শিশু রিয়া গোপের মৃত্যু আমাকে রাস্তায় নামিয়েছে

আজমেরী হক বাঁধন
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। ছবি: যুগান্তর
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মূলত শুরু হয় জুন মাসে। সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের। এটা শুধু ছিল ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতার এক আন্দোলন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক এ দাবি মেনে নিতে চায়নি তৎকালীন সরকার। নানা গড়িমসি শুরু করে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বৈরাচার সরকারের মতো আমাদের দেশের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারও তখন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমাতে চেয়েছিল। ভয়, আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতার বড়াই দেখাতে চাইলেন শেখ হাসিনা। তাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে পেশিশক্তিসহ নানা কূটকৌশল ব্যবহার করে সরকার। আন্দোলনের শুরু থেকেই আমি এর পক্ষে ছিলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা টেলিভিশনে সংবাদ দেখতাম। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলাম প্রতিনিয়ত। ১৬ জুলাই যখন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে মারা হয়, তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। ভেতরটা নাড়া দিয়ে ওঠে। আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল বাড়ির ছাদে রিয়া গোপ নামে ৬ বছরের বাচ্চা মেয়েকে গুলি করার ঘটনাটি। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই আর ঘরে থাকব না। যেসব ছেলেমেয়েকে রাস্তায় মারা হচ্ছে, তারা আমার সন্তানও হতে পারত। রিয়া গোপ যখন কাতরাতে কাতরাতে মারা গেল, এর ভিজ্যুয়াল দৃশ্য চোখের সামনে যেন আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। ওটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আমারও একটি সন্তান আছে। এটা আমি কোনোভাবেই নিতে পারছিলাম না। আজ যদি আমার সন্তান রাস্তায় এভাবে গুলি খেয়ে মারা যেত, নিশ্চয়ই মা হিসাবে ঘরে বসে থাকতে পারতাম না।
কিন্তু রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত যখন নিলাম, তখন অনেকেই বাধা দিচ্ছিল। সিনিয়র অনেক শিল্পী-সহকর্মীও আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আমি এসবের তোয়াক্কা করলাম না। পন্থা খুঁজলাম কীভাবে ছাত্রদের সাহস জোগানো যায়, কীভাবে শুরু করব। তখন ডিরেক্টর আকরাম খান ভাই এগিয়ে এলেন। আমাদের একটা ভার্চুয়াল গ্রুপ আছে। তিনি সেখানে লিখলেন, ছাত্রদের জন্য আমাদের কিছু করা উচিত। তারা তো যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। তাহলে কেন তাদের মেরে ফেলছে পুলিশ! সেদিন ভাইয়ের কথায় সাহস খুঁজে পেলাম। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমরা ছাত্রদের সাহস দিতে অন্তত তাদের পাশে দাঁড়াব। ছাত্রদের প্রতিবাদ মূলত সেদিন আমাদের সাহস দিয়েছিল। তাদের আন্দোলন আমাকে ভীষণভাবে উদ্বেলিত করেছে। তারপর ২৬-২৭ তারিখে আমরা (আকরাম ভাই, পিপলু ভাই, ধ্রুব হাসান ভাই) মিটিং করি। চেষ্টা করি আমাদের সঙ্গে মিডিয়ার ইয়াং জেনারেশনটাকে নিয়ে আসতে। পরবর্তী সময়ে তাদের ভীষণ সাড়াও পেয়েছি। কিন্তু অনেক সিনিয়ররা আমাদের বাধা দিয়েছিলেন। নিরুৎসাহিত করেছিলেন। অনেকেই আমাদের সঙ্গে রাস্তায় যাননি। অনেককে আবার জোর করেই নিয়েছি। তবে আমাদের সঙ্গে ইয়াংদের ভূমিকা নিয়ে আমরা অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। কোনো কারণে ভয় পেলেও ইয়াং জেনারেশন আমাদের সাহস দিয়েছে। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
আমরা যখন ১ আগস্ট ছাত্রদের নয় দফার সঙ্গে একমত থেকে প্রথমদিন রাস্তায় দাঁড়াব, এক্ষেত্রেও আমাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ আমরা তখন ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এক্সপোজ হতে যাচ্ছি। আমাদের কাছে সেসময় প্রচুর ফোন আসে। ইন্টেলিজেন্স থেকে ফোন দেয়। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন মন্ত্রী ফোন করতে থাকেন আমরা যেন রাস্তায় না যাই। এমনকি আমাদের অনেক শিল্পীও ফোন দিয়ে নিষেধ করলেন। তাদের একটি গ্রুপ পরদিন বিটিভিতে গেল। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। প্ল্যাকার্ড, ব্যানার এগুলো নিজ দায়িত্বে আমি নিয়ে গেলাম। কারণ রাস্তায় সেসময় পুলিশের কড়া তল্লাশি চলছিল। কেউ সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু আমি সাহস করে এগুলো নিজেই বহন করলাম। আমরা মানিক মিয়া অ্যাভেনিউতে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পুলিশ এসে আমাদের বাধা দেয়। আমাদের সিনিয়র মামুনুর রশীদ ভাইকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। তারা আমাদের একরকম বাধ্য করে সেখান থেকে সরে যেতে, না হলে আমাদের গ্রেফতার করবে। পরে আমরা ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে দাঁড়াই। প্রথমদিন আমাদের কার্যক্রম আমরা মোটামুটিভাবে সফল করি। এরপর আমাদের কাছে আরও বেশি ফোন আসতে শুরু করে আমরা যেন আর না যাই। পরদিন শিক্ষক-অভিভাবকদের দ্রোহ যাত্রা কর্মসূচি ছিল শাহবাগে। আমাদের হুমকি দেওয়া হলো আমরা যেন সেখানে না যাই। আমাদের যেন না দেখা যায়। এদিকে তখনো আমাদের সিনিয়ররা আমাদের বোঝাল যে, নয় দফার সঙ্গে একমত হওয়াটা ঠিক হয়নি, ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় যাওয়াটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের। আরও অনেকভাবে তারা আমাদের পেছনে হটানোর চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার ভয়ও দেখানো হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় নামার পর আমার সাহস আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ছাত্ররা আমাকে যে সম্মান দেখিয়েছে, তা আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মিডিয়ায় এত কাজ করেও বোধহয় খুব কম সময় পেয়েছি। এরপর আমি ২ আগস্ট ঠিকই রাস্তায় গিয়েছি, ৩ আগস্ট ছাত্রদের সম্মেলনে শহিদ মিনারেও গেলাম। তখনো ছাত্ররা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন কথা বলার জন্য। আমি সেখানে কথা বললাম।
৪ আগস্ট দেশে কারফিউ দিয়ে দিল তৎকালীন সরকার। তখন এক দফা নিয়ে আন্দোলন চলছে। কারফিউ দেওয়াতে সেদিন আমি অনেক ভয় পেলে গেলাম। বাচ্চাগুলোকে আজ পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলবে। কারণ, আমাদের হয়তো খুঁজে খুঁজে বের করে খুন করবে না, কিন্তু বাচ্চাগুলো তো রাস্তায়! কারফিউ দেখে আমরা আর রাস্তায় নামিনি, ছাত্ররা তো দমে যায়নি, তারা এক দফা নিয়ে আরও জোরালোভাবে মিছিল করছে। এরপর ৫ আগস্টের দিন সকাল বেলা আমার পরিবার তো কোনোভাবেই আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেবে না। আমার বাচ্চা কান্নাকাটি করছে। তবুও আমি বোরখা পড়ে বের হলাম। রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ ছিল সেদিন। কোনো গাড়ি নেই। আমি হেঁটেই মিরপুর থেকে নেভাল হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত যাই। সেদিন লাখো জনতার স্রোত দেখে আমার মনে হলো আজ কিছু একটা হবে। যখন নেভাল হেডকোয়ার্টার পৌঁছাই, তখন আমাদের এক প্রযোজক সারা আপা আমাকে ফোন করে বলেন, বাঁধন তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাকো। সেনাপ্রধান একটা স্পিচ দেবেন বলেছেন। আমি তখন সেখানেই অপেক্ষা করছিলাম। দেড়টার দিকে নিশ্চিত হয়ে গেলাম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। সে সময়ের যে আনন্দ, তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তখন বিজয় মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে পুরো ঢাকা শহর ঘুরেছি। সন্ধ্যা ৬টায় বাসায় ফিরেছি।
অভিনয় জীবনে নানা অভিজ্ঞতা আমার জীবনে থাকলেও জুলাই বিপ্লব আমার জীবনে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা কোটি টাকা দিয়েও কখনো আমার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এটি আমার জীবনের অন্যতম এক অর্জন হয়েই থাকবে। এখন আমরা নতুন এক দেশে কথা বলতে পারছি। কিন্তু আমাদের জাতিটা এমনভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে যে অল্প সময়ে এটা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। রাতারাতি এ পচনশীল জাতির সবকিছু পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। গোড়া থেকেই এর পচনটা শুরু হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্যসব উপদেষ্টাকে নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী। এ পাঁচ মাসে অনেকটা প্রত্যাশা আমাদের পূরণ হয়েছে। আশা করি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাশা সব পূরণ হবে। এ বিশ্বাসটা রাখি, এখন যারা সরকারের নেতৃত্বে আছেন, তারা সবাই ভালো মানুষ। হয়তো রাতারাতি পচনশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত জাতিকে বদলে ফেলা সম্ভব নয়, তবে দেশকে একটি সঠিক পথে তারা নিয়ে আসবেন। একটি স্বাধীন দেশ চাই আমি। সেখানে মানুষ সৎ হবে, দেশকে ভালোবাসবে। প্রত্যেক ধর্মের-বর্ণের মানুষের অধিকার যেন রক্ষা পায়। আমি মনে করি, প্রত্যেক মানুষ তার স্বাধীনতা ও অধিকার বুঝে পাবে। অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক সরকারের তত্ত্বাবধানে আমাদের দেশটা চলবে এবং একটা স্বাধীন দেশে আমরা বাস করব এ আশা রাখি। ছাত্রসমাজ আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ এনে দিয়েছে। তাদের কাছে সব সময় আমি কৃতজ্ঞ। তাদেরকে এ দেশ গঠনে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অবশ্যই তাদের পড়াশোনায়ও মনোযোগী হতে হবে। তাদের একদিন এ দেশের আরও বড় বড় দায়িত্ব নিতে হবে। যেভাবে দেশকে ভালোবেসে আজ নতুন বাংলাদেশ এনে দিয়েছে এ ছাত্রসমাজ, ভবিষ্যতেও যেন দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কবলে না পড়ে এ জেনারেশন, এ দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। (অনুলিখন : রিয়েল তন্ময়)
লেখক : অভিনয়শিল্পী