সম্প্রীতির আলো জ্বলুক তাবলিগের আঙিনায়
নূর আহমাদ
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাধারণ মানুষের দিলের জমিনে ইমানের ফুল ফোটানোর মেহনত তাবলিগ। ১৯২০ সালে হজরতজি ইলিয়াস কান্ধলভীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম। একশ বছরের বেশি সময়ে আজ তাবলিগের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
জামাতের ইতিহাসে এক সংকটময়কাল চলছে এখন। সব সংকট কেটে যাক। আলো ফিরে আসুক তাবলিগের ঘরে। এক হয়ে নেক হয়ে আবার তাবলিগে ফিরে আসুক প্রেমের আলো। চলমান সংকট মোকাবিলায় তিন বিশেষজ্ঞ আলেমের মন্তব্য তুলে ধরেছেন নূর আহমাদ
তাবলিগের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি
দুনিয়ায় যদি কেউ প্রেমের মেলা সাজিয়ে যায়, আর মৃত্যুর পর সে মেলা ভেঙে বিভেদের খেলায় জড়িয়ে পড়ে তার সন্তানরা, তখন ওই কবরওয়ালার অন্তর কাচের মতো ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.)-এর দিলের অবস্থাও এখন ফেটে যাওয়া ডালিমের মতো রক্তাক্ত।
রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী, আশরাফ আলী থানবীর মতো শায়েখদের সোহবতে থেকে দ্বীনের প্রতি তার যে দরদ জেগেছে, তাবলিগের মেহনতের মাধ্যমে সে দরদের ফুল ফুটিয়েছেন ভারতের মেওয়াতের জমিনে। মালির দরদ আর মালিকের রহমত যখন ফুলের ওপর পড়ে, সে ফুল তখন আর সাধারণ ফুল থাকে না। তা হয়ে যায় বিশ্ব ফুল। তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। সাধারণ ফুল সময়ের ব্যবধানে মরে যায়। পচে যায়। মিশে যায়। এ ফুল যতই সময় গড়ায়, ততই তাজা হয়, বড় হয়, রং ছড়ায়, রং লাগায়।
আজ থেকে একশ চার বছর আগে হজরতজি ইলিয়াস কান্ধলভী মেওয়াতের জমিনে তাবলিগ নামক যে প্রেমের ফুল ফুটিয়েছিলেন, সে ফুলের সৌরভে এখন বিশ্ব মাতোয়ারা। দুনিয়ার যেখানেই ইসলাম আছে, কুরআন আছে, নবি আছে, সেখানেই হজরতজির তাবলিগ আছে। প্রেম আছে। ভ্রাতৃত্ব আছে। জিকির আছে। ফিকির আছে। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব। স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার। মায়ের সেবা করে না। বাবার কথা শোনে না। সুদ-ঘুসের সঙ্গে জড়িত।
যেনা-ব্যভিচার-মদের আড্ডা সবকিছুতেই ডুবে থাকে-এমন যুবকও তাবলিগের ছোঁয়ায় আমূল বদলে যায়। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, মিষ্টি ব্যবহার, হালাল কামাই, আত্মীয়তা রক্ষা সবদিকেই তার ফুলের সৌরভ। হজরতজির সাজানো বাগানের এ তো সফলতা। হায়! আজ আমাদের দেশে কী হলো! হজরতজির বাগান কীভাবে নষ্ট হয়ে গেল। একে একে সব ফুল ঝরে গেল। কমে গেল। শেষ হয়ে গেল। প্রেম মরে গেল। দ্বীন হারিয়ে গেল। হিংসা বাসা বাঁধল। হানাহানি এসে জড়ো হলো। মারামারি সব শেষ করে দিল। এ থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে আসব, ততই বিশ্ব মুসলমানের কল্যাণ।
আলেম ও সাধারণ সাথি ভাইদের মাঝে দূরত্ব ঘুচে যাক
শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন
চেয়ারম্যান, জামালী তালিমুল কুরআন ফাউন্ডেশন
হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর (রহ.) জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে আলী নদভী (রহ.) লিখেছেন, সর্বক্ষণ দ্বীনের ফিকিরে থাকতেন তিনি। যারা মাদ্রাসায় পড়ে না, আলেমদের সোহবতে আসার সুযোগ হয় না, এমন মানুষের দিলে কীভাবে আল্লাহ ঢোকানো যায়, নবির ইশক জাগানো যায়, সে ফিকির করতেন তিনি। অনেক ভেবেচিন্তে ১৯২০ সালে মেওয়াতে শুরু করেন তিনি তাবলিগের মেহনত।
তার মেহনতের উদ্দেশ্যই ছিল আলেম ও সাধারণ মানুষের মাঝে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেওয়া। এজন্য মাদ্রাসার আলেমকে নিয়ে গিয়েছেন খেতের মানুষের কাছে। আর খেতের মানুষকে নিয়ে এসেছেন আলেমের কদমে। প্রশ্ন উঠেছিল, সাধারণ মানুষ কি দাওয়াতের মেহনতের উপযোগী? জবাবে বলা হয়েছে, এ লোকগুলো ধর্মের জটিল মাসয়ালা নিয়ে মানুষের দুয়ারে যাবে না। তারা দ্বীনের মৌলিক দাওয়াত নিয়ে মানুষের দুয়ারে যাবে। ইমান, নামাজ, রোজা, জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন এ মৌলিক বিষয়গুলোই তাবলিগের আলো।
সে আলো হাতে আলেম-সাধারণ মানুষ সবাইকেই ছুটতে হবে অন্যের কাছে। ভাইয়ের কাছে। বোনের কাছে। মুসলমানের কাছে। অমুসলমানের কাছে। সবার কাছে যে তাবলিগে এক সময় আলো ছিল। প্রেম ছিল। ভাইয়ে ভাইয়ে দরদ ছিল। এখন সেখানে আলো নেই। প্রেম নেই। দরদ নেই। হে তাবলিগের কাণ্ডারিরা! আসুন দ্বীনের স্বার্থে সবাই এক হই। নেক হই। হজরতজির বাগানে আবার চোখের পানি ঢেলে নেকের ফুল ফোটাই। আবার বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিই তাবলিগের সৌরভ। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।
হাফেজ্জি হুজুরের মতো দরদি অভিভাবকের বড় প্রয়োজন!
মাওলানা হাফেজ আল আমিন সরকার
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, চরপাথালিয়া সালমান ফারসি (রা.) মাদ্রাসা, মুন্সীগঞ্জ
ঐক্য ছাড়া কখনোই বড় কোনো মাকসাদ হাসিল হয়নি। ঐক্য ও সংহতি মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আল্লাহতায়ালা ও শেষ নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ইমানের অনিবার্য দাবি হচ্ছে-ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপন। তাওহিদের পরে মুমিনদের যে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তাগিদ দেওয়া হয়েছে তা হলো-ঐক্য। ইসলামি ঐক্যের মূল বিষয় হলো আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও কিতাবুল্লাহ। অর্থাৎ এক আল্লাহর প্রতি ইমান বা বিশ্বাস, আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও সম্পূর্ণ আনুগত্য এবং আল্লাহর কিতাব কুরআন মাজিদের পরিপূর্ণ অনুসরণ।
মহাগ্রন্থ কুরআন কারিমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (কুরআন) সম্মিলিতভাবে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করো। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তরগুলোতে প্রেম দান করেছেন। ফলে তোমরা তার অনুগ্রহে ভ্রাতৃরূপ লাভ করেছ।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১০৩।) ঐক্যের সুফল ও বিচ্ছিন্নতার কুফল বিষয়ে প্রিয় নবিজি (সা.) বলেছেন, ‘সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ দলের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্যের হাত রয়েছে, আর যারা বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হবে, তারা জাহান্নামে যাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস নম্বর ২১৬৭।)
রাসূল (সা.) ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সঙ্গে ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অন্যায় শর্তগুলো মেনে নিয়েও ঐক্য করেছেন-শুধু শান্তি এবং সফলতার জন্য। যার ফলে অল্প কদিনের মধ্যেই দ্বীনের মেহনত মদিনার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, ইসলাম সব সময় শান্তি, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পক্ষে। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আল্লাহর আনুগত্য ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুসরণই একমাত্র পথ। আমাদের প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া উচিত। অথচ আজ আমাদের ভেতর দুনিয়া এবং স্বার্থ ঢুকে গেছে। ইতিহাস সাক্ষী! স্বার্থ এবং দুনিয়া ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে আর কিছুই বিভেদ-ফাটল তৈরি করতে পারেনি।
বিশিষ্ট বুজুর্গ মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) ঘোর দুর্দিনে মুসলমানদের কানে যে সবক বাতলে দিয়েছিলেন, আজ তাবলিগের দুঃসময়েও সে কথাই সমাধানের একমাত্র পথ মনে করি। তিনি বলেছিলেন, ‘নেক হও, এক হও, সুন্নাতের পথে চলো’-সুন্নাত হলো মিলে যাওয়া, জুড়ে যাওয়া। ঐক্যবদ্ধ থাকা, ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করা, অন্য মুসলমানের সম্মান-মর্যাদা বজায় রাখা পবিত্র কুরআন এবং সহি হাদিসের আলোকে সুস্পষ্ট ফরজ। অন্যদিকে গালাগালি করা, বিদ্বেষ ছড়ানো সাধারণভাবেই হারাম। আর ধর্মীয় মোড়কে বিদ্বেষ ছড়ানো তো আরও জঘন্য। হায়! এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে বলা যে ধরনের নোংরা শব্দ চয়ন কানে শুনছি, মারামারি-ফাটাফাটির যে দৃশ্যগুলো চোখে দেখছি, সেসব কল্পনা করতেও শিউরে উঠি।
সূরা হুজুরাতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘মুমিনদের দুটি দল যদি মারামারি-বাড়াবাড়ি-বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে, তাদের মিলিয়ে দাও।’ হায়! হাফেজ্জি হুজুরের মতো দরদি অভিভাবক নেই বলেই আজ এক হয়ে নেক হওয়ার সবক মানুষ পাচ্ছে না।