Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার উৎস কী ছিল

Icon

মুহাম্মাদ রবিউল হক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪, ০৭:৩১ পিএম

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার উৎস কী ছিল

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) দশ বছরের শাসনামলে ইসলাম অর্ধ পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং বিশ্বের বৃহৎ দুই পরাশক্তি রোম ও পারস্য ইসলামের পতাকাতলে আগমন করে। 

মদীনায় তখন সম্পদ ও জীবনযাত্রার নিত্য নতুন উপকরণের ঢল নেমে আসে। কিন্তু ওমর (রা.) উম্মাহর মাঝে সম্পদ সচ্ছলতার এবং নাগরিক জীবনে আরাম আয়েশ ও বিলাসিতার নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিণাম সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন।  

তাই তিনি নববী প্রশিক্ষণের সরল রেখা থেকে প্রজাদের বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ দেন নি।

তৃতীয় খলিফা ওসমানের (রা.) ১২ বছরের শাসনামলে ইসলামের বিজয় অভিযানের এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং তা স্থল পথের পাশাপাশি সমুদ্রপথেও পরিচালিত হতে থাকে। 

কালিমার পতাকা আটলান্টিক সাগর উপকূলে বার্বারদের মারাকেশ হতে পারস্য উপসাগরের তীর হয়ে চীন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। 

বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে আরবদের ওই অংশ যাদের নববী তরবিয়াতের সৌভাগ্য হয়নি, আয়েশ ও প্রাচূর্যে গা ভাসিয়ে দেয় এবং সম্পদের চোরাবালিতে তাদের স্বভাব ও প্রবৃত্তি আটকা পড়ে যায়।

ওসমান (রা.) যদিও খেলাফত পরিচালনায় নববী মানহাজ হতে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হননি, ন্যায় ও ইনসাফের নীতি পরিত্যাগ করেননি। কিন্ত তার স্বভাব ও প্রকৃতিতে নম্রতা থাকার কারণে সাম্রাজ্যে ফিতনার ঝড়ো হওয়া প্রবেশের বাতায়ন বন্ধ করতে পারেননি। 

গবেষক আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ বলেন, ‘হজরত ওসমানের (রা.) ইসলাম গ্রহণ হতে খেলাফতের দ্বায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত আরব সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল এবং ইসলামি ধারা প্রকৃতি এক ধরনের আন্তর্জাতিক ধারা প্রকৃতির রূপ ধারণ করেছিল। 

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সকল জাতির জীবন পদ্ধতি অতি কাছাকাছি এসে গিয়েছিল।’ (আল আবকারিয়্যাতুল ইসলামিয়্যাহ, পৃ-৭৭০)

ফিতনা চরমে পৌঁছলে ৩৫ হিজরীর শাওয়াল মাসে মিসরীয় একটি দল মদীনা অবরোধ করে বসে এবং বসরা ও কূফা থেকে অন্য একটি দল এসে তাতে যোগ দেয়। 

বিদ্রোহীরা হজরত ওসমানকে (রা.) আপনগৃহে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলো এবং তার জীবন দুর্বিসহ করে ফেলে। 

আলী (রা.) তাদের বুঝিয়ে নিবৃত করার চেষ্টা করেন এবং হাসান-হোসাইন, আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়ের, ইবন ওমর প্রমূখ সাহাবা তনয়দের একটি দল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অবশেষে ওসমানকে (রা.) নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। 

ওসমান (রা.) এর শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসের চরম লজ্জাজনক ও মর্মান্তিক এক অধ্যায় শুরু হয়। তার শাহাদাতের পর সর্বত্র  ফিতনা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যেমন মালা ছিড়ে গেলে পুতি দানা বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। 

এরপর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন হজরত আলী ইবন আবি তালিব (রা.)। তিনি ছিলেন মানবীয় প্রতিভার অভাবনীয় সমাবেশের সুমহান ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তিনি ইতিহাসের চরম ক্রান্তিকালে খেলাফতের দায়িত্ব নিয়ে কঠিন এক অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হোন। 

এক দিকে রাজধানীসহ অধিকাংশ প্রদেশে বিদ্রোহীদের ক্রমাগত চাপ অন্য দিকে ওসমান (রা.) এর কিসাসের দাবিতে তালহা, যুবায়ের, আয়েশা ও মুয়াবিয়ার (রা.) মতো প্রবীণ সাহাবাদের একটি দলের বিদ্রোহ।

আশুরার রোজায় মুছে যায় এক বছরের পাপ

শুরু হয় ইতিহাসের নাজুকতম মুহূর্ত, সাহাবাদের মতবিরোধ, অন্তর্দ্বন্দ্ব যা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাত পর্যন্ত গড়ায়। 

সাহাবাদের এ সব মতবিরোধে উম্মতের জন্য যেমন পরীক্ষা রয়েছে তেমনি রয়েছে শিক্ষা। 

তবে তাদের সম্পর্কে মুমিনদের কর্মপন্থা হতে হবে আলী (রা.) এর ভাষায়, ‘আমি আশা করি যে, আমরা ওই লোকদের অন্তর্ভূক্ত হব যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,আমি তাদের অন্তর হতে বিদ্বেষ দূর করে দিব; তারা ভাই ভাই রূপে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে আসনে অবস্থান করবে।’ (সূরা:হিজর: ৪৭) (আবুল হাসান আলী নদবী, আলী মুরতাযা রা.,পৃ১৬২)

আলী (রা.) এর হাতে বায়াত যখন সম্পন্ন হলো তখন তালহা ও যুবায়ের (রা.)সহ কতিপয় বিশিষ্ট সাহাবী তার কাছে উপস্থিত হয়ে ওসমানের (রা.) কিসাস গ্রহণ ও হদ্দ জারির দাবি জানালেন। 

তখন তিনি এই বলে অপরাগতা প্রকাশ করলেন যে, এরা যথেষ্ট লোকবলের অধিকারী। এই মূহুর্তে তার পক্ষে তা সম্ভব নয়। (ইবন কাসির,আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৭,পৃ-২২৮)

৩৬ হিজরীতে উষ্ট্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং যুদ্ধে আলী (রা.) এর বিজয় হয়। উষ্ট্রের যুদ্ধ ছিল ফুটন্ত পানির টগবগানির মতো, যা হঠাৎ টগবগিয়ে আবার শান্ত-স্থির হয়ে গিয়েছিল। 

কিন্তু আলী ও মুয়াবিয়া (রা.) এর যুদ্ধ ছিল দুটি সমান্তরাল রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংগ্রাম এবং দুটি শক্তিশালী সামরিক শিবিরের সংঘাত। (আলী মিয়া নদভী,আলী মুরতাযা, পৃ১৬৩)

এটা দু’জন ব্যক্তি মাত্রের বিরোধ ছিল না,বরং এ বিরোধ ছিল দুটি ভিন্ন প্রকৃতির শাসন ব্যবস্থার, কিংবা দুটি ভিন্ন চিন্তাধারার; দ্বীনী খিলাফত ও দুনিয়াবি সালতানাতের।  

প্রথমটির ধারক ছিলেন আলী (রা.) আর দ্বিতীয়টি মুয়াবিয়া (রা.)। (আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ,আবকারিয়্যাতুল ইসলামিয়্যাহ, পৃ-৮৯২)

আলী ও মুয়াবিয়া (রা.) উভয়ে ইজতিহাদ করেছেন, একজন  ছিলেন সঠিক আর অন্যজন ভুল করলেও আল্লাহর কাছে ইজতিহাদের প্রতিদান পাবেন। কিন্তু  স্থান-কাল ও যুগের দাবি ও চাহিদা ছিল মুয়াবিয়ার (রা.) দিকে। 

কেননা তার সেনাবাহিনী, শাসনাধীন অঞ্চল ছিল শান্ত ও স্থিতিশীল। পক্ষান্তরে আলী (রা.) চাচ্ছিলেন পরিবেশ পরিস্থিতিকে পূর্ববর্তী তিন খলিফার অনুসৃত পথে পরিচালিত করতে কিন্তু দেশ বিজয়ের বিস্তৃতি, সম্পদের ঢল, নতুন সভ্যতা,সংস্কৃতি ও পরিবেশের দাবি ছিল খিলাফত নয় মুলুকিয়াত। 

হিজরি নববর্ষ শুরু হয়েছিল যেভাবে

তাছাড়া আলী (রা.) এর শিবিরে ছিল অস্থিরতা, অনৈক্য ও বিদ্রোহী মনোভাব। ফলে উষ্ট্রের যুদ্ধের গণিমতের সম্পদকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত আলীভক্ত ‘সাবাঈ’ দের আত্নপ্রকাশ এবং সিফফীনের যুদ্ধের সালিশি নিয়োগ নিয়ে উগ্রপন্থী খারিজিদের আত্নপ্রকাশ ঘটে।

সিফফীন যুদ্ধের পর আলী (রা.) এর নিজ শিবিরের সাবাঈ (শিয়া) ও খারিজিদের বাড়াবাড়ি দমনে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। মুয়াবিয়া (রা.) এর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। 

তিনি যখনই কূফাবাসীকে যুদ্ধের আহবান করেছেন আর তারা অনীহা প্রকাশ করেছে। অবশেষে খারিজি ইবন মুলজিম তাকে খঞ্জর দ্বারা আহত করে এবং এই আঘাতে তিনি শহীদ হোন।

আলী (রা.) শাহাদতের পর মানুষ হজরত হাসান (রা.) এর হাতে বায়াত হোন। হাসান (রা.) ছিলেন শান্ত-শিষ্ট, অন্তর্মুখী স্বভাবের। 

তার পিতা আলী (রা.) যখন সিরিয়াবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হওয়ার মনস্থির  করলেন তখন হাসান (রা.) তার খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলেন, হে পিতা! এ বর্জন করুন, কেননা এতে মুসলমানের রক্তপাত হবে এবং তাদের মাঝে অনৈক্য দেখা দিবে। (ইবন কাসির,আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৭,২২৯)

রাসুল সা. তার সম্পর্কে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন, আমার এ সন্তান হলো সাইয়্যিদ ও নেতা। সম্ভবতঃ আল্লাহ্ তার মাধ্যমে মুসলমানের দুটি দলের মাঝে সমঝোতা করাবেন।

তাই হাসান (রা.) পরবর্তী জীবনের প্রতিটি আচার-আচরণে এবং প্রতিটি বক্তব্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর ভবিষ্যতবাণীর ছাপ প্রকাশ পেয়েছিল। 

অবশেষে কায়স ইবন সাদ ইবন উবাদাসহ কূফাবাসীদের পীড়াপীড়িতে তিনি সিরীয়বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে বের হলেন এবং মাদায়েনে ছাউনি ফেললেন। এখানে তার বাহিনীর মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হলো এবং নিজেরা নিজেদের মধ্যে লুটতরাজ শুরু করে দিল। 

এমনকি হাসান (রা.) এর শামিয়ানা লুট করে নিল এবং যে চাদর বিছিয়ে তিনি বসা ছিলেন সে চাদর ধরে টানাটানি শুরু করল। মুখতার ইবন আবু ওবায়েদ গোপনে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে  হাসান রা. কে কয়েদ করে মুয়াবিয়া রা. নিকট পৌঁছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করল। (ইবন কাসির,আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৮,পৃ-১৪)

বাহিনীর শৃংখলাহীনতা ও অবাধ্যতা দেখে তাদের প্রতি হাসানের (রা.) মন বিষিয়ে উঠলো এবং তিনি মুয়াবিয়া (রা.) এর কাছে সন্ধির জন্য চিঠি লিখলেন। মুয়াবিয়াও (রা.) তাকে সন্ধি ও সমঝোতার জন্য উদ্বুদ্ধ করছিলেন। 

কতিপয় শর্তে এবং মুসলমানদের মাঝে রক্তপাত বন্ধের স্বার্থে তিনি মুয়াবিয়ার অনুকূলে খিলাফত থেকে সরে দাড়ান।

মদিনা থেকে কেন মুসলিম বিশ্বের রাজধানী কুফায় স্থানান্তর করেছিলেন হজরত আলী?

এই ঐতিহাসিক সন্ধির মাধ্যমে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যতবাণীকে সত্য করেছেন, মুসলমানের মাঝে রক্তপাত বন্ধ করেছেন এবং ইসলামি সাম্রাজ্যের সংহতি  দৃঢ় করেছেন।  

হাসান ও মুয়াবিয়া (রা.) মধ্যে যে সন্ধি হয়েছিল তার অন্যতম শর্ত ছিল মুয়াবিয়ার পরে খিলাফত হাসান (রা.) এর হাতে অর্পন করা হবে। কিন্তু সুবিধাবাদীদের দল হাসানকে (রা.) বিষ প্রয়োগে শহীদ করে দেয় যারা নিজেদের স্বার্থে পরবর্তীতে ওমর ইবন আব্দুল আজীজকেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিল। 

মুয়াবিয়া (রা.) ২০ বছর মুসলিম সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দেন এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদান রাখেন। 

তিনি বলতেন, আমি খলিফা নই। তবে ইসলামের প্রথম বাদশাহ। অবশ্য আমার পরে তোমরা বাদশাহদের স্বরূপ বুঝতে পারবে। (শাহ ওয়ালিউল্লাহ,ইযালাতুল খফা,পৃ-১৪৬) 

মুয়াবিয়া (রা.) বলেন,রাসূল সা. আমাকে উদ্দেশ্য করে একদিন বললেন, হে মুয়াবিয়া তুমি যদি রাজত্ব লাভ করো তবে উত্তম আচরণ করবে। এ বাণী শোনার পর হতে আমি খিলাফত লাভের আশা পোষণ করে আসছিলাম।

লেখক: লেকচারার, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম