রাসূলের (সা.) ভাষণ ও পত্রাবলীতে মানবপ্রেম
মুফতি জহীর ইবনে মুসলিম
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ০৮:৩৫ পিএম
হজরত আদম আ. থেকে রাসূলে করিম সা. পর্যন্ত হযরত আম্বিয়া আ.-এর একটি সুমহান ধারা চলে এসেছে। সে ধারার মূল ভাব ছিল মানুষের কাছে আল্লাহ্ তায়ালার একত্ববাদের দাওয়াত পৌঁছে দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাওহীদের পতাকাতলে সমবেত করা। বিভিন্ন পন্থায় তারা চেষ্টা করেছেন সর্বাত্মকভাবে।
এ ধারার সর্বশেষ, মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন রাসূলে খোদা হজরত মুহাম্মাদ সা.। তিনি ছিলেন কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য বিশ্ববাসীর জন্য নবীয়ে রহমত। সে হিসেবে তার দায়িত্বও ছিল অন্যদের তুলনায় অনেক গুণ বেশি।
তার প্রধানতম দায়িত্ব ছিল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে তাবৎ মানুষের কাছে কুরআনে করিমের বাণী তথা ইসলামের দাওয়াত পৌছে দেয়া। তাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, হে নবী! আপনার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে, আপনার পালনকর্তার পক্ষ হতে তা পৌঁছে দিন, (সূরা মায়িদা)।
এ গুরু দায়িত্বের ব্যাপারে খোদ নবীয়ে করিম সা. ইরশাদ করেছেন, হে লোক সকল! আল্লাহতায়ালা আমাকে বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আসমান জমিনের পালনকর্তার পয়গাম বিশ্বের তাবৎ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমার দায়িত্ব।
আলোচ্য গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য রাসূল কারিম সা. ছিলেন পাগল পারা। এ লক্ষ্যেই তিনি সদা পেরেশান থাকতেন। কুরআনের মর্মবাণী শিক্ষাদান, মৌখিক উপদেশ প্রদানের পাশাপাশি সমবেত জনতার সম্মুখে তিনি প্রদান করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ।
এমনিভাবে আশেপাশের রাজা-বাদশা, আমীর-উমারা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে পত্র প্রেরণ করে তাদেরকে জানিয়েছেন ইসলামের সুশীল ছায়াতলে সমবেত হবার আহবান। রাসূলে খোদা সা. একদিকে যেমনি ছিলেন নবী ও রাসূল তেমনি ছিলেন দুজাহানের বাদশা। দুনিয়া আখেরাতের সর্বোপরি বাদশাহী আল্লাহ তায়ালা তাকে দান করছিলেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো তার কথাবার্তা, চলাফেরা, কাজ, কর্মে এমনিভাবে ভাষণ ও চিঠিপত্রের ক্ষেত্রে তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে শাহী প্রতাপ ও বাদশাহী প্রভাব প্রতিপত্তির চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতা ও ভালোবাসার।
কারণ কেবল শাহী প্রভাবে হয়তো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়, কিন্তু মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না। যায় না সকলকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে স্বর্গ রচনা করা। পক্ষান্তরে প্রেমের মাধ্যমে এ মর্তের ধরাকে গড়ে তোলা যায় স্বর্গের মত, ফুল ফুটান যায় মরু সাহারার বুকে। বইয়ে দেয়া যায় অশান্ত পৃথিবীর বুকে বসন্তের মধু সমীরণ। রচনা করা যায় অমর স্মৃতির তাজমহল।
তাই কবি বড়ই সুন্দর বলেছেন-
“কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর।
প্রীতিপ্রেমের পুণ্য বাঁধনে
যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন
মোদের কুড়ে ঘরে।”
রাসূলে খোদা সা. চেয়েছিলেন প্রেমের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে চির মুক্তির মোহনায় পৌঁছাতে, তাই তার সর্বোপরি কাজেকর্মে ফুটে উঠেছে মায়া-মমতা, প্রকাশ পেয়েছে অমীয় মধুময় প্রেম। প্রকাশ হবেই বা না কেন, তিনি যে ছিলেন রহমাতুল্লিল আলামীন, প্রকাশ হবেই বা না কেন, তিনি যে ছিলেন মাহবুবে খোদা, তিনি যে ছিলেন মুক্তির নবী।
প্রেম প্রস্ফুটিত তো হবেই, তিনি যে ছিলেন দয়ার নবী, করুণার ছবি। তাই তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিকশিত হয়েছে প্রেম, প্রেম আর প্রেম। হাবীবে খোদার প্রেমের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন। “
আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি হয়েছ কোমলমতি প্রেমময়, যদি তুমি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী হতে তাহলে তারা তোমার থেকে দূরে সরে যেত। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
এ আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. কে প্রেমময়ী বানিয়েছেন। ফলে তার জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নির্ঝরিত হয়েছে প্রেমের ফল্প ধারা। এ ধারা ছোঁয়া থেকে বাদ যায়নি তার প্রদত্ত ভাষণ ও পত্রাবলী।
দুনিয়ার রাজা বাদশাদের ভাষণ পত্রাবলী হয় শাহী প্রতাপ, উদ্ধত-অহমিকায় ভরা, পক্ষান্তরে হাবীবে খোদা সা.-এর ভাষণ-পত্রাবলী অত্যন্ত সহজ সরল তবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রেমময় দরদ মিশ্রিত। আমরা এখানে তার কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করব।
রাসূল কারিম সা. সর্বদা মৌখিকভাবে হজরত সাহাবায়ে কেরাম রা. এদেরকে তালিম তরবিয়ত দিতেন, কিন্তু যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্মুখে আসত তখন তিনি সমবেত জনতার সম্মুখে ভাষণ পেশ করতেন।
বিভিন্ন সময় তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান ভাষণ পেশ করেছেন, ঐতিহাসিক, মুহাদ্দিসীন ও মুফাসসিরীনরা সে ভাষণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
রাসূল কারিম সা.-এর প্রদত্ত ভাষণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, নবুয়তের তৃতীয় বছর মক্কার সাফা পাহাড়ে চড়ে সমবেত কুরাইশ গোত্রের সম্মুখে প্রদত্ত ভাষণ, হিজরতের পর মদীনাতে পৌঁছে সকল আনসার মুহাজিরদের সম্মুখে দেওয়া ভাষণ, মক্কা বিজয়ের পর কাবাগৃহে প্রবেশ করে দেওয়া ভাষণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভাষণ, বিদায় হজ্বের ভাষণ।
সাফা পর্বতে প্রদত্ত ভাষণ
নবুয়তের তৃতীয় বছর বহু সংখ্যক নারী-পুরুষ ইসলামে প্রবেশ করেছে। বিষয়টা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. কে নির্দেশ দিলেন, “মুহাম্মাদ তুমি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু কর, আর মুশরিকদের থেকে হও বিমুখ।”
আল্লাহর হাবীব রাসূল সা. সে নির্দেশ পালন করলেন, এবং মক্কার সাফা পর্বতে আরোহণ করে কুরাইশ গোত্রসমূহের নাম ধরে আহবান করতে লাগলেন। যখন সকল গোত্রের লোক একত্রিত হল তখন তিনি তাদের উদ্দেশ করে বললেন, “আমি যদি তোমাদেরকে সংবাদ দেই যে, এই পাহাড়ের পাদদেশে শত্রু বাহিনী ওঁত পেতে আছে অচিরেই তারা তোমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে, তাহলে তোমরা কি আমার এ কথা বিশ্বাস করবে?
সকলে সমস্বরে জবাব দিল, অবশ্যই আমরা তা বিশ্বাস করব। কারণ এ পর্যন্ত কোনদিন তুমি মিথ্যে বলনি। তারপর মহানবী সা. বললেন, তোমরা যদি তোমাদের বাতিল ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ না কর তাহলে আল্লাহ তায়ালার কঠিন শাস্তি তোমাদের জন্য অপেক্ষমাণ, অবশ্যই তোমাদের উপর নিপতিত হবে। কোন ব্যক্তি তার নিজের জাতির জন্য আমার চেয়ে উত্তম কোন উপহার আনে নাই। আমি তোমাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ নিয়ে এসেছি। আল্লাহ তায়ালার হুকুম আমি যেন তোমাদের কে সে কল্যাণের প্রতি আহবান জানাই। আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের কাছে আদৌ মিথ্যে বলব না। মহান সত্তার শপথ, আমি তোমাদের কাছে। এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য নবী ও রাসূল হিসেবে আগমন করেছি। (দারুসুস্ সীরাত পৃষ্ঠা-১০ সীরাতে ইবনে হিশাম)।
রাসূলে খোদা সা.-এর উল্লিখিত ভাষণের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঁঝা যায় মানুষের প্রতি তার কি পরিমাণ প্রেম-ভালোবাসা ছিল। কারণ রাসূল সা. নিশ্চিত জানতেন তার ভাবী বিজয়ের কথা, ইসলামের বিজয়ের কথা আর একজন ব্যক্তি যদি তার বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হন তাহলে তিনি তার প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে যা ইচ্ছে তা বলতে পারেন, কিন্তু রাসূল সা. তেমনটি করেননি, তার ভাষণে কোন ধমক নেই, নেই কোন কঠিন ভাষা, বরং তিনি দরদভরা কণ্ঠে, অনুনয় বিনয়ের সুরে আহবান জানিয়েছেন সকলের ইহ পারলৌকিক সর্বোপরি কল্যাণের দিকে। অন্যান্য রাজা-বাদশা ও রাসূল কারিম সা.-এর ভাষণের মধ্যে এটাই পার্থক্য।