
গ্রাম-বাংলার চিরচেনা অপ্রচলিত একটি ফলের নাম লুকলুকি। কেউ বলেন টিপ ফল। ফলটি স্বাদের দিক দিয়ে বৈঁচির মতো, টক মিষ্টি। বাড়ির কাছাকাছি সোনারগাঁয়ের আমিনপুর তসিল অফিস। এর সীমানায় ছিল বৈঁচি গাছ। তাতে আঘাত পেলেও পাকা ফল বৈঁচি খেয়েছি।
লুকলুকিও বৈঁচির মতো। আর অঞ্চল বিশেষে অন্য নামও আছে- টিপফল, টিপটিপানি, টিপাটিপি, লুকলুকি, পেলাগোটা, প্যালা, পায়েলা, ঝিটকি, পলাগোটা, টরফই, পাইন্যাগুলা, বেহুই, পানিয়ালা, পানি আমলা, পাইন্না, ইত্যাদি নামে চীনে ও জানে।
লুকলুকির বৈজ্ঞানিক নাম : ফ্লাকোর্টইয়া ক্যাটাফরাসিটা (Flacourtia cataphracta), এর ইংরেজি নাম : ইন্ডিয়ান প্লাম (Indian plum) এটি নিচুভূমি এবং পাহাড়ি এলাকার বৃষ্টিবহুল অঞ্চলের ‘উইলো’ পরিবারভুক্ত একটি বৃক্ষ।
এটি দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়াতে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। অনেক অঞ্চলে এটি চাষ এমনিতেই মুক্তভাবে জন্মে থাকে। এর প্রকৃত আদি নিবাস জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এশিয়ার ক্রান্তীয় অঞ্চল বা ভারতবর্ষের এর উৎপত্তি। পাহাড়ে ও টিলায় এ ফলের গাছ ভালো জন্মে। বেশি আছে সিলেট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান। এ ফলের গাছ বসতবাড়িতে এবং মাঝেমধ্যে গাঁও গ্রামের বন- বাদাড়েও দেখা যায়। গাছটি নিতান্তই দুর্লভ।
লুকলুকি গুল্ম জাতীয় এক ধরনের বৃক্ষ। লুকলুকি গাছের কাঁটার সঙ্গে অন্য গাছের কাঁটা মেলে না। কাঁটাগুলো আবার শাখায়িত গোছ ধরা। গাছ ছোট অবস্থায় গাছের নিচে দিকে বেশি কাঁটা দেখা যায়, বড় হলে মূল কাণ্ডের কাঁটা কমে যায়।
ডালপালাতেও কাঁটা থাকে। পাতা একক, ডিম্বাকৃতি, কিছুটা লম্বাটে। অগ্রভাগ সুচালো। সবুজ রংয়ের পাতা কিছুটা ঢেউ খেলানো থাকে। পাতা ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বাটে হয়। পাতার কিনারায় সামান্য খাঁজ কাঁটা থাকে। এর উচ্চতা ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার। আবার ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছে মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে। এর ফুল ছোট, সাদাটে সবুজ থেকে বেগুনি এবং সুগন্ধী। ফুল ফোটে গুচ্ছাকারে। ফল গোলাকার মার্বেলের মতো, খোসা পাতলা ও মসৃণ। কাঁচা অবস্থায় সবুজ। কাঁচা ফলও খাওয়া যায়। কাঁচা কষ্টি কষ্টি অ-স্বাদ। ফল পাকে জুলাই-আগস্ট মাসে। ফল পাকলে লালচে বেগুনি রঙের হয়। পাকা ফলের ভেতরটা বাদামি বা কালচে গোলাপি রং ধারণ করে। টিপাফল পাকার পরে টিপে নরম করে খেতে দারুণ মজা। এ কারণে টিপ ফল নামকরণ হয়েছে। আচার বা শরবত করেও এটি খাওয়া যায়।
কাঠের জন্যও এ গাছ চাষ করা হয়। ‘কুইন্সল্যান্ড ফ্রুট ফ্লাই’ নামক এক ধরনের মাছির আবাস স্থল হিসেবে এ গাছের পরিচিতি রয়েছে। একদিকে ফলের কদর আরেকদিকে রয়েছে ওষুধিগুণ। তা উদ্ভিদ বিজ্ঞান থেকে জানা যায়- হজম শক্তি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি এতে আছে। তাছাড়া এ গাছের শুকনো পাতায় ব্রংকাইটিস রোগে বিশেষ অবদান রাখে। এ গাছের মূল দাঁতের ব্যথায় দ্রুত কার্যকর ভূমিকা রাখে।
অপ্রচলিত এ ফলটি চাষাবাদ করা গেলে একদিকে এদেশের চাহিদা আরেকদিকে ভীনদেশে রফতানি করে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা যেতে পারে। পরিবেশ বাঁচাই, নানা রকম গাছ লাগাই, প্রাণেও বাঁচি- এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।