তীব্র গরমেও কাবার মাতাফ ঠাণ্ডা থাকে যে কারণে
তানজিল আমির
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৪, ১১:২০ এএম
যারা ওমরাহ বা হজ পালন করতে গিয়েছেন, তারা জানেন, কাবা শরিফের মাতাফ (যেখানে তাওয়াফ করা হয়) খোলা আকাশের নিচে। প্রচণ্ড রোদে যখন চামড়া পুড়ে যাওয়ার জোগাড়, সে মুহূর্তে তাওয়াফ করতে গেলে পায়ে কোনো কষ্ট অনুভূত হয় না, বরং পায়ের পাতায় বেশ প্রশান্তির অনুভূতি হয়।
অপূর্ব এই নির্মাণের কারিগর মিসরীয় স্থপতি ড. মোহাম্মদ কামাল ইসমাইল। ১৯০৮ সালে জন্ম নেওয়া এ স্থপতি মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর নকশা করেন এবং তা পুন:নির্মাণ করেন।
কামাল ইসমাইল মিসরের হাইস্কুল থেকে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং সবচেয়ে কম বয়সে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন।
এরপর তিনি ইউরোপে যান ইসলামিক স্থাপত্যকলা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জ্ঞান অর্জনের জন্য।
এরপর তিনিই প্রথম প্রকৌশলী হিসেবে হারামাইন শরীফাইনের সবরকম নকশা ও পুন:নির্মাণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
এ বিষয়ে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অসাধারণ দক্ষতা থাকলেও, এই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য তিনি কোন পারিশ্রমিক নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
এমনকি বাদশাহ ফাহাদ এবং বিন লাদেন কোম্পানি শত চেষ্টা করেও তার তৈরি করা নকশা ও নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানের জন্য তাকে এক পয়সাও দিতে পারে নি।
তার প্রশ্ন ছিল, আমি কেন পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র জায়গায় কাজ করার জন্য টাকা নেব, তাহলে শেষ বিচারে আমি আল্লাহকে কী জবাব দেব?
কামাল ইসমাইলের পুরোটা জীবন বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনকে গোপনীয় রাখতে পছন্দ করতেন, এ কারণে তার বেশিরভাগ সময় কাটতো ইবাদত করে।
তিনি যখন মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর নকশা ও পুন:নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন সেসময় তার বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে।
এরপর তিনি তার বাকি জীবন পুরোটা এসব পবিত্র জায়গায় কাজ করে কাটিয়ে দেন এবং সেটা সম্পর্কে গণমাধ্যমকে কিছু না জানিয়েই।
তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ৪৪ বছর বয়সে। তার স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, এরপর তিনি আর কখনো বিয়ে করেন নি, এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজেকে আরাধনার কাজে সমর্পন করেন।
মোহাম্মদ কামাল ১০০ বছরের বেশি সময় বেঁচে ছিলেন।
মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর অসাধারণ নকশা ছাড়াও, ভবনগুলো পুন:নির্মাণে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তা ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য।
হারামাইন (মক্কা-মদিনা) সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ভার দেওয়ার পর কামাল ইসমাইল চেয়েছিলেন, তাওয়াফকারীদের আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য মসজিদুল হারামের মেঝে এমন কোনো মার্বেল পাথরে ঢেকে দিতে, যার বিশেষ তাপ শোষণের ক্ষমতা আছে। অনেক গবেষণার পর এ রকম মার্বেল পাথরের সন্ধান পাওয়া যায় গ্রিসের ছোট্ট একটি পাহাড়ে। আর কোথাও সে মার্বেলের ভালো মজুত পাওয়া যায়নি।
কামাল ইসমাইল গ্রিসে গিয়ে মার্বেল কেনার চুক্তি সই করেন। সাদা মার্বেলের মজুত চলে এলে সেগুলো দিয়ে বিশেষ নকশায় মসজিদুল হারামের মেঝে গড়ে তোলা হয়। এই ঘটনার ১৫ বছর পর সৌদি সরকার কামাল ইসমাইলকে আবারও ডেকে মদিনার মসজিদে নববির চারপাশের চত্বরও একইভাবে সাদা মার্বেল দিয়ে ঢেকে দেওয়ার দায়িত্ব নেন।
গ্রিসে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ১৫ বছর আগে পাহাড়টির বাকি পাথর বিক্রি হয়ে গেছে।
বিমর্ষ কামাল ইসমাইল এ কথা শুনে হাতে থাকা কফি পর্যন্ত শেষ করতে পারেননি। পরের ফ্লাইটে তিনি মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ফিরে আসার আগে বাকি মার্বেল পাথরের ক্রেতার নাম-ঠিকানা জানতে চান। তাকে বলা হয়, ১৫ বছর আগের লেনদেনের তথ্য বের করতে সময় লাগবে। পেলে জানানো হবে।
পরদিন তাকে জানানো হলো, ক্রেতার নাম-ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেছে। কাগজের তথ্য অনুযায়ী ক্রেতা এক সৌদি কোম্পানি।
স্থপতি কামাল ইসমাইল সেদিনই সৌদি আরবে ফিরে যান। ক্রেতা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে জানতে চান, ১৫ বছর আগে গ্রিস থেকে কেনা সেই মার্বেল পাথর দিয়ে তারা কী করেছেন। ভদ্রলোক প্রথমে সহসা কিছুই মনে করতে পারলেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই সাদা মার্বেলের পুরো আমদানিটাই পড়ে আছে। কোথাও ব্যবহার করা হয়নি।
এ তথ্য শুনে কামাল ইসমাইলের চোখ থেকে শিশুর মতো অশ্রু ঝরতে শুরু করল। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভদ্রলোক তার কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি পুরো ঘটনা খুলে বললেন।
পরে ড. কামাল ওই কোম্পানিকে সৌদি সরকারের পক্ষে একটি চেক দিয়ে তাতে ইচ্ছেমতো অংক বসিয়ে নিতে বলেন। কিন্তু কোম্পানির মালিক যখন জানলেন, এই সাদা মার্বেল পাথর মসজিদে নববির চত্বরে বসানো হবে, তখন তিনি চেক নিতে অস্বীকৃতি জানান।
তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে দিয়ে এটা কিনিয়েছিলেন, আবার তিনিই আমাকে এর কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন।’ সেই মার্বেল পাথর রাসুল (সা.)–এর মসজিদের উদ্দেশ্যে এসেছিল। সেই সাদা পাথর দিয়ে মসজিদে নববির চত্বরও মুড়ে দেওয়া হয়।
ইতিহাসে অসংখ্যবার মসজিদুল হারামের আকার বর্ধিত করা হয়, যাতে প্রতি বছর হজ ও উমরাহ পালনের জন্য আসা অসংখ্য মুসল্লিদের এতে জায়গা দেওয়া যায়।
বাদশাহ ফাহাদের সময়কালে এটিকে বর্ধিত করার পর মসজিদটির পুরো এলাকার আয়তন দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৫৬ হাজার আটশ বর্গমিটার।
সাধারণ সময়ে এটি আট লাথ ২০ হাজার মুসল্লিকে জায়গা দিতে সক্ষম। তবে হজের সময় কিংবা মুসলিমদের পবিত্র মাস রমজানে এখানে ১০ লাখেরও বেশি মুসল্লি জায়গা পেয়ে থাকেন।