ্জের মতো। কোথাও বড় বড় পাথর। পাথরগুলো প্রায়ই পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে। তাদের ফাঁক দিয়ে কোনো রকমে পথ করে যেতে হচ্ছে। কোথাও ইঞ্জিন থামিয়ে দাঁড় বেয়ে, কোথাও বাঁশ দিয়ে ঠেলে, কিংবা হাত দিয়ে পাথরে ধাক্কা মেরে। যেন পাথরকে কুর্নিশ করে যাওয়া। স্থানীয়দের ভাষায়, রাজাপাথরকে কুর্নিশ না করে গেলে সে রাগে পথ আগলে দাঁড়ায়! এজন্য এলাকাটিও স্থানীয়ভাবে ‘বড় পাথর/রাজা পাথর’ নামে পরিচিত।

পাহাড়গুলো যেন ক্রমশ বড় হচ্ছে। যত এগোচ্ছি ততই বিশালাকার পাহাড়। ঘন অরণ্যে ঘেরা এসব পাহাড়ে জনবসতি নেই বললেই চলে। শুধু পাখ-পাখালির কলতান ও বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়। পরম নিশ্চিন্তে পাহাড়ের বুকে আশ্রয় নিয়েছে মেঘমালাও। এই অপূর্ব দৃশ্য শুধু দেখেই উপভোগ করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। কেন তিন্দুকে অনেকে পাহাড়ের রাজধানী বলে ডাকেন তা এই পথে যেতে যেতে বুঝা গেল। সত্যিই সর্বসুন্দরী তিন্দু। কি নেই এখানে? পাহাড়, অরণ্য, নদী, খাল, পাথর, ঝরনা—পাহাড়ি সব বৈশিষ্ট্যের সমাহার। শুধু থানচি সদর থেকে রেমাক্রি বাজার পর্যন্ত তিন্দু হয়ে এই নৌ-ভ্রমণের জন্যেই এখানে আসা যায়। কোনো প্রকৃতিপ্রেমীই এখানে নিরাশ হবেন না।

সৌন্দর্যে চোখ আটকে থাকলেও সময় তো আটকে থাকে না। বিমোহিত নয়নে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম থানচি বাজারের কাছে চলে এসেছি। ট্রলার থেকে নেমে শরীর ধোয়ামোছা ও নামাজ শেষে স্থানীয় রেস্টুরেন্টে খেয়ে চাঁন্দের গাড়িতে (জিপ) উঠলাম। বিকালে শুরু হলো বান্দরবান সদরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। আবারও সেই উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ। এবার অবশ্য মেঘের খেলা দেখার সৌভাগ্য হলো না। মিনিট বিশেক যেতেই শুরু হলো বৃষ্টি। ক্রমশ তা বাড়তে লাগলো। একেবারে ঝড়ো বৃষ্টিতে রূপ নিলো। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোই দায় হয়ে যাচ্ছে। খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছে। গাড়িচালক বললেন, আপনাদের ভাগ্য ভালো ওই সময়ে বের হয়েছিলেন। নইলে এই বিকালে বৃষ্টি শুরুর পর আর কোনো গাড়ি এই পথে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না। যেসব গাড়ি এখনও থানচি রয়েছে সেগুলো ফিরবে কালকে। চালকের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। যাক, বান্দরবান থেকে টিকিট কেটে রাখা ঢাকাগামী বাস ধরতে পারব।

বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষ্মণই নেই। বুঝলাম, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল তার নিজস্ব রূপে পৌঁছেছে পাহাড়ে। তবে প্রলয়ঙ্কারী রূপ নেওয়ার আগেই কিছুটা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় রক্ষা। শুধু প্রবল বৃষ্টিকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কিছু জায়গায় পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ায় ভয় পিছু ছাড়ছিল না। চলতে চলতে রাত ৮টা নাগাদ বান্দরবান সদরে এসে পৌঁছলাম। অবশেষে কিছুটা স্বস্তি। রাতের খাবারের পর বাসে উঠার পালা। বৃষ্টি তখনও কমেনি। একনাগাড়ে ঝরেই চলছে। ভিজেই বাসে উঠলাম। কিছুদূর আসার পর থেমে গেল বাস। বৃষ্টিতে সড়কের উপর বড় গাছ পড়ে আছে। তাই রাস্তা বন্ধ। এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর সরানো সম্ভব হলো গাছ। এবার গাড়ি ছাড়লো। পথে আর কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না জানি না। কারণ, গাড়ি চলতে শুরু করার খানিক পরই ক্লান্ত শরীর ঘুমের মাঝে খুঁজে নেয় বিশ্রাম। চলছে গাড়ি, তার সাথে যাচ্ছে শরীর; মন পড়ে আছে সেই পাহাড়-ঝরনায়। (শেষ)
লেখক : সাবেক গণমাধ্যমকর্মী

 

নাফাখুম রোমাঞ্চ : পর্ব-১: সম্ভব-অসম্ভবের বাঁকে সৌন্দর্যের লুকোচুরি

নাফাখুম রোমাঞ্চ: পর্ব-২: বুনো পাহাড়ে রাতের যাত্রী

নাফাখুম রোমাঞ্চ : পর্ব-৩: ঝরনার আফসোস নিয়ে মেঘের কোলে ঘুম

নাফাকুম

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম