বিশ্ব সভ্যতায় পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদান
কামরুল হাসান কাওছার
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৯ এএম
ছবি : সংগৃহীত
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সভ্যতা গড়ে উঠে নদী বা সাগরের অববাহিকাকে কেন্দ্র করে। মোটা দাগে বলতে গেলে এর মূল কারণ হলো পানি। কেননা, পানি বা সেচ মানবসমাজকে দিয়েছে জীবনের নিশ্চয়তা আর কৃষির বিকাশ। ভরা বর্ষায় দিয়েছে যাতায়াত ও পণ্য স্থানান্তরের অবারিত সুযোগ। পলি দিয়েছে মাটির উর্বরতা। কৃষিতে বিকাশ এসেছে।
এছাড়া পানি প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণ এবং লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ করতে সহায়তা করছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত পানি একটি সীমিত সম্পদ এবং কোনোক্রমেই প্রকৃতির অন্তহীন দান হিসেবে পানির যথেচ্ছা ব্যবহারের অবকাশ নেই। পানির একক বৈশিষ্ট্যের কারণে এর যেকোনো ব্যবহার অন্য ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। জীবনধারণের জন্য পানির প্রাপ্যতা, পরিমাণগত ও গুণগত উভয় বিচারেই একটি মৌলিক মানবাধিকার। তাই সমাজের কোনো অংশের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে পানির যথাযথ সুষম ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান করতে ইতিহাসের সব শাসককেই দেখা যায় পানির ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে।
তবে পানির এই ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির উদ্ভাবন বা অবদানের একচেটিয়া ক্রেডিট সবসময় ইউরোপিয়নরা নিয়েছে। তারা কখনই সেচ ব্যবস্থা প্রযুক্তির ক্রমোন্নতিতে মুসলিমদের অবদান স্বীকার করে না। অথচ, মুসলিমদের বিজ্ঞান, গণিত ও প্রকৌশলে পাশাপাশি পানি বা সেচ ব্যবস্থায়ও ছিল অনেক অবদান।
মুসলিম সভ্যতার ১০০১ আবিষ্কার বইয়ের তথ্য মতে, একাদশ শতাব্দীর পারস্য গণিতবিদ এবং প্রকৌশলী মুহাম্মাদ আল-কারাজি ‘গুপ্ত পানির উৎস’ খোঁজা নিয়েও কথা বলেছিলেন। তিনি এ সময় পানির উৎস খোঁজার কৌশল, পানি আহরণের কৌশল এবং এসব কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে উপরে যাওয়া রোধ করতে মুসলিম বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ খুঁড়ত। এই সুড়ঙ্গগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল কানাত। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সুড়ঙ্গ নির্মাণ হয়েছিল পারস্যে। দিন দিন কৃষি খাতে যত উন্নতি ঘটতে শুরু করে এবং যতই বেশি ফসল ফলানোর চাহিদা বাড়তে থাকে, পানির প্রয়োজনও বাড়তে থাকে।
এ চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বহু কানাত নির্মাণ করা হয়। গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কানাত খনন একেবারে জরুরি হয়ে পড়েছিল। এরপর স্পেনের কর্ডোভাতে কানাত খনন পদ্ধতি চালু হয় এবং এতে করে শহরে ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য পানি সরবরাহ শুরু হয়।
পারস্য রাজ্য ও বর্তমান আফগানিস্তানে হাজারো কুয়া স্থাপন করা হয়েছিল এবং এই কুয়াগুলো কানাত বা সুড়ঙ্গ দ্বারা সংযুক্ত ছিল। মাইলের পর মাইল অবিচ্ছিন্নভাবে পানি সরবরাহের উপযোগী করে এই কানাতগুলোকে বিশেষভাবে তৈরি করা হতো। কোনো কোনো এলাকায় এই কানাত পাথরের ওপর একটি ছোট নদী মনে হলেও ভিন্ন ভূখণ্ডে এটি ভিন্ন রূপ নিত। আলজেরীয় সাহারা ভূখণ্ডে ‘ফোগারাস’ নামক এ রকম একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের চ্যানেল ছিল। সেখানকার কৃষকরা একটি পানিঘড়ি ব্যবহার করে পানির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করত।
বিখ্যাত ওই বইটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ইরানের বেশ কিছু অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং আধুনিক সেচের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক কৃষকই বর্তমান সময়েও এই কানাত ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকেন। শিরাজের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে এখনো ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ এবং কুয়া থেকে পানি আহরণ করা হয়। এই অঞ্চলগুলোর জলবায়ু এবং পানির স্বল্পতাতে আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাব আধুনিক সময়ের মতোই প্রাচীন যুগেও পানির নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন ছিল। সে সময়ের কর্তৃপক্ষও তা নিয়ন্ত্রণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইরাকে পানি ব্যবস্থাপনার বড় বড় প্রকল্প সরকার দেখাশোনা করত। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ স্থানীয় পানি উত্তোলন যন্ত্রের মাধ্যমেই পানির চাহিদা মেটাত।
মিশরবাসীর জীবনের প্রতিটি অংশের সঙ্গে মিশে ছিল নীলনদের পানি। এ নদের পানি ব্যবস্থাপনারও প্রয়োজন ছিল প্রকট। ১৪ শতাব্দীর মিসরীয় ইতিহাসবিদ আল-নুয়াইরি এবং আল-মাকরিজি—দুজনই নীলনদের পানি ব্যবস্থাপনা, বাঁধ নির্মাণ ও জলপথ রক্ষণাবেক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
আব্বাসীয় ও মামলুক শাসনামলে সুলতান ও স্থানীয় জমিদাররা বাঁধ পরিচালনাসহ সুড়ঙ্গ খনন এবং পরিষ্কার রাখার পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। ইরাকের সুলতান নিজে বড় অবকাঠামো পরিচালনা করতেন আর অন্যান্য মানুষ ছোটখাটো অবকাঠামো পরিচালনার দায়িত্ব নিত। অধিকাংশ আমির এবং উচ্চশ্রেণির কর্মকর্তাদেরই এ রকম কাজে প্রধান পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। মামলুকদের অধীনে কাশিফ আল-জুসুর পদধারী এক কর্মকর্তাও ছিলেন, যার কাজ থাকত মিসরের প্রতিটি প্রদেশের বাঁধ পর্যবেক্ষণ করা। এ বাঁধগুলোতে ময়লা ফেলা নিষিদ্ধ ছিল। পাশাপাশি পানি আইনের অমান্যকারী এবং যুক্তি-তর্ককারীর আদালতে বিচার করা হতো। কৃষকরা নিজেরাই এসব আদালতের বিচারপতি নির্বাচন করত। এই আদালতের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য ট্রাইব্যুনাল অব দ্য ওয়াটার্স’ এবং প্রতি বৃহস্পতিবার স্থানীয় প্রধান মসজিদের ফটকের সামনে এ আদালত বসত। দশ শতাব্দী পরেও ভ্যালেন্সিয়াতে এই ট্রাইব্যুনাল বসত, তবে তখন এটি ক্যাথেড্রালের সামনে বসত।
১২ শতাব্দীর উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইবনে আল-আওয়্যাম তার রচিত ‘দ্য বুক অব অ্যাগ্রিকালচার’ বইয়ে ডিপ সেচ (অল্প ও প্রয়োজনীয় পরিমাণে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা) সম্পর্কে বলেছিলেন, এই পদ্ধতি পানির অপচয় রোধ করত এবং অতিরিক্ত পানি দেওয়া থেকে বিরত রাখত। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে গাছের গোড়ার কাছে পানি ভর্তি পাত্র রাখতেন এবং পাত্রে বেশ কিছু ছোট ছিদ্র করতেন, যাতে করে পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই পদ্ধতিটি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। মুসলিমরা দক্ষ সিভিল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়াতে পানি ব্যবস্থাপনায় তাদের কোনো সমস্যাই হয়নি। পানির উৎস একটি গিরিসংকট হলেও তারা পানি উত্তোলনের জন্য জটিল যন্ত্র এবং পাম্প ব্যবহার করে সব সমস্যার সমাধান করত।