
প্রতীকী ছবি।
মুসলমানদের দৈনন্দিন তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র এবং অনুপম আদর্শ হচ্ছেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মহানবী (সা.) রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে শাসক, দাঈ, পিতা এমনকি দাম্পত্য জীবনে স্বামী হিসেবেও ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ।
প্রিয় নবী (সা.) এমন অনেক সুন্নত আছে, যেগুলো অনুসরণ ও অনুকরণেই গড়ে ওঠে স্বামী-স্ত্রীর সুখী দাম্পত্য জীবন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাম্পত্য জীবনই এর জলন্ত প্রমাণ।
সাহাবিদেরও তিনি স্ত্রীকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসায় চাদরে মুড়িয়ে রাখার শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম, যে নিজের স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। আর আমি স্ত্রীদের কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। (ইবনে মাজাহ ও তিরমিজি)
চলুন আজকে জেনে নেই রাসুল (আ.)-এর এমন ১০টি অসাধারণ সুন্নত। যেগুলো ব্যক্তিগত জীবনে কেউ যদি চর্চা করে তাহলে দাম্পত্য জীবনে সত্যিকারে সুখী মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন।
১. স্ত্রী যে স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করে সেই স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করা সুন্নাহ।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি পান করতাম এবং পরে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবশিষ্টটুকু প্রদান করলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম তিনিও পাত্রের সে স্থানে মুখ লাগিয়ে পান করতেন। আবার আমি ঋতুবতী অবস্থায় হাড় খেয়ে তা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দিলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়েছিলাম তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে খেতেন। (মুসলিম ৫৭৯)
২. স্ত্রীর কাছ থেকে চুল আঁচড়ে নেওয়া সুন্নাহ
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘আমি হায়েজ (ঋতুবতী) অবস্থায় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথা আঁচড়ে দিতাম।’ (বুখারি ২৯৫)
৩. স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে ঘুমানো সুন্নাহ
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন যে, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এক সফরে বের হলাম। বাইদা কিংবা যাতুল জাইশ নামক স্থানে পৌঁছার পর আমার গলার হার হারিয়ে গেল। তা খোঁজার জন্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে অবস্থান করলেন এবং লোকেরাও তাঁর সঙ্গে অবস্থান করল। সেখানেও কোনো পানি ছিল না এবং তাদের সঙ্গেও পানি ছিল না। এরপর লোকেরা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এলো এবং বলল, ’আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা যা করেছেন আপনি তা দেখেছেন কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সকল লোককে আটকিয়ে রেখেছেন, অথচ সেখানেও পানি নেই আবার তাদের সঙ্গেও পানি নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উরুতে (রানে) মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন।
এমতাবস্থায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এলেন এবং বললেন, তুমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সকল লোককে আটকে রেখেছো অথচ সেখানেও পানি নেই আবার তাদের সঙ্গেও পানি নেই। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন যে, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাকে দোষারোপ করলেন এবং আল্লাহ যা চেয়েছেন তা বলেছেন এবং তার অঙ্গুলি দিয়ে আমার কোমরে ধাক্কা দিতে লাগলেন, আমার কোলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থানই আমাকে নড়াচড়া করতে বাধা দিল। পানিবিহীন অবস্থায় ভোরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুম থেকে উঠলেন। তখন আল্লাহ তাআলা তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করলেন, তখন সবাই তায়াম্মুম করল। তখন উসাইদ ইবনু হুযাইর বললেন, হে আবু বকর-এর বংশধর! এটাই আপনাদের কারণে পাওয়া প্রথম বারাকাত নয়।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, যে উটের উপর আমি ছিলাম, তাকে আমরা উঠালাম তখন দেখি হারটি তার নিচে।’ (বুখারি ৪৬০৭)
৪. স্ত্রীর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করা সুন্নাহ
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, তিনি এক সফরে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি তার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করে তার আগে চলে গেলাম। এরপর আমি মোটা হয়ে যাওয়ার পর তার সঙ্গে আবারও দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম, এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে দিলেন, বিজয়ী হলেন। তিনি বলেন, এ বিজয় সেই বিজয়ের বদলা।’ (আবু দাউদ ২৫৭৮)
৫. স্ত্রীর সঙ্গে গোসল করা সুন্নাহ
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, আমি ও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই পাত্র (কাদাহ) থেকে (পানি নিয়ে) গোসল করতাম। সেই পাত্রকে ফারাক বলা হতো।’ (বুখারি ২৫০)
৬. স্ত্রীর কোলে হেলান দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করা সুন্নাহ
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কোলে হেলান দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েজের অবস্থায় ছিলাম।’ (বুখারি ২৯৭)
৭. স্ত্রীর মেওসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজা সুন্নাহ
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন যে, ‘আবদুর রহমান ইবনু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন। তখন আমি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমার বুকে হেলান দেয়া অবস্থায় রেখেছিলাম এবং আবদুর রহমানের হাতে তাজা মিসওয়াকের ডাল ছিল যা দিয়ে সে দাঁত পরিষ্কার করছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। আমি মিসওয়াকটি নিলাম এবং তা চিবিয়ে নরম করলাম। তারপর তা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দিলাম। তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দিয়ে দাঁত মর্দন করলেন। আমি তাকে এর আগে এত সুন্দরভাবে মিসওয়াক করতে আর কখনও দেখিনি। এ থেকে অবসর হয়েই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উভয় হাত অথবা আঙ্গুল ওপরে উঠিয়ে তিনবার বললেন, উচ্চে সমাসীন বন্ধুর সঙ্গে (মিলিত হতে চাই) তারপর তিনি ইন্তিকাল করলেন। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার বুক ও থুতনির মাঝে ইন্তিকাল করেন।’ (বুখারি ৪৪৩৮)
৮. ঘর থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রীকে চুমু দেওয়া সুন্নাহ
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এক স্ত্রীকে চুমা দিলেন, এরপর নামাজ আদায়ের জন্য বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু অজু করেননি। আমি (উরওয়াহ) বললাম, আপনই সেই ব্যাক্তি। এতে তিনি (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা) হাসলেন।’ (ইবনে মাজাহ ৫০২)
৯. স্ত্রীর প্রশংসা করা সুন্নাহ
হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পুরুষের মধ্যে অনেকেই পূর্ণতা অর্জন করেছেন। কিন্তু নারীদের মধ্যে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া এবং ইমরানের কন্যা মারইয়াম ছাড়া আর কেউ পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়নি। তবে আয়েশার মর্যাদা সব নারীর উপর এমন, যেমন সারীদের (গোশতের সুরুয়ায় ভিজা রুটির) মর্যাদা সকল প্রকার খাদ্যের উপর।’ (বুখারি ৩৪১১)
১০. স্ত্রীর কাজে সহায়তা করা সুন্নাহ
হজরত আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের (কাজে) সহায়তা করতেন। আর নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য চলে যেতেন।’ (বুখারি ৬৭৬)