ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে ফারুক (সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপরেখা দান করেছেন; তা বাস্তবায়নে তিনি অনন্যসাধারণ অবদান রাখেন। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু আইন, বিধান ও প্রতিষ্ঠান তার হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) (৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ – ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। হজরত আবু বকরের (রা.) মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
ওমর (রা.) ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে ফারুক (আরবি: الفاروق; সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়।
আমিরুল মুমিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম ওমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। নামের মিল থাকার কারণে পরবর্তী কালের উমাইয়া খলীফাহ্ ওমর বিন আব্দিল আযীযকে দ্বিতীয় ওমর হিসেবে সম্বোধন করা হয়।
সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে আবূ বকর (রা.) পর ওমরের অবস্থান। এছাড়াও তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) শ্বশুর, যেহেতু ওমর (রা.) মেয়ে হাফছাহ বিন্তে ওমর ছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর স্ত্রী।
ওমর (রা.) শাসনামলে খিলাফাতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তার শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়। তিনি পূর্বের খ্রিষ্টীয় রীতি বদলে ইহূদিদের জেরুসালেমে বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তার জীবনকর্মে উপর শিবলী নোমানীর রচিত আল ফারুক অন্যতম।
জন্ম ও পরিচয়: তার পুরো নাম আবু হাফস ওমর ইবনুল খাত্তাব বিন নুফাইল বিন আবদুল উজ্জা। মা-বাবা উভয়ের বিবেচনায় তিনি কুরাইশ ছিলেন। ওমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর ১৩ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র কাবাঘরের সন্নিকটে অবস্থিত জাবালে ওমরে ছিল তার বাড়ি।
খিলাফতের প্রতিষ্ঠা
হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় ওমর (রা.) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।মুহাম্মদ (সা.) এর দাফনের প্রস্তুতি চলার সময় কিছু মুসলিম শহরের উপকণ্ঠে সাকিফা নামক স্থানে তার উত্তরসূরির বিষয়ে আলোচনায় বসে। এরপর আবু বকর (রা.), ওমর (রা.) এবং আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এখানে উপস্থিত হন। এসময় আনসারদের মধ্য থেকে দাবি উঠে যে উত্তরসূরি আনসারদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করতে হবে।
ওমর (রা.) এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে উত্তরাধিকার মুহাজিরদের মধ্য থেকে হতে হবে। কিছু গোত্র ইসলামপূর্ব গোত্রীয় নেতৃত্ব ব্যবস্থায় ফিরে যেতে ইচ্ছুক ছিল যাতে প্রত্যেক গোত্রের নেতা গোত্রকে নেতৃত্ব দিত। শেষপর্যন্ত আবু বকরকে (রা.) খলিফা হিসেবে অধিক যোগ্য বলে দাবি করে তার প্রতি ওমর (রা.) আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত সবাই মেনে নেয়।
ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় ওমর (রা.) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ধরা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আবু বকর (রা.) এর যুগ
আবু বকর (রা.) এর শাসনামলে ওমর (রা.) তার একজন প্রধান সচিব ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। রিদ্দার যুদ্ধের সময় প্রথমে তিনি আবু বকর (রা.) কিছু মতের সাথে একমত না হলেও পরে তা মেনে নেন এবং তাকে সহায়তা করেন। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীদের দমন করে আরব উপদ্বীপকে একতাবদ্ধ করা হয়।
ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফিজ শহিদ হলে ওমর (রা.) কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলনের জন্য আবু বকর (রা.) নিকটে আবেদন জানান। আবু বকর (রা.) প্রথমে তাতে রাজি না থাকলেও পরে সম্মত হন। এর ফলে কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়।
আবু বকর (রা.) মৃত্যুর পূর্বে হজরত ওমরকে (রা.) তার উত্তরসূরি নিয়োগ দিয়ে যান। ওমর (রা.) কঠোর প্রকৃতির ছিলেন। তাই অনেকে তাকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে সমর্থন করতে চাননি। তবে এরপরও আবু বকর (রা.) তাকে নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করে যান।
ওমর (রা.) তার ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার এবং দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সদয় আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন।
উল্লেখ করা হয় যে আবু বকর (রা.) তার উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টাদের বলেছিলেন: আমার কোমলতার জন্য তার (ওমর) কঠোরতা ছিল। যখন খিলাফতের ভার তার কাঁধে আসবে তখন সে আর কঠোর থাকবে না। যদি আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে কাকে আমি আমার উত্তরসূরি নিয়োগ দিয়েছি, তবে আমি তাকে বলব যে আপনার লোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছি।
উত্তরসূরি হিসেবে ওমর (রা.) ক্ষমতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে আবু বকর (রা.) অবগত ছিলেন। ওমর (রা.) সম্পূর্ণ বিবাদহীনভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন।
আবু বকর (রা.) মৃত্যূর পূর্বে হজরত ওমরকে (রা.) ডেকে তার অসিয়ত লিখতে বলেন যাতে তিনি ওমরকে (রা.) নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা করে যান। অসিয়তনামায় ওমর (রা.) ইরাক ও সিরিয়া জয়ের অভিযান চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আবু বকর (রা.) সিদ্ধান্ত ইসলামি খিলাফতকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছিল।
২২ আগস্ট আবু বকর (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। একই দিনে ওমর (রা.) খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ওমর (রা.) নিজের খিলাফতের সময়ে ক্ষমতাপ্রাপ্তি পর সকল মুসলিম তাকে বায়াত প্রদান করেন। তার ব্যক্তিত্বের কারণে জনতা তাকে সমীহ করত। মুহাম্মদ হুসাইন হায়কলের মতে ওমর (রা.) প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল তার প্রজা ও মজলিশ আল শুরার সদস্যদের মন জয় করা।
ওমর (রা.) বাগ্মী ব্যক্তি ছিলেন। জনগণের মনে স্থান করে নেয়ার জন্য তার এই দক্ষতা সাহায্য করেছে।
শাসক হিসেবে ওমর (রা.) দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন।ফিদাকের জমির ব্যাপারে তিনি আবু বকর (রা.) নীতির অনুসরণ করেছেন এবং একে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহারের নীতি চালু রাখেন।
রিদ্দার যুদ্ধে কয়েক হাজার বিদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীকে দাস হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল। ওমর (রা.) এসকল বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাদের মুক্তির নির্দেশ দেন। এই ঘোষণা বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে ওমর (রা.) জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল।
ওমর (রা.) সরকার এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এতে খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। পুরো ইসলামিক সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। পাশাপাশি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এসব অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্তশাসিত এলাকা খিলাফতের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হত।
ওমর (রা.) ব্যক্তিগতভাবে ওয়ালিদের নিযুক্ত করতেন। প্রদেশগুলোকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করা হত। পুরো ইসলামিক সাম্রাজ্যে প্রায় ১০০ এর মতো জেলা ছিল। প্রতিটি জেলা বা প্রধান শহর একজন অধস্তন জেলা গভর্নর বা ভাইসর আলেমের দায়িত্বে থাকত। ভাইসর আলেমরা সাধারণত ওমর (রা.) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন তবে প্রাদেশিক গভর্নররাও তাদের নিয়োগ দিতে পারতেন।
প্রাদেশিক স্তরে অন্যান্য অফিসাররা ছিলেন। যেমন:
কাতিব, প্রধান সচিব
কাতিব উদ দিওয়ান, সামরিক সচিব
সাহিব উল খারাজ, রাজস্ব আদায়কারী
সাহিব উল আহদাস, পুলিশ প্রধান
সাহিব বাইতুল মাল, কোষাগার কর্মকর্তা
সাহিব আল খারাজ,রাজস্ব বিভাগীয় অফিসার
কাজি, প্রধান বিচারক
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ালি বা ভাইসর প্রদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি বা উপমহাসেনাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকলেও কিছু প্রদেশে পৃথক সামরিক অফিসার থাকত। প্রতিটি নিয়োগ লিখিত আকারে দেওয়া হত। নিয়োগের সময় গভর্নরদের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করা হত। দায়িত্বগ্রহণের পর গভর্নররা জনতাকে প্রধান মসজিদে জড়ো করে তাদের সামনে দিকনির্দেশনা পড়ে শোনাতেন।
কর্মকর্তাদের প্রতি ওমর (রা.) সাধারণ নির্দেশনা ছিল:
স্মরণ রেখ, আমি তোমাকে জনগণের উপর দিকনির্দেশদাতা ও স্বেচ্ছাচার হিসেবে নিয়োগ দিই নি। আমি তোমাকে একজন নেতা হিসেবে পাঠিয়েছি যাতে জনগণ তোমার উদাহরণ অনুসরণ ও অনুকরণ করতে পারে। মুসলিমদেরকে তাদের অধিকার প্রদান কর যাতে তারা অন্যায়ে পতিত না হয়ে ন্যায় ও সত্যের দিকে পতিত ও ধাবিত হয়। তাদের মুখের উপর নিজেদের দরজা খুলে রাখবে যাতে ক্ষমতাশালীরা দুর্বলদের সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে এবং নিজেকে তাদের চেয়ে উচ্চ মনে হয় এমন কোনো আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে যাতে তাদের প্রতি স্বৈরাচারী শাসক-শোষকরা করে থাকে।
এছাড়াও আরো কিছু বিধিনিষেধ প্রাদেশিক গভর্নর ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উপর জারি করা হয়। প্রধান কর্মকর্তাদেরকে হজ্জের সময় মক্কায় আসতে হত এবং এসময় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ তুলতে পারত। দুর্নীতি রোধ করার জন্য ওমর তার কর্মকর্তাদের উচ্চ বেতন-ভাতা দিতেন। নিজ অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান থাকাবস্থায় গণিমতের সম্পদ ছাড়াও প্রাদেশিক গভর্নররা বার্ষিক পাঁচ থেকে সাতহাজার দিরহাম করে পেতেন।
কিছু ক্ষেত্রে ওমর (রা.) পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন :
হজরত ওমর (রা.) সর্বপ্রথম পাবলিক মিনিস্ট্রি প্রথা চালু করেন যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের রেকর্ড লিপিবদ্ধ করা থাকত। প্রাদেশিক গভর্নর ও রাষ্ট্রপতিদের কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপিও রেকর্ড হিসেবে সুরক্ষিত থাকত।আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনি প্রথম পুলিশ বাহিনী নিয়োগ দেন।জনতা বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে তিনি প্রথম তাদের শৃঙ্খলায় আনেন।
খাল
হজরত ওমরের শাসনামলে বসরা শহর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পানীয় জল ও সেচের জন্য তিনি খাল খননের ব্যবস্থা করেন। আল তাবারির বিবরণ অনুযায়ী শহর পরিকল্পনাধীন অবস্থায় উতবা ইবনে গাজওয়ান প্রথম টাইগ্রিস নদী থেকে বসরা পর্যন্ত খাল খনন করেন। শহর তৈরির পর আবু মুসা আশআরিকে এর প্রথম গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়।
আবু মুসা আশআরি বসরা ও টাইগ্রিস নদীকে সংযোগকারী দুইটি গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন করান। এগুলো হল আল-উবুলা নদী ও মাকিল নদী। সমগ্র বসরা অঞ্চলে কৃষির উন্নয়ন এবং পানীয় জলের সরবরাহের জন্য এই খালদ্বয় মূল ভূমিকা পালন করেছে। ওমর পতিত জমির চাষাবাদের জন্য নীতি গ্রহণ করেন।
যারা এসকল জমি আবাদ করত তাদেরকে এসব জমি প্রদান করা হয়। এই নীতি উমাইয়া আমলেও চালু ছিল। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাল খননের ফলে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে কৃষিক্ষেত গড়ে উঠে
সংস্কার
হজরত ওমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাই বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার জন্য তিনি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করেন। তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন। নতুন বিজিত অঞ্চলে তিনি প্রশাসন গঠন করেন যাতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্র ছিল। তার শাসনামলে বসরা ও কুফা শহরদ্বয় নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। ৬৩৮ সালে তিনি মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী বর্ধিত ও সংস্কার করেন।
নাজরান ও খায়বারের খ্রিষ্টান ও ইহুদিদেরকে সিরিয়া ও ইরাকে চলে যাওয়ার জন্য তিনি নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। তিনি ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে পুনরায় বসতি করার সুযোগ দেন। পূর্বে এই সুযোগ ছিল না। তিনি আদেশ জারি করেন যাতে বলা হয় যে এই খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে এবং তাদের নতুন বসতিতে সমপরিমাণ জমি প্রদান করা হয়। ওমর অমুসলিমদের জন্য হেজাজে তিন দিনের বেশি অবস্থান করায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ওমর সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় বিভাগ হিসেবে গঠন করেন।
ফিকহের ক্ষেতে ওমরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুন্নিরা তাকে একজন শ্রেষ্ঠ ফকিহ হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকে।
৬৪১ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে বাইতুল মাল গঠন করেন। মুসলিমদেরকে বার্ষিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদান করা হত।
নেতা হিসেবে ওমর সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার সমসাময়িক অন্যান্য শাসকদের ব্যতিক্রম হিসেবে তিনি দরিদ্র মুসলিমদের মত জীবনযাপন করতেন। তার শাসনামলে হিজরি বর্ষপঞ্জি প্রণীত হয়।
আল্লাহভীতি: ওমর (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সুচরিত্রের অধিকারী। আল্লাহভীতি, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি বলতেন, ‘তোমরা হিসাব গ্রহণের আগে নিজেদের হিসাব গ্রহণ কোরো এবং তোমাদের আমল পরিমাপ করার আগে নিজেরা পরিমাপ করে দেখো এবং নিজেকে মহাবিচারের জন্য প্রস্তুত করো।’ যদি কোনো কারণে কারো প্রতি তিনি অন্যায় করেছেন, তবে তিনি নিঃসংকোচে তার কাছে অনুতাপ প্রকাশ করতেন।
সাহসিকতা: ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বীর। তিনি সত্য প্রকাশে কখনো ভয় পাননি। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) তার সম্পর্কে বলেন, আমার জানা মতে, ওমর ইবনুল খাত্তাব ছাড়া সবাই গোপনে হিজরত তথা মক্কা ত্যাগ করেছে। তিনি যখন হিজরতের ইচ্ছা করেন, তখন তরবারি ও তীর-ধনুক হাতে নেন এবং কাবাঘরে যান। তিনি তাওয়াফ করেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়েন।
অতঃপর কুরাইশ নেতাদের কাছে গিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি তার মাকে কাঁদাতে চায়, সন্তানকে এতিম ও স্ত্রীকে বিধবা করতে চায় সে যেন আমার সঙ্গে এই উপত্যকার পেছনে সাক্ষাৎ করে।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা: মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্যের বরকতে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী হন। যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীরা তার জ্ঞানের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন মুজাহিদ (রহ.) বলেন, কোনো বিষয়ে মানুষের ভেতর মতবিরোধ হলে তারা ওমর (রা.) কি করে সে দিকে লক্ষ রাখত এবং তারা সে অনুযায়ী আমল করত। আল্লামা শালবি (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি বিচারের ক্ষেত্রে সুদৃঢ় মতামত গ্রহণ করে খুশি হতে চায়, সে যেন ওমর (রা.)-এর কথা গ্রহণ করে। আর আল্লামা ইবনুল মুসাইয়িব (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কেই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী মনে করি।
দানশীলতা: মহান এই সাহাবি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল এবং দুনিয়াবিমুখ। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধের জন্য নিজের সমুদয় সম্পদের অর্ধেক দান করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার বদান্যতার প্রশংসা করেন। খাইবারের যুদ্ধের পর গনিমতের সম্পদ লাভ করলে তা অসহায়, দুস্থ ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ওয়াফক করে দেন। তিনি জায়তুনের তেল ও রুটি খেতেন এবং পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন।
আদর্শ শাসক: মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও ন্যায়পরায়ণ। নেতৃত্বের গুণাবলির জন্যই আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁকে নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করেন এবং জনসাধারণও তাঁকে হৃদ্যতার সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। তিনি সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সমকালীন বিশ্বের প্রতি লক্ষ রাখতেন।
যেমন তিনি রোমান সম্রাটের তুলনায় কম কর নির্ধারণ করেন এবং অক্ষমদের ক্ষমা করার নীতি গ্রহণ করেন। সামরিক জ্ঞানেও ওমর (রা.) ছিলেন অতুলনীয়। তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সামরিক প্রজ্ঞার কারণে স্বল্প সময়ে ইসলামী খিলাফতের সীমানা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
তার শাসনামলে সমগ্র শাম, মিসর ও পারস্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ওমর (রা.)-এর প্রবর্তিত কয়েকটি ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান হলো—
১. প্রশাসনিক বিন্যাস : নতুন নতুন অধিদপ্তর ও বিভাগ খোলার মাধ্যমে তিনি প্রশাসনিক কার্যক্রমগুলোকে বিন্যস্ত করেন। যেমন শিক্ষা বিভাগ, অর্থ বিভাগ, পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগ, বাজার পরিদর্শক বিভাগ ইত্যাদি।
২. রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতিষ্ঠা : ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ‘বায়তুল মাল’ বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতিষ্ঠা করেন। যেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণ করে তা বহুমুখী কল্যাণকর খাতে ব্যবহার করা যায়।
৩. বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা : ওমর (রা.)-এর আগে সাধারণত খলিফা ও তার নিযুক্ত ওয়ালি বা গভর্নর বিচার কার্য সম্পাদন করতেন। কিন্তু তিনি বিচার বিভাগকে পৃথক করেন এবং নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগের বিধান করেন।
৪. কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন : ওমর (রা.) কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং ইসলামে খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে একাধিক খাল ও নালা খনন করেন।
৫. হিজরি সন প্রবর্তন : তিনি পৃথক ইসলামী বর্ষ হিসেবে হিজরি সন প্রবর্তন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের বছরকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করায় এর নাম হিজরি সন রাখা হয়।
২৬ জিলহজ ২৩ হিজরি তিনি মদিনায় একজন আততায়ীর হাতে শহীদ হন। আল্লাহ ইসলামের এই মহান খলিফার উপর রহমতের বৃষ্টি বর্ষন করুন। আমিন।
লেখক: সহকারী প্রধান শিক্ষক, ভাওয়াল ইসলামিক ক্যাডেট একাডেমি, কাপাসিয়া, গাজীপুর