গণ-অভ্যুত্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণ-অধিকার: সলিমুল্লাহ খান
জাকির হোসেন সরকার
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:০৮ এএম
সলিমুল্লাহ খান। ছবি: সংগৃহীত
সলিমুল্লাহ খান ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক। বাংলাদেশে একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ : জাতীয় অবস্থার চালচিত্র, সত্য সাদ্দাম হোসেন ও স্রাজেরদৌলা, আমি তুমি সে, স্বাধীনতা ব্যবসায়, ফ্রয়েড পড়ার ভূমিকা, বেহাত বিপ্লব ১৯৭১, আহমদ ছফার স্বদেশ, আদমবোমা, গরিবের রবীন্দ্রনাথ, রক্ত আর খুন, ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় প্রভৃতি। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন সরকার
যুগান্তর: কেউ কেউ বলছেন, জুলাই-আগস্টে বিপ্লব হয়েছে, আবার কেউ কেউ বলছেন, এটি গণ-অভ্যুত্থান, আপনার মূল্যায়ন কী?
সলিমুল্লাহ খান : এটি দুটোই। এটি প্রথমে গণ-অভ্যুত্থান, গণ-অভ্যুত্থানই বিপ্লব। নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার বদলায়। কিন্তু দেশে বিগত পরপর চারটি নির্বাচনই সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ ছিল, এগুলো ভুয়া ছিল। ২০১৪, ২০১৮, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ভুয়া নির্বাচনের বিরুদ্ধে মানুষের যখন আর কোনো প্রতিকার ছিল না, তখন মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামে। এরপর ছাত্র-জনতার ওপর ফ্যাসিস্ট সরকার নির্বিচারে গুলি করে। হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, কয়েক হাজার লোক অন্ধ হয়েছে, বহু লোক পঙ্গু হয়েছে। তারপরও মানুষ শেষ পর্যন্ত রাস্তায় ছিল বলেই তৎকালীন সরকারের যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি বাধ্য হয়েছেন পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করতে। এটাকে অভ্যুত্থান বলার ব্যাপারে কোনো তর্ক নেই।
কেউ কেউ বলছেন, এটি গণ-অভ্যুত্থান। কেউ কেউ নয়, এটিকে সবাই গণ-অভ্যুত্থানই বলবে। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এখন প্রশ্ন হলো, এটিকে বিপ্লব বলা যায় কি না? বিপ্লব মানে হচ্ছে অবস্থার পরিবর্তন। বিপ্লব শব্দের অর্থ হচ্ছে উলটে যাওয়া। অর্থাৎ আগে সঠিক নির্বাচন ছিল না, এখন যদি সঠিক নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনের পরে যে সরকার গঠিত হবে, সে সরকার যদি আগের সরকারের চেয়ে ভিন্নরকমের হয় এবং আগের সরকার যে অন্যায়গুলো করেছে, সেটি যদি বন্ধ করতে পারে, তাহলে এটিকে একধরনের বিপ্লব বলতে হবে।
বিপ্লব কথাটা নিয়ে আমাদের মধ্যে অস্পষ্টতা থাকার কারণে এ বিতর্কটা হচ্ছে। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি মৌলিক পরিবর্তন। অভ্যুত্থান মৌলিক পরিবর্তনের একটি শর্ত, বাকিটা তো এখনো শেষ হয়নি। সেটি হওয়ার পথে আছে কি না, এটি আমরা বুঝতে পারব সামনে। আমি মনে করি, এ গণ-অভ্যুত্থান একটি বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এবং এতে বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ সম্ভাবনা সফলও হতে পারে, বিফলও হতে পারে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথাই ধরি। সেটি একটি বিপ্লবাত্মক ঘটনা ছিল। কিন্তু তার ফল আমরা জনগণের কাছ থেকে ছুটে যেতে দেখেছি। সেজন্য আমরা এর নাম দিয়েছি বেহাত বিপ্লব। যে বিপ্লব জনগণের হাতছাড়া হয়ে গেছে অথবা যে বিপ্লব জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল-সেটি পূর্ণ করতে পারেনি।
যুগান্তর : শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সমাজের মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি?
সলিমুল্লাহ খান : না, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সমাজের মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। সমাজে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এখন কোনটা মৌলিক, কোনটা অমৌলিক, সেটি নির্ভর করে আপনার দেখার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
শেখ হাসিনা চলে গেছেন, এটি একটি বড় পরিবর্তন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে যারা সমর্থন করেছিল, তারা এখনো সমাজে মোটামুটি নিজের জায়গাতেই আছে। মোটামুটি বলছি এজন্য যে, কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, কিন্তু এখনো বিচার করে কারও শাস্তি হয়নি।
দুই. শেখ হাসিনাকে সফল করেছিল যে মহল, বাংলাদেশে যে নতুন পুঁজির সঞ্চয়ন হয়েছে, যে নতুন করপোরেট গ্রুপগুলো গড়ে উঠেছে এবং যারা শেখ হাসিনাকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করেছিল এবং যারা বলেছে, শেষ পর্যন্ত আমরা আপনার সঙ্গে আছি, তাদের শক্তিগুলো এখনো বহাল আছে। তাহলে বলতে পারি, মৌলিক পরিবর্তন হয়নি।
আবারও বলব, যে জনগণ কথা বলতে পারত না, যে জনগণ দেওয়ালে একটা চিকা লিখতে পারত না, তারা অন্তত এখন তা করতে পারছে। এখন দাবি উঠেছে, ফ্যাসিবাদের সমর্থকদেরও তাদের পদ থেকে সরাতে হবে। উচ্চমহলে কিছু কিছু সরানোও হয়েছে। এটি মৌলিক পরিবর্তনের কাছাকাছি, যদিও তা স্থায়ী হবে কি না জানি না। কারণ তার ওপরই নির্ভর করবে এটিকে মৌলিক বলা যাবে কি না।
যুগান্তর : নির্বাচিত সরকার এসে এ পরিবর্তনগুলোকে সামনে এগিয়ে নিতে পারবে বলে মনে করেন কি?
সলিমুল্লাহ খান : আমরা তো বারবারই বলছি, দেশে যে গণতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে ফেলেছিলেন শেখ হাসিনা, তা পুনরুদ্ধার করা হবে প্রথম কাজ। পুনরুদ্ধারের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শেখ হাসিনা যেসব শক্তিকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করতে পেরেছিলেন সে শক্তিগুলোর পরিবর্তন। যেমন ধরুন, ২০০৪ সালে বিএনপির আমলে র্যাব গঠিত হয়েছিল। শেখ হাসিনা এটিকে বহুগুণে শক্তিশালী করেছেন।
র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তারা জোরপূর্বক অপহরণ, গুম এবং তারা অনেক রকমের বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার করেছে, যেটি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাদের বিরুদ্ধে এ রকম অজস্র অভিযোগ। তারা এগুলো করেছে সরকারের নির্দেশেই। তারা শুধু সরকারের পক্ষেই কাজ করেনি, জনগণের মধ্যে যে কোনো বিপ্লব-বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে এবং অপবাদ দিয়েছে। তাদের সহযোগিতা করেছে সরকারের ধামাধরা বিভিন্ন মিডিয়া। সেগুলোকে আপনি কীভাবে দেখবেন, এরা তো সব বহালই আছে। এখন আকাশের দিকে থুতু ফেললে তো নিজের গায়েই পড়ে। সুতরাং, এ শৃঙ্খলগুলো ভাঙতে হবে, যে সরকারই আসুক।
যুগান্তর : কোন কোন সূচকে বর্তমান সরকার ভালো করেছে, কোনগুলোয় পিছিয়ে আছে বলে মনে করেন?
সলিমুল্লাহ খান : বর্তমান সরকার কথায় ভালো করছে, কাজে নয়। কাজেও তারা ভালো করবে, আমার বিশ্বাস। কারণ বর্তমান সরকার অনেক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সংস্কার কমিশন। অনেক সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টে কী আছে না আছে, সেটি পরের ব্যাপার। তবে সংস্কার কমিশন গঠন করা একটি অনিবার্য কাজ ছিল। সরকার সেটি করেছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের একটি রিপোর্ট এসেছে। সংবিধানের সংস্কার করতে হবে। এখানে কোনটা আমরা অগ্রাধিকার দেব, কোনটা দেব না, তা পরের ব্যাপার।
সরকার কিছু কাজ করেনি। যেমন, শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করেনি।
সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল ব্যাংক-বিমার মতো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করা। কিন্তু সরকার এগুলোর সংস্কারের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দেশের আসল সমস্যা হচ্ছে কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষার অভাব, মানুষের আয়-উপার্জনের অভাব এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের যে কষ্ট, সেটি লাঘবের অভাব। এক্ষেত্রে সরকার কিছু করতে পারছে না।
বর্তমান সরকারের দুটো কর্মসূচি আছে। একটি হলো দীর্ঘমেয়াদি, অপরটি স্বল্পমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদি মানে হচ্ছে তাকে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন হয়। এখন শোনা যাচ্ছে, এ সরকার বলছে-না, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দেব। সাধারণ মানুষের কাছে এটিকে এ সরকারের একটি প্যাঁচ বলে মনে হতে পারে। আমার কথা হচ্ছে, দেশের প্রধান সমস্যাগুলোর উপরের দিকে যদি সমাধান করতে পারি, তাহলে নিচের দিকের সমস্যার সমাধানগুলো করা সহজ হয়। কিন্তু এ সরকার যদি নিচের দিক থেকে শুরু করতে চায়, তাহলে মানুষ মনে করবে, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য এগুলো করছে। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সরকারকে সামনে এগোতে হবে।
যুগান্তর : নির্বাচন কবে নাগাদ হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
সলিমুল্লাহ খান : নির্বাচন কবে হবে, সেটি নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কারণ, আমি ভবিষ্যৎ বক্তা নই। এখন প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমরা এক বছরের মধ্যে নির্বাচন করতে পারি। ধরুন ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। আবার বিএনপির তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এটি এখন থেকে ছয় মাসের মধ্যে দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে নির্বাচনগুলো সাধারণত শীতকালেই হয়। যেমন ১৯৭০-এর নির্বাচনের শিডিউল ছিল অক্টোবরে। সেটি পক্ষান্তরে হয়েছে ডিসেম্বরে। কারণ, নভেম্বরে একটি বিশাল তুফান হয়েছিল।
নির্বাচনের ব্যাপারে শেখ হাসিনা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। কারণ, আওয়ামী লীগের একটি বিশ্বাস ছিল, জোড়া বছরে হলে তারা জয়লাভ করে। তাই তিনি নির্বাচন জানুয়ারির ৭ তারিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ কুসংস্কার তাকে রক্ষা করতে পারেনি। হাসিনা সরকারের আমলে যে কয়েকটি নির্বাচন কমিশন হয়েছে, তারা তো জানতেন হাসিনা সরকারের তিনটি নির্বাচনই একেবারে ভুয়া ছিল। তখন যারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, তারা সবাই জানতেন বিষয়টি। ফ্যাসিস্ট সরকারের এ অপরাধের জন্য তারা কেউই কোনো প্রতিবাদ করেননি। বিষয়টি জনগণকে হতাশ করেছে, বিক্ষুব্ধ করেছে। সামনে যেন এমনটি না হয়, আমরা সেই প্রত্যাশাই করি।
যুগান্তর : সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল হয়েছে, এর অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত কি?
সলিমুল্লাহ খান : বর্তমান সংবিধান তো প্রকৃত প্রস্তাবে বাতিল হয়ে গেছে। বাতিল হওয়া সংবিধানে কোনো কিছু অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তো কোনো মানে হয় না। এ বিষয়ে আমার মৌলিক দ্বিমত আছে। অভ্যুত্থান মানেই সংবিধান স্থগিত হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার উপায় না পেয়ে পুরোনো জিনিসের অভ্যাস অনুসারে তারা ওই সংবিধানের অধীনেই শপথ গ্রহণ করেছেন। একটি উদাহরণ দিই, ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত স্বাধীন হয়েছে। তারা শপথ গ্রহণ করেছে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের অধীনে। যে গভর্নর জেনারেল তখন ক্ষমতাহীন, তাহলে তার অধীনে শপথ কেন? ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চলে গেছে, কিন্তু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি আইন হয়েছে ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে।
সেটি হলো, ভারতকে স্বাধীন করে দুই রাষ্ট্র করে দেওয়া হবে। ওই সময়ে ব্রিটিশ যে গভর্নর জেনারেল ছিলেন, ভারতেও তিনিই গভর্নর জেনারেল হলেন। পাকিস্তানে জিন্নাহ, তিনি নিজে গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানটার অবস্থা হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের মতোই। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে নজর দিয়ে দেখেন, এটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের শেষ সাংবিধানিক আইন। ১৯৪৭ সালে যে আইন হয়, এটির নাম হয় ইনডিপেনডেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট। ভারতকে স্বাধীন করে দেওয়ার আইন। আমাদের দেশেও আমি মনে করি, বর্তমানে যে ত্রুটিটি হয়েছে, সেটি হলো ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান, তার সব সংশোধনীসহ (সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধনী পর্যন্ত) পুরোটাই এখন বাতিল।
যুগান্তর: তাহলে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অকার্যকরই থাকবে, আগামী নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব থাকবে না?
সলিমুল্লাহ খান: না, আমি তা মনে করছি না। নির্বাচনকালে আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন সরকারকে যেহেতু জনগণ আর বিশ্বাস করে না, তাই ক্ষমতাসীন সরকারকে অকার্যকর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় জাতীয় নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে।
ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার বিশ্বাস, এটি জাতির মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। অটোমেটিক নির্বাচনের সময় সরকার অকার্যকর থাকে এবং শুধু তার ন্যূনতম যারা কার্য পরিচালনা করেন, সেই আমলাতন্ত্র সক্রিয় থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বারবার অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনের অবাধ ও নিরপেক্ষতা লঙ্ঘন করতেই বেশি পছন্দ করে। এসব কারণে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরত এসেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করার ফলেই তিনি পরবর্তী অন্যায়গুলো করতে পেরেছিলেন। এ কারণে এটিকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে নতুন সংবিধান আবির্ভূত হবে, তাতে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা থাকবে কি থাকবে না, সে বিষয়ে জনগণই রায় দেবেন। সেক্ষেত্রে মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে রায় হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা থাকা উচিত।
সুপ্রিমকোর্ট বলেছিলেন, দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। তার মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়াটা আদর্শ নয়, ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম হিসাবে তা অনুমোদন করা হয়েছিল সুপ্রিমকোর্টে, কিন্তু শেখ হাসিনা সেটাকে একেবারেই বাতিল করে দিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা যদি আরও দুই বা তারও বেশি টার্ম থাকে, খারাপ হবে না।
যুগান্তর: অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশে উগ্র ধর্মচর্চা হচ্ছে, আপনি কি তাই মনে করেন?
সলিমুল্লাহ খান : অভিযোগ রয়েছে কী, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। শেখ হাসিনার আমলে যাদের বিরোধী দল মনে করা হতো, তাদের নির্যাতন করার জন্য, দমন করার জন্য তারা কতগুলো কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। এর একটি হলো কাউন্টার-ইনসারজেন্সি। মানে বিপ্লব দমনমূলক কার্যক্রমের একটি শব্দ ছিল জঙ্গি। অর্থাৎ ইসলামের সঙ্গে জড়িত নাম দেখলেই তারা জঙ্গি বলে দিতেন। এটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ছিল।
ইসলামকে এদেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্ম হিসাবে পালন করেন। আবার ইসলামকে কেন্দ্র করে যদি কেউ কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শ সামনে হাজির করেন, সেটিকে এদেশের নিয়মের ব্যতিক্রম মনে করা যাবে না। পৃথিবীর বহু দেশেই ধর্মচর্চা হয়, ভারতে হচ্ছে, পাকিস্তানে হচ্ছে, শ্রীলংকায় হচ্ছে, মিয়ানমারে হচ্ছে। বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য দুটো। বাংলাদেশে বহু ধর্ম এবং বহু জাতি মুক্তিযুদ্ধে একত্রে লড়াই করেছে। আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই বাঙালি, সবাই এক জাতি। কিন্তু ওই স্লোগানে একটি ত্রুটিও ছিল। আমরা সবাই বাঙালি নই।
বাংলাদেশে বাঙালির পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের বহু অবাঙালি ছিল। অবাঙালির প্রায় ৪০-৫০টি জাতি আছে আমাদের দেশে। এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ইসলামি ধর্মচর্চা হচ্ছে, এটি স্বাভাবিক। তবে এখানে হিন্দু ধর্মচর্চাসহ অন্যান্য ধর্মচর্চাও হচ্ছে। সুতরাং, এখানে উগ্র ধর্মচর্চা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশে উগ্র ধর্মচর্চা বেশিদিন মানুষের কাছে সংবর্ধনা পাবে না।
যুগান্তর : একটি পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে ম্লান করতে চায়, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সলিমুল্লাহ খান : মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে ম্লান করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী বিষয়কে যখন শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে প্রচার করেছেন, তখন সেটি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে ম্লান করাই বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল বাংলাদেশের মানুষে মানুষে সমতা প্রতিষ্ঠা করা। আয়-উপার্জনের সমতা, কর্মসংস্থানের সমতা, শিক্ষাদীক্ষায় সমতা ইত্যাদি। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে গেলে গত ৫০ বছরে মানুষে মানুষে সমতার চেয়ে অসমতাই বেড়েছে। ধনসম্পদের অসমতা বেড়েছে। বাংলাদেশে কয়েকশ নব্য পুঁজিবাদী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা করপোরেট গ্রুপ বা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ হিসাবে আমাদের দেশে রয়েছে। এখন প্রশ্ন, এগুলো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে না বিপক্ষে?
এদের মধ্যে যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থাকে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ম্লান করেছে কে? একসময় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে একটি পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। শুধু পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া, বিহারিদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল জাতীয়করণের নামে। আমি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর কথা বলছি। তারপরে ক্রমশ দেশে পুঁজি বিনিয়োগের সীমা বেড়েছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে ১৯৮০-এর দশকে। তার নাম ছিল স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট। মানে বিদেশি পুঁজির জন্য বাংলাদেশের বাজার খুলে যাওয়া। যেটার নাম হয়েছে এখন গ্লোবালাইজেশন। এদিক থেকে দেখা যায় এগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে।
এগুলো মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ-সাম্য, তার বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় আদর্শ মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার এবং মানবিক মর্যাদা রক্ষা করা। শেখ হাসিনার আমলে এবং তার আগের আমলেও এটি লুণ্ঠিতই হয়েছে। এরশাদের আমলে লুণ্ঠিত হয়েছে, খালেদা জিয়ার আমলে এটি খুব বেশি মর্যাদা পায়নি। তা না হলে তো তারা র্যাব গঠন করত না। অপারেশন ক্লিনহার্ট করত না। এগুলো ভুলে গেলে চলবে না।
যারা অভ্যুত্থান করেছে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করেছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার-এ তিনটিই মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ। এগুলো ঢেকে শেখ মুজিব আদর্শ করেছিলেন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এগুলোর মধ্যে একটি ছিল সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সেটি গণতন্ত্র। সেটি ধ্বংস করলে বাকিগুলো আর থাকে না। এজন্য বাংলাদেশে একটি আদর্শের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেটি গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের পরে যদি সামাজিক সাম্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, আর কোনো বিতর্ক থাকে না।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
সলিমুল্লাহ খান : ধন্যবাদ।