Logo
Logo
×

যুগান্তর বর্ষপূর্তি

সংস্কৃতি : দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়

Icon

রাজীব সরকার

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩৮ পিএম

সংস্কৃতি : দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়

প্রাবন্ধিক ও গবেষক রাজীব সরকার। ছবি: সংগৃহীত

সংস্কৃতির মধ্যে শুধু সমন্বয় নয়, দ্বন্দ্বের পূর্বাভাসও রয়েছে। একটি সংস্কৃতি দ্বারা অপর সংস্কৃতি যেমন সম্পূর্ণ বিলীন বা পরাভূত হতে পারে, তেমনই সুষম মিশ্রণের মধ্য দিয়ে সমন্বিত রূপও লাভ করতে পারে।

‘ভারতের বসন্তোৎসব’ প্রবন্ধে ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন-‘একটি ধর্ম বা সংস্কৃতি যদি হঠাৎ আসিয়া পড়ে, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীভাবেও আসে, তখন উভয় ধর্ম বা সংস্কৃতি তার নিজ নিজ উচ্চতম আদর্শ ও সত্য খুঁজিয়া বাহির করিয়া নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করিতে চায়...নিজেদের যেসব মহত্ত্ব পূর্বে নিজেরা এতকাল উপলব্ধি করে নাই, তাহাও তখন নতুন করিয়া উপলব্ধি করে এবং সেই নব উপলব্ধ মহত্ত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া নিজের শক্তিকে উন্নততর করিয়া তোলে।’

ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পটভূমি স্পষ্ট হয়। আর্যরা যখন ভারতে আসেন, তখন তারা এদেশীয় অনার্যদের চেয়ে উন্নততর সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিলেন। তারা সহজেই অনার্যদের পরাভূত করেন, তাদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি দখল করেন। কেউ কেউ জঙ্গলে নির্বাসিত হন। বহু অনার্য আর্যদের দাসে পরিণত হন। আর্যদের শক্তিশালী প্রভাব সত্ত্বেও অনার্য সংস্কৃতির বিলোপ ঘটেনি। আর্যদের প্রভাবে তখন অনার্য সংস্কৃতি বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়। এভাবে আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে গ্রিক, পার্সিয়ান, শক, হুনগণ আসার পরে। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে গ্রিক ও আর্য সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। গ্রিকরা ভারতের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। বিখ্যাত গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের লেখা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রশংসা করেছেন। পরবর্তী সময়ে হুয়েন সাঙ্গ, ফা-হিয়েনের মতো মনীষী ভারতে চীনের সাংস্কৃতিক প্রবাহ নিয়ে আসেন। এ সময় ভারতে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন ঘটেছে, ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পশ্চিম ভারতে যে পারসিক অভিযান হয়, তা মৌর্যযুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নান্দনিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ প্রভাব এমন সুদূরপ্রসারী হয়েছিল যে, পাটলিপুত্রকে পারসিক নগর বলে মনে হতো। গ্রিক, পারথিয়ান, শক ও কুষাণরা ভারতীয় শিল্পকলায় যে হেলেনীয় বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়, তা পরবর্তী সময়ে গান্ধারকলা হিসাবে বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করে। বহু বহিরাগত গোষ্ঠী ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাকট্রীয় গ্রিকরা ভাগবত ধর্ম এবং শকরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও কুষাণরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, সতীদাহের মতো সামাজিক প্রথা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল।

মধ্যযুগে সমন্বয়ধর্মী ঐতিহ্যের মূল স্রোতের সঙ্গে মুসলমানরা নিজেদের ধারাকে মিলিয়ে নেয়। সংগীত, সাহিত্য, চিত্রশিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্যের চর্চা এবং নানা উৎসব ও আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটে। হিন্দু ও তুর্কি-ইরানীয় ধারার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্য। পশ্চিম ভারতীয় তথা জৈন ঐতিহ্যের সঙ্গে মোগলশৈলীর সংমিশ্রণে তৈরি হয় রাজস্থানী চিত্রকলা। বৈদান্তিক, বৌদ্ধ ও ইসলামি চিন্তাধারার সমন্বয়ে জন্ম নেয় সুফি চিন্তাধারা। সেই সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলন প্রেম ও ভক্তির বাণী নিয়ে সম্প্রীতির আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে নানা জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে মহামিলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

ভারতবর্ষে মুসলমানরা টানা সাতশ বছর রাজত্ব করেছেন। তারা এ কালসীমার মধ্যে ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন এবং এ দেশের আবহাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যান। রোমানরা একসময় ইংল্যান্ড জয় করে তিনশ বছর শাসন করেন। তারা ইংল্যান্ডের অধিবাসীদের সঙ্গে কোনো মেলামেশা করেননি। এ দুই সংস্কৃতির মধ্যে শুধু দ্বন্দ্বই ছিল, সমন্বয় ছিল না। তাই ইংল্যান্ড থেকে রোমানদের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্মৃতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতে মুসলমান শাসকরা বিচ্ছিন্ন বিজয়ী হয়ে থাকেননি। ভারতের অধিবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছিলেন তারা। আরবের মুসলমানরা স্পেনে প্রায় সাতশ বছর রাজত্ব করেছেন। সেখানে তারা বিজয়ী ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। ফলে স্পেন থেকে মুসলিম শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্তিত্ব মুছে যায়। ভারতে আগত মুসলমানদের ছিল বিপরীত চিত্র। ভারতের অধিবাসীদের সঙ্গে তারা নিবিড়ভাবে মেলামেশা করেছেন। এভাবে তাদের নিয়ে আসা আরব সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের হিন্দু সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটে। অন্যদিকে মুসলমানরা যখন পারস্য, মিসর, ত্রিপলী, মরক্কো ও সুদানে রাজ্য বিস্তার করেছেন, তখন তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আরব সংস্কৃতির কোনো সমন্বয় ঘটেনি, এসব অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে ইসলামি সংস্কৃতি দ্বারা অধিকৃত হয়েছিল। সাতশ বছর রাজত্বের পরও মুসলমানরা ভারতবর্ষে ইসলামি সংস্কৃতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এর প্রধান কারণ সেখানে আর্যদের উন্নত সংস্কৃতি ও সভ্যতা ছিল। এ দুই সংস্কৃতি পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু একে অপরের কাছে পরাজিত হয়নি। ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্মের যোগসূত্র স্থাপিত হয় আনুমানিক ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে আরবদের সিন্ধু বিজয় ও পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে তুর্কি, আফগান ও মোগলদের আগমনের ফলে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আগত মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ছিল।

হিন্দু ও ইসলামি সংস্কৃতি দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পথ পেরিয়ে সমন্বয়ের দিকে অগ্রসর হয়। সংস্কৃতির প্রবহমানতার এটাই রীতি। দুই সংস্কৃতির সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে আলবেরুনীর ভারত আগমন। মনীষী আলবেরুনী সাত বছর ভারতে বাসকালে সংস্কৃত ভাষা শিখে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় চেষ্টা করেন। এ উদ্যোগ প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালের চিন্তাবিদদেরও। পাঠান ও মোগলযুগে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নানক, কবীর, দাদু, রামানুজ, চৈতন্যের মতো সাধকরা ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে কবীরের সমন্বয় চেষ্টা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সম্পর্কে ক্ষিতিমোহন সেন, ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা’ বইয়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করেছেন, ‘ধর্মসাধনায় উদারতার ক্ষেত্রে সবার সেরা হইলেন কবীর। তিনি হিন্দু ও মুসলমানকে মিলাইতে চাহিলেন। ফলে দুই দলই তার নামে বাদশার কাছে নালিশ করিলে দরবারে তাহার তলব হইল। একই অভিযোক্তার কাঠগড়ায় মোল্লা ও পণ্ডিতদের একসঙ্গে দেখিয়া তিনি বলিয়াছিলেন, হায়, ইহাইতো অক্ষম চাহিয়াছিলাম। তবে তোমরা ভুল করিলে কেন? বিশ্ববিধাতার সিংহাসনের তলে মিলিত হইবার জন্য তোমাদের ডাকিয়াছিলাম। সেখানে তোমাদের মিলিবার স্থান কুলাইল না, আর কুলাইল এ পৃথিবীর রাজার সিংহাসনের নীচে! বিধাতার সিংহাসনের তলায় স্থান কি এখানকার স্থান হইতে সংকীর্ণ? মিলাইতে চাহিয়াছিলাম প্রেমে-ভক্তিতে, আর তোমরা আজ মিলিয়াছ বিদ্বেষে! বিদ্বেষ হইতে কি প্রেমভক্তির স্থান প্রশস্ত নয়? সেই প্রশস্ত স্থান পণ্ডিত ও মোল্লাদের চোখে পড়িল না, পড়িল নিরক্ষর ভক্তদের চোখে।’

ধর্ম ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের অসাধারণ প্রতিফলন ঘটেছে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনে। ‘যত মত তত পথ’-এই অনন্য বাণীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অনুভব করা যায়। ন্যায়, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা বেদান্ত ইত্যাদি প্রাচীন ভারতীয় দর্শন নিয়ে ভারতীয় মনীষীরা বিভিন্ন সময়ে তর্ক-বিতর্ক করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন রামকৃষ্ণ বহু শতাব্দীর এসব দার্শনিক জট নৈপুণ্যের সঙ্গে উন্মোচন করেছেন। রামকৃষ্ণ শুধু ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শনের প্রশ্ন মীমাংসা করেননি, বহিরাগত ধর্মগুলোর মধ্যে যে ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়, তার স্বভাবসম্মত ব্যাখ্যা ও সমন্বয়ের পথনির্দেশ করেছেন।

এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট-ভারতীয় উপমহাদেশে বহিরাগত সংস্কৃতির আগমনের ফলে প্রাথমিকভাবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হলেও ধীরে ধীরে তা সমঝোতা ও সমন্বয়ের পথ বেছে নেয়। সংস্কৃতির নানাবিধ ক্ষেত্রে এ সমন্বয় বিদ্যমান সংগীত, শিল্প, সাহিত্য, পোশাক-আশাক, আচার-বিচারে। ধর্ম, সমাজ ভাবনা, সামগ্রিক জীবনবোধেও সমন্বয় দেখা যায়। আকবর, দারাশিকোহর মতো শাসকরা রাজনৈতিক ও সাহিত্য সমন্বয়ের ধারা অবারিত করে দেন। উপমহাদেশের শিল্পকর্মে স্তম্ভ ও সাঁচিস্তূপ এবং পরবর্তী সময়ের তাজমহল উপমহাদেশের স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মোগল আমলের শিল্পে ও স্থাপত্যে পারসিক শিল্পশৈলী এবং ভারতের স্থানীয় শিল্প ঐতিহ্যের অনন্য সংমিশ্রণ দেখা যায়।

এ সমন্বয় উপমহাদেশের সংগীত ও নৃত্যকলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসব শিল্পমাধ্যমের অস্তিত্ব সুপ্রাচীন বৈদিক যুগে, এমনকি এর আগেও ছিল। তখন এগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গীভূত ছিল। মুসলমানদের আগমনের পর এগুলোর শিল্পবৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আসে। মুসলমান শাসকরা এসব সুকুমার শিল্পের চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ সময় একটি বিশেষ ধরনের সংগীতধারা বিকাশ লাভ করে। এ সংগীত প্রাচীন হিন্দু, পারসিক এবং মধ্য এশিয়ার অসাধারণ সমন্বয়ে সৃষ্ট। ইসলামি সংস্কৃতির সংস্পর্শে ভারতীয় সংগীতে অসাধারণ বিপ্লব সাধিত হয়। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ খেয়াল ও ঠুংরি জাতীয় গানগুলো। এর আগে সংগীত ছিল ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকভাবের আশ্রিত শিল্প। খেয়ালজাতীয় সংগীতের সূত্রে ধর্মীয় বন্ধন ও সংস্কার থেকে মুক্তি পেয়ে সৌন্দর্য ও লালিত্যের জগতে প্রবেশ করে ভারতীয় সংগীত। এভাবেই ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত অর্থাৎ সেকুলার ভারতীয় সংগীতের উদ্ভব ঘটে। প্রাক মুসলিম যুগে বীণা ছিল প্রধান বাদ্যযন্ত্র। মুসলিমদের অবদানে যুক্ত হয় সেতার, সরোদ, রবাব, সুরবাহার, সুরশৃঙ্গার, তবলার মতো বাদ্যযন্ত্র। হিন্দু-মুসলমানের সমন্বিত সাধনার ফল বর্তমানের হিন্দুস্তানি তথা শাস্ত্রীয় সংগীত। মুসলিম শাসনামলে সংগীতের নতুন নতুন রাগ তৈরি হয়েছে, নতুন বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটেছে। সারেঙ্গি, তবলার মতো অসামান্য বাদ্যযন্ত্র এ সময়ের সৃষ্টি। এভাবে উপমহাদেশের সংগীত বৈচিত্র্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে।

দুই সংস্কৃতির সমন্বয়ের ফলে যেমন ভারতীয় সংগীত ধর্মীয় বিষয় ও সংস্কার থেকে মুক্ত হয়েছিল, তেমনই মুসলিম কবিদের প্রভাবে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত লৌকিক কাব্য ও বিশুদ্ধ প্রণয়মূলক কাব্য রচনার পথ উন্মুক্ত হয়। দৌলত কাজীর ‘সতী ময়নামতী’ ও আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ একান্ত মানবিক প্রেমের উপাখ্যান এবং এ ধারা অনুসরণ করেই পরে অজ্ঞাতপরিচয় কবিদের দ্বারা ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকা রচিত হয়। বৈষ্ণব কাব্য ও মঙ্গল কাব্যের কবিরা ধর্মীয় বাতাবরণে মানুষের কথা বলেছেন, রাধাকৃষ্ণের প্রেমের আড়ালে গোপন রেখেছেন লৌকিক অনুভূতিকে। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সেই লৌকিক প্রেমকে প্রকাশ করেছেন অলৌকিক কাব্যের আঁধারে। এভাবে দেবতার মানবায়ন ঘটেছিল।

সংস্কৃতির এ সমন্বয় রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন সাম্প্রদায়িক বিভেদের কারণে উপমহাদেশের রাজনীতি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, তখন তিনি বললেন, ভারতীয় সংস্কৃতি হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতি। ‘কোট চাপকান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘...এক্ষণে যদি ভারতবর্ষীয় জাতি বলিয়া একটা জাতি দাঁড়াইয়া যায়, তবে তাহা কোনোমতেই মুসলমানকে বাদ দিয়া হইবে না। আমাদের ভারতবর্ষের সংগীত মুসলমানেরও বটে, হিন্দুরও বটে, তাতে উভয় গুণীরই হাত আছে; যেমন মুসলমান রাজ্যপ্রণালিতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই স্বাধীন ঐক্য ছিল। চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্রবয়ন, সূচিশিল্প, ধাতুদ্রব্য নির্মাণ, নৃত্য, গীত এবং রাজকার্য, মুসলমানের আমলে তার কোনোটাই একমাত্র মুসলমান বা হিন্দুর দ্বারা হয় নাই; উভয়ে পাশাপাশি বসিয়া হইয়াছে।’

দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পথ ধরেই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, উচ্চবর্ণের হিন্দু, নিম্নবর্ণের হিন্দু, বৈষ্ণব, শাক্ত, বাউল, আশরাফ, আতরাফ, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান-সবার সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিকতাই এর বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঞ্চলে বাঙালিরা বসবাস করে। তাদের খাদ্যাভ্যাস, জীবনরীতি, শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য কোথাও সূক্ষ্ম, কোথাও বা মোটা দাগে চিহ্নিত। কোথাও কোথাও এ পার্থক্য এত তীব্র যে, তাদের এক সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করা কঠিন।

ইতিহাসে প্রাচীন বাংলার যে পরিচয় পাওয়া যায়, সেখানেও দেখা যায় সমন্বয়ের উদাহরণ। বৈচিত্র্যময় জনপদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল বাংলা অঞ্চল। বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করত। প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতিতে জৈন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব পড়েছিল। মধ্যযুগে ইসলাম ধর্ম ও প্রেমবাদী সুফিদর্শন বাঙালির মরমি চেতনায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। এ ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দেহতাত্ত্বিক সাধন-ভজন বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব সম্পদ। সংস্কৃতির অন্যতম উদ্দেশ্য সম্প্রীতির মাধ্যমে মানুষে মানুষে মিলন ঘটানো। জাতি ও গোত্রভেদ ভুলে গিয়ে দ্বন্দ্ব পরিহার করে সম্প্রীতির সাধনার কথাই তখন উচ্চারিত হয়েছে।

স্থান ও কালের ব্যবধানে বাঙালি সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটেছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ উপাদান থাকা সত্ত্বেও এ সংস্কৃতির অভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে বিস্তৃত পরিসরজুড়ে। বাঙালির সাহিত্য, সংগীত, খাদ্যাভ্যাস, বাড়িঘরের উপকরণ, চেহারা, স্বভাবের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। আদান-প্রদান তথা মিশ্রণের মধ্য দিয়ে এ সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। আদি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বহিরাগত সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও সমন্বয় নতুন বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছিল। বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের প্রবেশ বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটিয়েছে।

পৃথিবীর প্রতিটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ইতিহাস দ্বন্দ্ব ও সমন্বয় দ্বারা গঠিত। সেই অর্থে একক বা নির্ভেজাল সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি বিকশিত হয়। সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের অসাধারণ উদাহরণ বাঙালি সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি শুধু সমন্বয়বাদী নয়, মানবতাবাদীও। ভেদনীতি ও বিভক্তির বিরুদ্ধে এর স্পষ্ট অবস্থান।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম