শৈল হাসে রঙিন সাজে। ছবি সংগৃহীত
শৈলে তখন শীলাবৃষ্টি, আমরা সবেমাত্র পাহাড়ি সিঁড়িপথ পাড়ি দিয়ে চূড়ায় পৌঁছলাম। সামনেই দৃষ্টি পড়ল একটি ছোট গুহার, যার চারপাশে শুধু ধূসর মাটি আর মাটি। তবে ওপরে রয়েছে কৃত্রিম ইটের ছাদ। বৃষ্টি পড়ছে বাল্যমেয়ের নূপুর তানে, আর আশপাশে শীলা পড়ে পড়ে স্তূপাকার হয়ে গেছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানি।
বৃষ্টির অজস্র স্রোতোধারা হ্রদয়কে স্পর্শ করে গেল। আমাদেরকে আনন্দ ভুবনে মাতিয়ে নেওয়ার জন্যই যেন প্রকৃতি এমনভাবে সেজেছে। এলোমেলো হাওয়ার টানে রজার্সের সুতোকায় দেহ ঢলে পড়ছে। পাহাড়ি গাছগুলো তার গায়ের জামার রঙে কী ম্যাচিং করে সেজে গেছে।
এরপর বৃষ্টির তালে তালে তার কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত, পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন জেগে উঠে রীতিমতো ইউটিউবে ভাইরাল হতে সময় লাগল মাত্র কয়েক দিন।
কিছুক্ষণ পূর্বে শৈল সিঁড়ি পাড়ি দেওয়ার সময় এক বিশাল রঙিন হাট দৃষ্টিগোচর হলো। প্রতিটি গিরিপথে বাঁশ-টিনের অনেক ছোট ছোট দোকান স্তরে স্তরে সাজানো, সবগুলো দোকানদারই তরুণী, অথবা সদ্য বয়ঃসন্ধিকাল পেরোনো কিশোরী কেউবা মাঝবয়সী।
এদের মুখের ভাষা বাংলা নয়, এরা আদিকাল থেকে বাংলা ভূখণ্ডের বাসিন্দা, গায়ের জামায় ঐতিহ্যের ছাপ; শত নয়, হাজার বছরের ঐতিহ্যই বলতে হবে। খোঁপার ধরনও আলাদা। এ হাট পোশাকের হাট, ঐতিহ্যের হাট, একবিংশ শতকের প্রায় তৃতীয় দশকে যে এখনো স্বল্প মূল্যে গায়ের চাদর, পরনের জামা, বিছানা ছাদর ক্রয় করা যায় তার বাস্তব স্বাক্ষর এ হাট।
এ পোশাকগুলো বাহারি রঙের, স্তরে স্তরে নকশা আঁকা ও খাঁজকাটা, এ যেন সোনালি কন্যার হাতে সোনার হস্তশিল্প। কী অভাবনীয় এদের উদ্ভাবন, কত সুন্দর কারুকার্য! পুরো পোশাকেই অবুঝ মেয়ের সরল হাসি!
এ হাট হিন্দু-মুসলিম ও বৌদ্ধদের মিলনমেলা। এ হাটের আশপাশেই এসব আদিবাসীর বসবাস। কৃষি আর হস্তশিল্পই তাদের জীবিকা। জাতিতে তারা রাখাইন, ত্রিপিটকের অনুসারী। খাদ্যাভ্যাসে এখনো আধুনিকতার ছাপ পড়েনি, ফলে এখনো তারা ক্ষীণকায়।
তারা হাজার বছর ধরে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রেখেছে, কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে তাদের ঐতিহ্য আর কত দিন টিকবে? ওদের ঐতিহ্যে আমরা পুলকিত, তাদের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ।
পাহারের ওপরে অবস্থিত মন্দিরখানা হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বিখ্যাত প্রার্থনা গৃহ, তার নাম আদিনাথ মন্দির। মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা ইউনিয়নের ঠাকুরতলা গ্রামে অবস্থিত এই শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ বিশাল মেলা বসে।
মেলায় সারা দেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করে, এই পাহাড়ের পাদদেশে তখন বিশাল উৎসবের আমেজ পড়ে যায়।
উৎসবের ভিক্ষু বাঙালির আনন্দ ভুবনের রঙিন তারকা হয়ে আবির্ভূত হয় এ অনুষ্ঠান।
এলাকাবাসীর মনে এ সময় সাজ-সাজ, রব-রব পড়ে যায়। আদিনাথের অপর নাম মহেশ, আর এই মহেশের নামানুসারে মহেশখালী উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। আর এ পাহাড়ের নাম মৈনক পাহাড়। প্রায় ৬৯ টি সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে এ পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হয়। আমরা সিঁড়িগুলো পাড়ি দিয়ে একেবারে চূড়ায় পৌঁছে গেলাম।
তারপর ঝটপট এ প্রার্থনা গৃহখানি পরিদর্শন করলাম। পাহাড়ের চূড়ায় কয়েকটি টিলা রয়েছে। আছে অনেক ছোটবড় গাছ। মুহূর্তেই সূর্য মধ্য গগনে বসে হাসতে শুরু করে দিল।
ঘুমোট হয়ে আসা মুষলধারে বৃষ্টি নিমিষেই বাঁশখালি নদী পার হয়ে গেল। আমাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল। সৌর রশ্মির সঙ্গে সঙ্গে সবাই হাসতে শুরু করে দিল।
পাঁচ বছরের শিশুকন্যা জারিয়া, ওর নিষ্কলুশ হাসি সবাইকে মোহগ্রস্ত করে রাখল। চতুর্দিকে আবার জীবনের প্রাণ ফিরে এল। কিচিরমিচির শব্দে বন্য পাখিরা বাঁশখালি নদীর এপার থেকে ওপারে রেস দিতে লাগল। মৈনক পাহাড় তার আপন সৌন্দর্যে প্রস্ফুটিত হলো।
পাহাড়ের ওপর থেকে দৃশ্যমান সমতল ভূমির গাছগুলোর মস্তকসমূহের মিলন যেন বিশালাকার সবুজ শামিয়ানা, যার ভেতরে লুকায়িত বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা।