
কেয়া বা কেতকী ফুল তার সুগন্ধের জন্যই প্রাচীনকাল থেকে সুবিদিত
'কেয়া ফুল' নামে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর একটি সুখপাঠ্য কবিতা আছে। কবিতাটিতে আছে বর্ষার কথা, আছে কেয়া ফুলের কথা, আর আছে জীবনের কথা। কবিতাটির কয়েকটি চরণ তুলে ধরছি-
" শূন্য ঘরে
হিয়া গুমরিয়া মরে
স্মরি' যত জীবনের ভুল;
অকস্মাৎ তারি মাঝে
ধ্বনি কার কানে বাজে...
চাই ফুল...চাই কেয়া ফুল!"
কেয়া ফুলকে আমরা পাই কালিদাসের মেঘদূতেও। মেঘদূতের ২৪ নম্বর শ্লোকে আছে...
পাণ্ডুচ্ছায়োপবনবৃতয়ঃ কেতকৈঃ সুচিভিন্নৈঃ-
নীড়ারম্ভৈর্গৃহবলিভুজামাকুল্গ্রামচৈত্যাঃ।
বাংলার যে কবি ঋতু বন্দনায় বারবার বাংলার ফুলকে স্তবকে স্তবকে সাজিয়েছেন সেই আমাদের অস্তিত্বের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'নববর্ষা' কবিতায় বর্ষা বন্দনায় বলেছেন-
" রাশি রাশি তুলি শৈবাল দল
ভরিয়া লয়েছে লোল অঞ্চল
বাদলরাগিনী সজল নয়নে গাহিছে পরানহরণী
বিকচ কেতকী তটভূমি পরে, বেঁধেছে তরুণ তরুণী।।"
বর্ষার ফুল কেয়া। সংস্কৃতিতে যার নাম কেতকি, হিন্দিতে কেওড়া, ইংরেজি নাম scrwe pine. বৈজ্ঞানিক নাম Pandanus Fascicularis. এটি Pandanus গণের উদ্ভিদ। কেয়া গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। লম্বায় ৩-৪ মিটার হয়ে থাকে। কাণ্ড গোলাকার ও কাটাযুক্ত। কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়ে ঝোপালো হয়ে যায়। পাতাও লম্বায় ৩ থেকে ৪ মিটার লম্বা, চওড়া ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার। জৈষ্ঠ্যমাসের শেষের দিকে ফুটতে শুরু করে আষাঢ় -শ্রাবণ মাসজুড়ে কেয়া ফুল ফোটে।
নোনাপানির ধারঘেঁষে শ্বাসমূলে ঠেস দিয়ে যুথবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কেয়া গাছ। সেন্টমার্টিন, সুন্দরবনে দেখা মেলে কেয়াবনের। নোনাজল না পেলেও ক্ষতি নেই, নদীনালা খালবিলের জলকাদায়ও নিজেকে মানিয়ে নেয় বেশ।
ছোটবেলায় বসন্তকালে জলবসন্ত যখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়তো, ঘরের বাইরে যাওয়া মানা, জলবসন্তের গুটিগুলো যখন শুকিয়ে আসতো আর কুচকুচ করে গা চুলকাত তখন কেয়ার পাতার খোঁজ পড়তো। করাতের মতো কাঁটাযুক্ত কেয়াপাতার প্রান্তের কাঁটা দিয়ে জলবসন্তের গুটি থেকে পানি ও পুঁজ ছাড়িয়ে দিত বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ। কেয়া পাতা বেটে লাগিয়ে দিত গায়। খোসপাঁচড়া সাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে গাছটির। এছাড়াও রয়েছে নানা ঔষধি গুণ।
তবে কেয়া বা কেতকী ফুল তার সুগন্ধের জন্যই প্রাচীনকাল থেকে সুবিদিত। কেয়া যেমন সাহিত্যপ্রেমীদের প্রিয়তা পেয়েছে তেমনি ভোজনরসিকদের রসনাবিলাসে রেখেছে ভূমিকা। কেওড়ার জল ছাড়া বিরিয়ানি, পোলাওটা যেমন ঠিক জমে না, ঠিক তেমনি কেক, মিষ্টি, পায়েস রান্নায়ও কেওড়ার এসেন্স নিয়ে আসে ভিন্নমাত্রা।
কেয়া ফুল থেকে তৈরি সুগন্ধী কেওড়া তেল মাথার খুশকি দূর করে। বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় কেয়াফুল থেকেই বানানো হয় কেওড়া জল।
ঢাকা শহরে সেভাবে আর চোখে পড়ে না কেয়া বা কেতকী ফুলের গাছ। বলধা গার্ডেনে আছে বলে শুনেছি। ভাবছি এই বর্ষায় একদিন আমি যাবোই যাব কেওড়া দর্শনে। কেউ কি আমার সঙ্গী হবে! যদি নামে তখন মধুর বৃষ্টি, যদি সেদিন বলধা গার্ডেনের ভেজা বাতাস হয় কেয়ার গন্ধে মাতোয়ারা! তবে বেশ হয়।
কেয়া একলিঙ্গিক গাছ। অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ গাছ স্বতন্ত্র। স্ত্রী গাছে ফোটে স্ত্রীফুল এবং পুরুষ গাছে ফোটে পুরুষ ফুল। পুরুষ ফুল শাদা রঙের যার নাম সিতি কেয়া বা শ্বেত কেয়া, তীব্র সুগন্ধযুক্ত ফুল। আর স্ত্রী ফুল সোনা রঙা, যার নাম স্বর্ণ কেয়া বা হেম কেয়া। স্ত্রী ফুল থেকে আনারসের মতো ফল হয়, যা অনেকে খেয়ে থাকেন।
দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদী বা সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠে কেয়াবন; যা মাটির ক্ষয়রোধ করে এবং ঝড়ঝাপটা থেকে উপকূলের জনপদকে সুরক্ষা দেয়া চেষ্টা করে। শৌখিন বৃক্ষপ্রেমীরা বাগানে ও টবেও কেয়াগাছ লাগাতে পারেন। বর্ষায় মিলবে কেয়া ফুলের উগ্র-মিষ্টি সুগন্ধ আর সারাবছর পাওয়া যাবে সুদৃশ্য পাতা।