Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তিন শিক্ষার্থী হত্যা

হাসিনাসহ ২৯ জনের নামে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাসিনাসহ ২৯ জনের নামে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

লক্ষ্মীপুর ও যাত্রাবাড়ীতে গণহত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি পৃথক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় নাগরিক কমিটির তত্ত্বাবধানে ও আইনি সহায়তায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দাখিল করেছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত দুই শিক্ষার্থীর বাবা।

একটি অভিযোগে আসামি হিসাবে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাত আসামি পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১০০ থেকে ১৫০ সদস্য। আরেকটি অভিযোগে আসামি হিসাবে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। একটিতে ১ নম্বর আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরেকটিতে ১ নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

এছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফকে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরেকটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। বৃহস্পতিবার চিফ প্রসিকিউটর বরাবরে আহনাফের মা জারতাজ পারভীন সাফাক এ অভিযোগ দায়ের করেন।

লক্ষ্মীপুর ও যাত্রাবাড়ীতে গণহত্যা : বৃহস্পতিবার দুপুরে নাগরিক কমিটির তত্ত্বাবধান ও আইনি সহায়তায় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দুটি দাখিল করা হয়। পরে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে অভিযোগ দায়েরকারী দুই বাবা ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নাগরিক কমিটির প্রাথমিক কাজ হিসাবে ঘোষিত আট দফা কর্মসূচির দ্বিতীয় দফা ছিল ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নেওয়া।

এর বাস্তবায়নের জন্য নাগরিক কমিটি ছাত্র-নাগরিকের অভ্যুত্থানে শহিদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে। ছাত্র-নাগরিকের অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের শিকার দুজনের পরিবার আজ নাগরিক কমিটির মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করেছে। এই দুই পরিবারকে অভিযোগ দায়ের প্রক্রিয়ায় আইনি সহায়তা করেছে নাগরিক কমিটি।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে গত ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীর কাজলা পেট্রোল পাম্পের পাশের পকেট ফটকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের গুলিতে নিহত হন দনিয়া কলেজের বিএ (পাস) কোর্সের শিক্ষার্থী সাকিব হাসান।

আর গত ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর তেমুহনি এলাকায় গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ওসমান পাটওয়ারী ওরফে ওসমান গণি। এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আজ নাগরিক কমিটির তত্ত্বাবধানে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়।

আসামিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর ৩ (২) (এ), ৩ (২) (গ), ৩ (২) (এইচ), ৪ (১) ও ৪ (২) ধারা অনুযায়ী গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। সাকিব হাসানের বাবা মো. মর্তুজা আলম ও ওসমান গণির বাবা মো. আবদুর রহমান পৃথকভাবে অভিযোগ দুটি দায়ের করেছেন। যেসব শহিদের পরিবার এখনো আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়নি কিংবা বিভিন্ন কারণে অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি, তাদের ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দাখিল করতে আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক কমিটি।

আখতার হোসেন বলেন, তারা মামলার তদন্তের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবেন। বিচার শুরু হওয়ার পর আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে শহিদ পরিবারকে আইনি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন। এছাড়া এই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের পক্ষে মামলা দায়ের, পরিচালনা ও বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার মাধ্যমে সার্বিক সহযোগিতা করবেন।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন নিহত সাকিব হাসানের বাবা মর্তুজা আলম। তিনি বলেন, যে পুলিশ সদস্যরা তার ছেলেকে হত্যা করেছেন, যারা তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি সরকারের কাছে তাদের বিচার চান। অধিকার চাইতে যাওয়ায় তার ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান।

নিহত ওসমান গণির বাবা আবদুর রহমান বলেন, তার ছেলে (ওসমান) ৪ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে তাকে ফোন দেয়। জানায়, সে ছাত্র আন্দোলনে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। তাই ছেলেকে আন্দোলনে যেতে তিনি না করেন। ছেলে বলে, তার ছাত্র ভাইয়েরা আন্দোলনে মারা যাচ্ছে।

সে মিছিলে যাবেই। পরে তিনি ফোনেই ছেলেকে বিদায় জানান। বিকাল চারটা থেকে সাড়ে চারটার দিকে তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ফোনে তিনি খবর পান, ওসমান মারা গেছে। বাড়ি গিয়ে দেখেন, অ্যাম্বুলেন্সে ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তিনি তার ছেলে হত্যার বিচার চান। হত্যাকারী আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সর্বোচ্চ বিচার কামনা করছেন তিনি।

নিহত ওসমান গণির বাবা আবদুর রহমানের দাখিল করা অভিযোগে ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা একেএম সালাহ উদ্দিন, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া মোহাম্মদ গোলাম ফারুক, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবির, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আহাম্মদ, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাসান।

আসামি হিসাবে আরও আছেন লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল করিম, জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব, ৪ নম্বর আলাইয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান, আমান উল্লাহপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা, একই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান, যুবলীগ নেতা আবু শাহাজাহান, আরজু, লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা আনোয়ার সাদাত শিবলু, সৈয়দ এসএম বিপ্লব ও হুমায়ুন কবির।

অন্যদিকে নিহত সাকিব হাসানের বাবা মর্তুজা আলমের দাখিল করা অভিযোগে আসামি হিসাবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজ্ঞাতনামা ১০০ থেকে ১৫০ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের যেসব পরিবার এখনো আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়নি কিংবা বিভিন্ন কারণে অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি, তাদের ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করতে আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক কমিটি। এ ক্ষেত্রে তারা অভিযোগ তদন্তের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও বিচার শুরু হওয়ার পর আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আইনি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে।

ট্রাইব্যুনালে শাহীন কলেজের আহনাফের মায়ের অভিযোগ : ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে আহনাফের মা জারতাজ পারভীন সাফাক এ অভিযোগ দায়ের করেন।

এ সময় তার খালা উপস্থিত ছিলেন। আবেদনে আহনাফের মা অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। পরে আহনাফের মা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই তো সবকিছু হয়েছে। আমরা তো আর ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখন তদন্ত কর্মকর্তারা খুঁজে বের করবে কারা কারা হত্যার সঙ্গে জড়িত।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, অভিযোগে সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম বলেননি। তৎকালীন সরকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, পুলিশ বাহিনী এটা করেছে। ওনারা বলেছেন, আমরা ঘটনাস্থলে যেহেতু ছিলাম না, তাই সরকারের যারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তদন্ত করে যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, বিএএফ শাহীন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যোগাযোগ করেছেন। তাদের বলব, তারা যেন আন্দোলনে আহত, নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে তথ্য দেন। আমরা তাদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখব।

সারা দেশে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ভারতে অবস্থান করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মোট ৩২টি পৃথক অভিযোগ দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ১৪টি চিফ প্রসিকিউটর বরাবর জমা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো তদন্ত সংস্থায় দাখিল করা হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম