রাসুল ও চার খলিফার যুগে কীভাবে তারাবি পড়া হতো

মুফতি বিলাল হুসাইন খান
প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৫, ০১:৫২ পিএম

পবিত্র রমজান মুমিনের ঈমান-আমলের তারবিয়তের বিশেষ মাস এবং খায়র ও বরকতের বসন্তের মাস। এ মাস পাপ মোচনের, ঝগড়া বর্জনের, তাকওয়া অর্জনের, নেকী বাড়ানোর, কুরআনের হক আদায়ের, সর্বোপরি আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত।
আল্লাহপাক কুরআনে আয়াত নাজিল করে রমজানের দিনে ‘সিয়ামে রমজান’ তথা রোজা ফরজ করেছেন। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসের মাধ্যমে রাতের বেলায় ‘কিয়ামে রমজান’ তথা তারাবিকে সুন্নত বানিয়েছেন।
বিভিন্ন হিকমতের কারণে তারাবির নামাজকে ফরজ করা হয়নি, বরং সুন্নতে মুআক্কাদাই রাখা হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবির নামাজের প্রতি উৎসাহিত করতেন, অপরিহার্য করেননি।
তিনি ইরশাদ করতেন- যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের আশায় নামাজ আদায় করে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য যে, অনেক মসজিদেই দেখা যায় নামাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য রুকু-সিজদা ইত্যাদিতে তাড়াহুড়ো করা হয়। এটা সংশোধন করা চাই। এভাবে এতো দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত করা হয় যে, হরফগুলোর সঠিক উচ্চারণ হয় না এবং ঠিকমতো বোঝা যায় না। এতো দ্রুত পড়ে খতম করার চেয়ে শান্তভাবে সূরা তারাবি পড়াই উত্তম।
রাসুল (সা.)-এর যুগে তারাবি
১. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রমজানের) এক রাতে মসজিদে তারাবি পড়লেন। সাহাবায়ে কেরামও তার সঙ্গে নামাজে শরীক হলেন। এ বিষয়ে লোকদের মাঝে আলোচনা হলো। ফলে (দ্বিতীয় রাতে) মুকতাদির সংখ্যা বেড়ে গেল। আরো আলোচনার ফলে তৃতীয় রাতে মসজিদ ভর্তি মুকতাদি হলো। চতুর্থ রাতে মসজিদের ধারণ-ক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক হলো। (তবে এ রাতে তারাবির জন্য তিনি মসজিদে আসলেন না।) ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে এসে নামাজ শেষে বললেন, রাতে আমার জন্য তোমাদের অপেক্ষার বিষয়ে আমি অবগত। কিন্তু (না আসার কারণ হলো) আমার আশংকা হয়েছে যে, তোমাদের উপর তারাবি ফরজ হয়ে যাবে। আর তোমরা তা পালনে অক্ষম হবে।
২. ছা’লাবা বিন আবু মালেক কুরাযী রহ. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরমজানের এক রাতে বের হয়ে কিছু সাহাবাকে মসজিদের এক কোনায় নামাজ পড়তে দেখলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কী করছে? একজন উত্তর দিলেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তাদের কুরআন বেশি মুখস্থ নেই। আর উবাই ইবনে কা’ব রা. ভালো কারী ও হাফেজ। তাই তার পিছনে তারা তারাবি পড়ছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা ভালো কাজ করেছে বা সঠিক করেছে।
এভাবে আরো কিছু হাদিস থেকে অনিয়মিত ও সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-কানুন ব্যতীত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রা. তারাবির নামাজ জামাআতের সঙ্গে আদায় করার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কোনো বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা তিনি বিশ রাকাআত বা কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যায় তারাবি পড়ার কথা প্রমাণিত নয়।
তাছাড়া বুখারি-মুসলিমসহ প্রায় হাদিসের কিতাবে রয়েছে যে, ইমাম যুহরী রাহ. বলেছেন- তারাবির বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নিয়ম ও জামাতের ব্যবস্থা করা ছাড়া দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
আবু বকর রা.-এর যুগে তারাবি
হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর খিলাফতকাল মাত্র দু’বছর। এ স্বল্পতম সময়ে বিভিন্ন ফিতনা মোকাবিলায় বেশি ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তারাবির বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ হয়ে ওঠেনি বা এ বিষয়ে কোনো চিন্তা তার মনে আসেনি। কাজেই তার খিলাফতকালেও বিষয়টি আগের মতোই থেকে যায়।
উমর রা.-এর যুগে তারাবি
এভাবে হজরত উমর রা.-এর সাড়ে ১০ বছর খিলাফতকালের শুরুতেও (এক রমজান) পূর্বের অবস্থাই ছিলো। অতঃপর হজরত উমর রা. ১৪ হিজরীতে অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের জীবদ্দশায় তারাবির বিষয়ে দুটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এক. ফরজ নামাজের মতো এক ইমামের পেছনে তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার ব্যবস্থা। যেমন সহিহ বুখারিতে এসেছে- রমজানের এক রাতে উমর রা. মসজিদে তাশরীফ নিয়ে যান এবং দেখতে পান যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামাআত হচ্ছে। তিনি চিন্তা করলেন সকল নামাজিকে এক ইমামের পেছনে একত্র করে দেওয়া উচিত। অতঃপর তিনি এই আদেশ জারি করে দেন এবং উবাই ইবনে কা’বকে রা. ইমাম বানিয়ে দেন।
দুই. তারাবির রাকাআত সংখ্যা ২০ নির্ধারণ। যেমন ইমাম বুখারি (মৃত্যু ২৫৬ হি.) রহ.-এর শায়খ আলী ইবনুল জা’দ রহ. (মৃত্যু ২৩০ হি.) স্বীয় ‘মুসনাদে’ সহিহ সূত্রে বর্ণনা করেন- হজরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেন, তারা (সাহাবা ও তাবেয়ীন) উমর রা.-এর যুগে রমজান মাসে বিশ রাকাআত (তারাবি) পড়তেন এবং শতাধিক আয়াত বিশিষ্ট সূরাসমূহ পড়তেন।
বর্ণনাটির সূত্র নিঃসন্দেহে সহিহ। কেননা ইমাম বুখারির উস্তাদ আলী ইবনুল জা’দ রহ. যাদের থেকে বর্ণনা করেছেন, তারা সবাই বুখারি-মুসলিমের বর্ণনাকারী।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন- যখন উমর রা. উবাই ইবনে কা’বকে রা. লোকদের ইমাম বানিয়ে দিলেন, তিনি তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবি ও তিন রাকাআত বিতর পড়তেন।
উসমান রা.-এর যুগে তারাবি
হজরত উসমান রা.-এর খিলাফতকাল ১২ বছর। এ ১২ বছরে কীভাবে তারাবি পড়া হতো, সে সম্পর্কে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে হ্যাঁ, হিজরী ১৪ সাল থেকে হজরত উমর রা.-এর শাহাদত পর্যন্ত মোট ১০ বছর হজরত উসমান রা.-এর উপস্থিতিতেই ২০ রাকাআত তারাবি হয়েছে। তিনি এর উপর কোনো আপত্তি করেননি। আর তিনি যদি তার খিলাফতকালে নতুন কোনো ফরমান জারি করতেন, তাহলে অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় তা সংরক্ষিত থাকতো।
আলী রা.-এর যুগে তারাবি
হজরত আলী রা.-এর ৫ বছর খেলাফতকালেও তারাবি ২০ রাকাআত পড়া হতো।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু আবদুর রহমান আস-সুলামী রাহ.-এর বিবরণ- আলী রা. রমজানে কারীগণকে ডাকলেন এবং তাদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবি পড়তে আদেশ করলেন। আর তিনি বিতর পড়াতেন।