Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও প্রতিকার

Icon

সানা উল্লাহ মুহাম্মাদ কাউসার

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৩৩ পিএম

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও প্রতিকার

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রণিধানযোগ্য কারণ হিসেবে পবিত্র কুরআনে আমরা দেখি যে, মানুষের কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবেই দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। 

যেমন, আল্লাহ বলেন- ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দেয়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কিছু কিছু কৃতকর্মের ফল প্রদান করে থাকেন, যেন তারা পাপ থেকে ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)।
  
অথচ, আল্লাহ তাআলা নিজ গুনে মানুষের নানাবিধ অপরাধ ক্ষমা করে দেন। 

তিনি বলেন- ‘তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তাতো তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন’। (সুরা আশ-শুরা: ৩০)।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হলো জলবায়ুর অনভিপ্রেত পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবেশের বৈরিতা। তারা পরিবেশের এই বৈরিভাবের জন্য দায়ী করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাবকে। 

প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর উষ্ণায়ন কেন হচ্ছে। এই উষ্ণতা বাড়ার মূল কারণ গ্রিনহাউজ গ্যাসের ইফেক্ট ও উর্ধ্বাকাশে ওজোনস্তরের ঘনত্ব কমে যাওয়া। আটারো শতকের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে মানুষের ব্যবহার্য নানান যন্ত্রপাতি ও কলকারখানাসমূহকেই দায়ী করেন বিজ্ঞান। এক কথায়, মানুষের তৈরি করা প্রযুক্তির প্রত্যক্ষ কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। অর্থাৎ এখানেও মানুষই একমাত্র দায়ী।

পবিত্র কুরআনেও একই প্রসঙ্গই উঠে এসেছে। সুতরাং আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী করতে পারি মানুষের কর্মকাণ্ডকে আর উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে বলতে পারি–

১. বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেনসহ নানা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসে মিশছে, বায়ুমণ্ডলে এসব গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বার্ষিক গড় দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৮৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি। 

ফলে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আশংকাজনক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ঠিক এই কারণেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয় পরিবেশ, যা কুরআনের ভাষ্যমতে স্বভাবতই মানুষের হাতে কামাই করা।

২. পাপকাজ বৃদ্ধি পাওয়া

বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি যেমন হয়েছে তেমনি এর অনিয়ন্ত্রিত ও যথেচ্ছা ব্যবহার মানুষকে নানা ধরণের নতুন নতুন অপরাধে সংযুক্ত করছে। এমনকি, নানা ধরণের পাপ-পঙ্কিলতা প্রয়োগ সহজ হওয়াই অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যা, দুর্নীতি, জালিয়াতি, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

দুর্যোগের রকমফের:

ক. ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, সুনামি: 

ভূমিকম্প সম্পর্কে কুরআনে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা হলো-‘বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের উপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৬৫)। 

কুরআনে আরো রয়েছে- ‘তারপর আমার ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করে ফেলল। ফলে তারা তাদের নিজেদের গৃহেই মৃত অবস্থায় উল্টো হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আল আ’রাফ: আয়াত-৯১)।

বস্তুত, ভূমিকম্প কিয়ামতের আলামতসমূহের মাঝে ছোট একটি আলামতও বটে। কেননা, কিয়ামতের ভয়াবহতার মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। যেমন আল্লাহ বলেন- ‘(সেদিন) প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে পৃথিবী এবং পর্বতমালা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তা বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পর্যবসিত হবে।’ (সুরা ওয়াকিয়া: ৪-৬)। 

এছাড়া অন্যত্র রয়েছে- ‘কিয়ামতের পূর্বে ভূমিধস, চেহারা পরিবর্তন এবং উপরে উঠিয়ে নিক্ষেপ করার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হবে’ (সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হা. ২৮৫৩)।

খ. ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত:

ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা কি নিশ্চিত রয়েছ যে তিনি তোমাদের পৃথিবীর কোথাও ভূ-গর্ভস্থ করবেন না কিংবা তোমাদের ওপর কঙ্কর বর্ষণকারী ঝড়ো হাওয়া (ঘূর্ণিঝড়) প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা তোমাদের কোনো কর্মবিধায়ক পাবে না।’ (সুরা আল ইসরা, আয়াত : ৬৮)। 

অন্যত্র তিনি বলেন- ‘তারপর আমি এই লুত সম্প্রদায়ের ওপর প্রেরণ করেছিলাম প্রস্তর বর্ষণকারী এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ু।’ (সুরা আল কামার: আয়াত-৩৪)।

এছাড়া বৃষ্টি মহান রবের পক্ষ থেকে রহমত। তবে অতিবৃষ্টি পাপাচারের শাস্তি হিসেবেই বর্ষিত হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তাদের ওপর পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। অতএব চেয়ে দেখো, অপরাধীদের কী পরিণাম হয়ে থাকে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৮৪)

আল্লাহ আরো বলেন- ‘আর আমি তাদের ওপর শাস্তির বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। আর যাদের সতর্ক করা হয় তাদের ওপর বর্ষিত বৃষ্টি অতি ক্ষতিকর হয়ে থাকে।’ (সুরা শুআরা, আয়াত: ১৭৩)

গ. খরা/অনাবৃষ্টি:

বৃষ্টিপাত মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমত। তিনি বলেন- ‘আর তিনি আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা তোমাদের জীবিকাস্বরূপ ফলমূল উৎপাদন করেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২২)। 
সুতরাং খরা তথা অনাবৃষ্টির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির নমুনা। কেননা, তিনি বলেন- ‘অতঃপর বলেছি, তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয় তিনি মহাক্ষমাশীল,  তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন...।’ (সুরা নুহ: ১০-১১)।

ঘ. বন্যা, জলোচ্ছ্বাস:

বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাস ও আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা পাপের শাস্তি। হজরত নুহ (আ.) এর অবাধ্য সম্প্রদায়ের উপর বন্যার মত আজাবের বর্ণনা এভাবে এসেছে- ’তারপর মহাপ্লাবন ওদের গ্রাস করে। কেননা ওরা ছিল সীমা লঙ্ঘনকারী। তারপর আমি তাকে ও যারা জাহাজে উঠেছিল তাদের রক্ষা করলাম।’ (সুরা আনকাবুত: ১৪-১৫)।
    
এছাড়া কুরআনে আরো এসেছে- ‘শেষ পর্যন্ত আমি এই জাতিকে পোকামাকড় বা পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত, প্লাবন ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দিয়ে ক্লিষ্ট করি।’ (সুরা আ’রাফ: ১৩৩)।

ঙ. মহামারি:

মহামারি সম্পর্কে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদিসটি হলো- ‘যখন কোনো কওমের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা তা প্রকাশ্যেও করতে শুরু করে তখন তাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে ছিল না।’ (ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ৪০১৯)।
   
সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে মহামারি। এই মহামারি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- ‘তারপর আমি তাদের ওপর রোগব্যাধি, অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা চাপিয়ে দিয়েছিলাম, যেন তারা আমার কাছে নম্রতাসহ নতি স্বীকার করে’ (সুরা আন‌আম: ৪২)।

চ. দুর্ভিক্ষ:

মানুষ যখন অতিমাত্রায় পাপে নিমজ্জিত হবে ও আল্লাহর নাফরমানি করবে, তখন নানাবিধ আজাবের মধ্যে দুর্ভিক্ষও একটি আজাব হিসেবে আপতিত হবে। যেমন কুরআনে এসেছে- ‘ওর অধিবাসীদের আমি দুঃখ, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি এবং অভাব-অনটন দ্বারা আক্রান্ত করে থাকি। উদ্দেশ্য হলো তারা যেন, নম্র এবং বিনয়ী হয়।’ (সুরা আ’রাফ: ৯৪)।

এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য মহান রবের আনুগত্য, তার হুকুম-আহকাম মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন- “জেনে রাখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (সূরা ইউনূস : ৬২)।

এছাড়া রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মহামারিতে পতিত হয় এবং নেকির আশায় সে ধৈর্য্যসহকারে সেখানে অবস্থান করে এবং এ বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাআলার হুকুম ব্যতিত কিছুই হয় না, তাহলে সে শহীদের সওয়াব পায়।’ (বুখারী: হা. ৫৪০২)।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায়:

১. তাওয়াক্কুল করা:

মুসলমানদের সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) রাখা উচিত। তিনি বলেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক: ৩)।

২. ধৈর্যধারণ করা:

যে-কোনো বিপদে ধৈর্যধারণ করা মু'মীনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহান রব বলেন- ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)।

৩. বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করা:

তাওবা ও ইস্তিগফার সম্পর্কে কুরআনে এসেছে- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর সমীপে খাঁটি তওবা করো, এই আশায় যে তোমাদের প্রভু তোমাদের সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন আর তোমাদেরকে এমন উদ্যানসমূহে উপবিষ্ট করবেন যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত থাকবে।’ (সুরা আত-তাহরিম: ০৮)।

এছাড়া, মহানবি (সা.) বলেন, ‘শিগগিরই মহান আল্লাহকে স্মরণ করো, তাঁর কাছে তওবা করো।’ (বুখারি: ২/৩০; মুসলিম: ২/৬২৮)।

৪. সাদকা করা:

সাদকা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে- ‘নিশ্চয়ই সাদকা অপমৃত্যু রোধ করে।’ (তিরমিজি: ৬৬৪; ইবনে হিব্বান: ৩৩০৯)। অপমৃত্যু বলতে ওইসব মৃত্যুকে বোঝানো হয়েছে যা থেকে স্বয়ং নবীজি (সা.) পানাহ চেয়েছেন। তা হলো- ‘পানিতে পড়ে, আগুনে পুড়ে, ওপর থেকে পতিত হয়ে, যুদ্ধ থেকে পলায়নরত অবস্থায় বা এ ধরনের কোনো কারণে মৃত্যুবরণ করা। হঠাৎ মৃত্যুকেও কেউ কেউ অপমৃত্যু বলেছেন।’ (মেরকাত : ৪/১৩৪১)।

৫. সচেতনতা অবলম্বন করা:

ইসলামে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য জোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। বাড়ি-ঘরের আসবাবপত্র দেওয়ালের সাথে এমনভাবে হুক/স্টিকার দিয়ে লাগিয়ে রাখতে হবে যাতে ভুমিকম্পে সেসব গড়িয়ে না পড়ে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দুর্যোগের সময় কে কোন দায়িত্ব পালন করবে সেটা বণ্টন করে দিতে হবে, ফাস্ট এইড বক্স, ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখাসহ সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। 

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, সতর্কতা অবলম্বন করো।’ (সুরা নিসা: ৭১)। 

এছাড়া হাদিসে এসেছে- ‘ইমানদার ব্যক্তি একই গর্তে দুইবার দংশিত হয় না।’ (বুখারি: ৬১৩৩)। 

মহান রব আমাদেরকে সব ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করুন, আমীন!

লেখক: শিক্ষক, ও ইসলাম বিষয়ক গবেষক
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম