সব হুমকি উপেক্ষা করেই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছি
মোশাহিদা সুলতানা
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৭ এএম
জুলাই-আগস্টজুড়ে শিক্ষার্থীরা যে প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তোলে, তাতে বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজের নানা পেশার মানুষ যুক্ত হয়। অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে, কেউ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গড়ে তোলা আন্দোলন একপর্যায়ে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের পতন হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানাভাবে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল বলেই আন্দোলন এতটা গতি অর্জন করেছিল। গণ-অভ্যুত্থান কখনোই পূর্বপরিকল্পিত হয় না।
এ ধরনের আন্দোলন কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, বরং সব দলেরই নানা পর্যায়ে অংশগ্রহণ থাকে। সর্বস্তরের মানুষ এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়। আমরা যারা শিক্ষক, তারাও এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন গণ-আন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করে, ঠিক তার আগেই আমরা এতে যুক্ত হই।
বিশেষ করে ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা কি মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেব, নাকি রাজাকারের নাতিপুতিদের নিয়োগ দেব?’ এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তারা স্লোগান দিতে থাকে, আমি কে তুমি কে-রাজাকার রাজাকার। আমরা শিক্ষকরা তখন চিন্তা করলাম, আমাদের এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হলো যে, শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিতে বাধ্য হচ্ছে। এরপর সরকারের বিভিন্ন বাহিনী শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে।
বিশেষ করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের ওপর পুলিশ বিনা উসকানিতে গুলি করলে সে ঘটনা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে স্পর্শ করেছে। ১৫ জুলাই আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে মিটিং করি-এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী? শিক্ষার্থীরা সরকারের আক্রোশের মধ্যে পড়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে পারে না।
ছাত্ররা রাজাকার বলে স্লোগান দেওয়ায় তাদের দোষ হলো, কিন্তু তাদের এ স্লোগান দেওয়ার জন্য যিনি উসকানি দিলেন, তার কোনো দোষ হলো না। ২০১৮ সালে যখন প্রথমবারের মতো সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে, তখনো তাদের ওপর নিপীড়ন নেমে আসে। আমরা তখন নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।
২০১৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা বাতিল করা হয়। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের একটি আদেশের বলে কোটা সুবিধা পুনর্বহাল করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ার সময় আমরা কোটা সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার ছিলাম। সবসময়ই শিক্ষার্থীদের দাবির অনুকূলে কথা বলে এসেছি।
১৭ জুলাই আমরা যখন অপরাজেয় বাংলার সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন চারদিকে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। কাউকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ছেলেমেয়েদের হল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কিছু সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। নীলক্ষেতের দিক থেকে মাইক ঢুকতে দিচ্ছিল না। কোনো যানবাহনকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এলোমেলো অবস্থায় আমরা কার্যক্রম শুরু করি।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিগত কয়েক দিনে যেসব শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে, তাদের মুক্তির ব্যাপারে এমন কিছু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যা দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকবে। আমরা শিক্ষকরা মিছিল করে শাহবাগ থানায় গেলাম। শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে পুরো বিষয়টি অর্গানাইজ করা হয়েছিল। আমরা শাহবাগ থানায় গিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হই। পরে শুনেছি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ উদ্যোগ ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিতে গিয়ে আমরা সবসময়ই হুমকির মধ্যে ছিলাম। আমাদের নানাভাবে ভয় দেখানো হতো। বলা হতো, আপনারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছেন, আপনাদের পেছনে কিন্তু ডিজিএফআই আছে। যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। আমরা সেই হুমকি উপেক্ষা করেই আন্দোলনে সমর্থন-সহযোগিতা জুগিয়েছি। আমরা যেহেতু লক্ষ্যে অবিচল ছিলাম, তাই হুমকির বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দিইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে সমাজে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। আমরা সেই গ্রহণযোগ্যতা থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। শিক্ষক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত নন এমন অনেকেই আমাদের সঙ্গে শাহবাগ থানায় গিয়েছিলেন। শাহবাগ থানা থেকে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্ত করে আনার বিষয়টি সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আন্দোলনকে করে বেগবান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছে, আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
আমরা বলেছি, আমরা তোমাদের সঙ্গে সরাসরি রাস্তায় না থাকলেও আমাদের অবস্থান থেকে তোমাদের আন্দোলনকে সমর্থন দেব। যে কোনো সময় তোমরা ডাকলে আমরা সাড়া দেব। শিক্ষকদের অনেকেই রাস্তায় থেকেছেন। আমরা একটার পর একটা কর্মসূচি দিতে থাকি। পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন করতে থাকি। আন্দোলনে আহত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, আমরা তাদের দেখতে গিয়েছি।
আমাদের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নীল দলের শিক্ষকদের ওপর চাপ দিতে থাকে ছাত্রদের পক্ষে আন্দোলনে দাঁড়ানোর জন্য। নীল দলের শিক্ষকদের অনেকেই তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এটিও ছিল শিক্ষার্থীদের অর্জন। তারা নিজেদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের পথে নিয়ে আসেন।
আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এবারের শিক্ষার্থী আন্দোলন কোনো পূর্বপরিকল্পিত বিষয় ছিল না। এটি ছিল তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিক্রিয়া ও ঘটনার ফলাফল। প্রথমে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করে, তার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সুবিধা যৌক্তিকভাবে সংস্কার করার জন্য সরকারকে বাধ্য করা।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। সর্বশেষ কোটা সংস্কারের জন্য সৃষ্ট আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। তখন সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাতে যুক্ত হয়। আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন ঘটে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
শিক্ষার্থীরা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করে। বৈষম্যবিরোধিতা শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। বৈষম্য শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধার ক্ষেত্রেই বিদ্যমান নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য রয়েছে। একটি পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্য থাকতে পারে।
চাকরিতে বৈষম্য; অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্য থাকতে পারে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য বা চেতনা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে উন্নয়নের সুফল রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারবে। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য শুধু বাড়ছেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে দেশের অবস্থা আরও শোচনীয় হতে পারে।
যা হোক, এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ করা গেছে। অনেকে এটাকে শিক্ষার্থী আন্দোলনের নতুন মাত্রা বলতে চান। আমি মনে করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর আগেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল এবং ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিল। কাজেই আন্দোলনে তাদের ধারাবাহিকতা বরাবরই ছিল। এবার তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ আন্দোলনে ঐক্য সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, দেশে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অর্থ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রচর্চা থাকতে হবে। সরকারকে মানবিক ও জনকল্যাণমূলক সরকার হতে হবে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হতে পারে। তবে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা থাকলে সরকারের পক্ষে স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের মাধ্যমে হাজারও প্রাণের বিনিময়ে আমরা দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছি। সেই সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে। ক্ষমতার দাপটে আর যেন কোনো স্বৈরাচারের সৃষ্টি না হয়, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়