মহান আল্লাহর করুণা ও অনুগ্রহ ‘রহমত’, ক্ষমা তথা ‘মাগফিরাত’ ও ‘নাজাত’ বা মুক্তির পয়গাম নিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। বিশ্ব মানবতার মাঝে এ মাসে আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। শুধু আত্মশুদ্ধিই নয়; বরং এ মাসে সিয়াম-সাধনার ফলে রোজাদারের দৈহিক সুস্থতাও ফিরে আসে।
আত্মশুদ্ধির মাস রমজান। আরবি ‘তাযকিয়াতুন নুফুস’-এর বাংলা পরিভাষা আত্মশুদ্ধি। রমজান মাসে যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারল না; তার সিয়াম পালন অর্থহীন। এ তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধিকে পবিত্র কুরাআন ও হাদিসে ‘ইহসান’ ও ‘ইখলাস’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে। সহিহ হাদিসে ইহসানের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি এটা সম্ভব না হয়, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে দেখছেন, এ কথা মনে করবে।’ (সহিহ মুসলিম-১০২, বোখারি-৫০)। মহানবি (সা.)-এর অমীয় বাণী-‘এটি (রমাদান) সংযমের মাস আর সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত)।
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু পরহেজগার হতে পারো।’ এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, রোজার বিধান দেওয়া হয়েছে তাকওয়া অর্জনের জন্য, গুনাহ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতের উপযোগী হওয়া, নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। এ ছাড়া প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা, মহানুভবতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি নৈতিক গুণে-গুণান্বিত হওয়া আবশ্যক। রমজান মাসে মানুষের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন ও কাজ-কারবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সে গুণাবলি অর্জনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (রোজা রেখে) পাপ, মিথ্যা কথা, অন্যায় ও মূর্খতাসুলভ কাজ ত্যাগ করে না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ সহিহ বোখারি : ১৯০৩।
রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। লাইলাতুল কদরে কুরআন নাজিলের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে। রাসূল (সা.) রমজান মাসে পুরো কুরআন শরিফ হজরত জিবরাইল (আ.)-কে একবার শোনাতেন এবং জিবরাইল (আ.)-ও নবি করিম (সা.)-কে পূর্ণ কুরআন একবার শোনাতেন। বড় বড় সাহাবিরাও রমজানে প্রতি সপ্তাহে সমগ্র কুরআন একবার তেলাওয়াত করতেন বলে হাদিসে প্রতীয়মান হয়। বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহর ওপর ইমান আনায়নের পরই ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় আমল হলো যথাক্রমে সালাত ও সাওম। কুরআনের সঙ্গে সাওম ও সালাতের সম্পর্ক সুগভীর। রাসূল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি সাওম ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য তারাবির সালাত সুন্নত করেছি; অতএব, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানে দিনে সাওম পালন করবে ও রাতে তারাবির সালাত আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এমন পবিত্র হবে; যেমন নবজাতক মাতৃগর্ভ থেকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) ভূমিষ্ঠ হয়। (নাসায়ি, প্রথম খণ্ড ২৩৯ পৃষ্ঠা)।
পবিত্র কুরআন কদরের রাত্রিতে নাজিল হয়েছে। কদরের রাত্রি রমজান মাসের শেষ দশ রজনির একটি। রমজান মাসের রোজা পালন ফরজ আখ্যায়িত করে আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন, রমজান মাস যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে আর এ কুরআন মানবজাতির জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। রাসূল (সা.) একদা শাবান মাসের শেষ দিনে সাহাবায়ে কিরামকে লক্ষ করে মাহে রমজানের রোজার ফজিলত সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি একটি মহান মোবারক মাস ছায়া ফেলেছে। এ মাসে সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম একটি রজনি আছে। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো নেক আমল (নফল) দ্বারা আল্লাহর সান্নিধ্য কামনা করে, সে যেন অন্য সময়ে কোনো ফরজ আদায় করার মতো কাজ করল। আর এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো ফরজ আদায় করে, সে যেন অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আদায়ের নেকি লাভ করার সমতুল্য কাজ করল। এটি সংযমের মাস আর সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত।’ (মেশকাত)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) আরও বর্ণনা করেন রাসূল (সা.) বর্ণনা করেন, প্রত্যেক বস্তুর জাকাত রয়েছে, তেমনি শরীরেরও জাকাত আছে, আর শরীরের জাকাত হচ্ছে রোজা পালন করা। অর্থাৎ জাকাতদানে যেভাবে মালের পবিত্রতা অর্জন হয়, তেমনি রোজা পালনের মাধ্যমে শরীর পবিত্র হয়, গুনাহ মুক্ত হয়। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে, একটি তার ইফতারের সময়, অপরটি হলো আল্লাহতায়ালার দিদার বা সাক্ষাতের সময়। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা পালন করে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করা হয়। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় রমজান মাসে ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করে, তার অতীতের সব অপরাধ ক্ষমা করা হয়। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় লাইলাতুল ক্বদর (ভাগ্য রজনিতে) ইবাদাতে মগ্ন থেকে রাত্রি জাগরণ করে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করা হয় (বোখারি ও মুসলিম)।