আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল থেকে শুরু হওয়া এ কুরবানির ইতিহাস মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-এর মহান আত্মবিসর্জনে উজ্জ্বল, যা কিয়ামত পর্যন্ত অম্লান থাকবে।
স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলমান নারী-পুরুষ যদি ‘নিসাব’ পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকেন, তাদের পক্ষ থেকে একটি কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক। জাকাতের মতো এক বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নয় বরং কুরবানির দিনগুলো জিলহজ মাসের ১০-১৩ তারিখে প্রয়োজন অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি থাকলেই কুরবানি আদায় করা ওয়াজিব হবে। নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা ও ব্যবসার পণ্য বা সম্পদ।
কুরবানির শরয়ি মর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন মাজহাবের বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি মাজহাব মতে কুরবানি করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। বিনা ওজরে ছেড়ে দেওয়া মাকরুহ।
ইমাম শাফেয়ির বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল উম্মে’ লেখা আছে, ‘কুরবানি করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, ছেড়ে দেওয়া পছন্দনীয় নয়।’ (কিতাবুল উম্ম, ৩য় খণ্ড, ২৫৫ পৃষ্ঠা।)
মালেকি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহ গ্রন্থ ‘আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা’য় ইমাম মালেক (রহ.)-এর বরাতে লেখা হয়েছে, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি না করা আমার পছন্দ নয়।’ (আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা, ৭০ পৃষ্ঠা।)
কুরবানির বিধানগত স্তর সম্পর্কে হাম্বলি মাজহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল মুগনি’তে বলা হয়েছে, ‘অধিকাংশ আলেমদের মত হচ্ছে কুরবানি করা সুন্নাত, ওয়াজিব নয়। (আল মুগনি, ১৩ খণ্ড, ১২২ পৃষ্ঠা।)
এসব বিজ্ঞ আলেম কুরবানিকে সুন্নত বলার দলিল হিসাবে প্রিয় নবির (সা.) একটি হাদিস উল্লেখ করেন। যেখানে রাসূল (সা.)-এর বরাতে বলা হয়েছে, ‘যাদের কুরবানি করার ইচ্ছা আছে জিলহজ মাস শুরুর হওয়ার পর তারা যেন নিজেদের নখ, চুল ইত্যাদি না কাটে।’ (মুসলিম শরিফ।)
এ হাদিসের ভাষা থেকে বোঝা যাচ্ছে, কুরবানি করা আবশ্যক নয় বরং ঐচ্ছিক। যদি আবশ্যক হতো তাহলে রাসূল (সা.) ‘যাদের কুরবানি করার ইচ্ছা আছে’ এ ধরনের কথা বলতেন না।
কুরবানি সম্পর্কে আমাদের মাজহাবের ইমাম ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর ফতোয়া হলো কুরবানি করা ওয়াজিব। সালফে সালেহিনদের মধ্যে ইমাম রাবিয়াতুর রায়, আওজায়ি, লাইস বিন সাদ মিশারি, সুফিয়ান সাওরি, ইবরাহিম নাখয়ি, মুজাহিদ, মাকহুল শাবী (রহ.) কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়েছেন।
ইমাম মালেক (রহ.) এক মতেও কুরবানি ওয়াজিব ফতোয়া পাওয়া যায়।
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার দলিল হিসাবে সূরা কাওসারের এ আয়াত দুটি উল্লেখ করা হয়-‘হে নবি! নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি। তাই আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন।’ (সূরা কাওসার, আয়াত ১-২)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যা হলো, ‘হে রাসূল! আপনাকে আমি ‘কাওসার’ নামক নেয়ামত দান করেছি। তাই আপনি ঈদের নামাজ আদায় করুন এবং ‘নহর’ তথা কুরবানি করুন ওই প্রভুর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এবং তারই নামে। আল্লাহর এ নির্দেশের কারণে ঈদের নামাজ যেমন ওয়াজিব, কুরবানিও ওয়াজিব।’
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে হাদিসের দলিল হলো, আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নম্বর ৩১২৩।)
ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) বলেন, ‘হাদিসটি কুরবানি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে কঠিন ধমকি আর এমনটি হয় ওয়াজিব তরককারীদের ক্ষেত্রে। হাদিসটিকে ইমাম হাকেম সহিহ বলেছেন। ইমাম যাহাবি তালখিসেও সহিহ বলেছেন। ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) ফাতহুল বারিতে হাদিসটি সহিহ বলে রায় দিয়েছেন। আল্লামা আইনি বলেন, হাদিসটির সনদ বুখারি-মুসলিমের সমতুল্য।
হজরত জাবের (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) মদিনায় ঈদের নামাজ পড়িয়েছেন। কিছু লোক নামাজের আগেই কুরবানি করে ফেলেছেন এ ধারণায় যে, হয়তো রাসূল (সা.)ও কুরবানি করে ফেলেছেন; বিষয়টি জানতে পেরে রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন, যারা নামাজের আগে কুরবানি করেছে; তাদের অবশ্যই আবার কুরবানি করতে হবে। আর তোমরা কেউ রাসূলের আগে কুরবানি করবে না।’ (মুসলিস, হাদিস নম্বর ১৯৬৪।) এ হাদিসও প্রমাণ করে কুরবানি করা ওয়াজিব। যদি কুরবানি ওয়াজিব না হতো, তাহলে রাসূল (সা.) আবার কুরবানির আদেশ দিতেন না।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) মদিনা শরিফে দশ বছর অবস্থানকালে প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস নম্বর ১৫০৭।)