Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

ভোট ও প্রার্থীর বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

Icon

মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:০৪ পিএম

ভোট ও প্রার্থীর বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলাম একটি সর্বকালীন, সার্বজনীন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনের যাবতীয় সমস্যার দিকনির্দেশনা ইসলামে বিদ্যমান। 

ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, আন্তর্জাতিক জীবন, অর্থব্যবস্হা, সমরব্যবস্থা, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র ব্যবস্থা, আন্তদেশীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি, পারস্পরিক সম্পর্ক, চারিত্রিক সংশোধনের দিকনির্দেশনা, সম-সাময়িক স্বার্থ সংরক্ষণ, প্রতিরক্ষা নীতি, আইন-কানুনের যাবতীয় শাখা-প্রশাখার বিস্তারিত দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। 

ইসলাম মানুষকে যেমনিভাবে আখেরাতের সব বিষয়ের দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তেমনিভাবে দুনিয়ার সব বিষয়েও দিয়েছে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা।

সমস্যাসঙ্কুল মানবজীবনের নিত্যদিনের তাবৎ সমস্যা ও পেরেশানীর পরিপূর্ণ সমাধান বিদ্যমান রয়েছে কুরআন-সুন্নায়। ইসলাম যেমনিভাবে চরমপন্থাকে সমর্থন করে না তেমনিভাবে নরমপন্থাকেও। উগ্রতা বা শিথিলতা কোনটাকেই ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম মধ্যমপন্থা ও ভারসাম্যনীতিতে বিশ্বাসী। 

নির্বাচন একটি প্রাচীন পদ্ধতি ও গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বিধান 

ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মাদের (সা.) ইন্তেকালের পর কাফন-দাফনের আগে ইসলামী বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান এবং খলিফা নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে হজরত আবু বকর সিদ্দিককে (রা.) সাহাবাদের মতামতের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচিত করা হয়।

অপরদিকে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি অপরিহার্য বিষয়। রাষ্ট্রের নাগরিকরা ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বাছাই করার সুযোগ পায়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল ও প্রার্থীদের জন্য ভোট হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম।

দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাস, ঘুষখোর, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী, মিথ্যাবাদী, ধর্মের প্রতি উদাসীন, খোদাদ্রোহী ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়া বা ক্ষমতায় বসার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।

নির্বাচনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য ইসলাম সর্বদা ব্যক্তির সততা, যোগ্যতা, খোদাভীতি, ঈমান-আমল, জ্ঞান ও চারিত্রিক গুণাবলীকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হওয়া যেমন জরুরি, প্রার্থী বা নির্বাচিত ব্যক্তিও তেমন সৎ-যোগ্য, জ্ঞানী-গুণী, চরিত্রবান, খোদাভীরু, আমানতদার, ন্যায়পরায়ণ, দেশপ্রেমিক, মানবদরদি ও দায়িত্বানুভূতিসম্পন্ন হওয়া তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন।

ইসলাম একটি সামাজিক ও মানবিক ধর্ম। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটাই একটি ইবাদত। এর মাধ্যমে দেশ, ধর্ম ও মানবতার সেবা করার বিরাট সুযোগ লাভ করা যায়। যারা প্রার্থী হবে তারা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় মানবতার সেবার নিয়তে প্রার্থী হন এবং আমানতদারীর সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে আল্লাহকে ভয় করে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তারা শুধু দুনিয়ায় সম্মানিত হবেন না, বরং আল্লাহর কাছেও বড় মর্যাদার অধিকারী হবেন।

এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা মানবসেবার জন্য দৌড়ঝাঁপ করবে, তাদের মর্যাদা হবে সে লোকের মতো যে সারারাত ইবাদত করে এবং সারাদিন রোজা রাখে। ’

ইসলাম সমাজকর্মীদের বড় মর্যাদা দিয়েছে। তাদের কর্মকে গুরুত্বের সঙ্গে গণ্য করেছে। নিয়ম ও স্তর অনুযায়ী তাদের বিপুল পরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে বলে হাদিসে এসেছে। 

এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক কাজের সফলতা, ব্যর্থতা, সুফল ও কুফল ব্যক্তির নিয়তের ওপর নির্ভর করে। (বুখারি-মুসলিম)

সুতরাং প্রার্থী যদি নির্বাচিত হয়ে দেশ, ধর্ম ও মানুষের জন্য কল্যাণকর এবং সওয়াবের কাজ করেন, তখনই শুধু তিনি সে সম্মান ও মর্যাদা পাবেন। যারা ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করবেন তারাও অনুরূপ সওয়াব ও মর্যাদার অধিকারী হবেন।

কারণ, ভোটারদের কারণেই তিনি এমন পুণ্যময় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যারা ভালো বা মন্দ কাজ করে বা করার ক্ষমতা ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় তারা ওই কর্ম সম্পাদনকারীর সমান সওয়াব বা গুনাহ অর্জন করবে। ’ (তিরমিজি-মিশকাত)

নির্বাচিত ব্যক্তি যদি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে মানবতাবিরোধী এবং ইসলামবিরোধী ও নির্যাতনমূলক কাজ করেন, তাহলে তাকে শুধু নয় যারা তাকে নির্বাচিত করবেন এবং ভোট দেবেন সবাইকে এসব অপকর্মের দুর্ভোগ পোহাতে হবে এবং কঠিন আজাবের সম্মুখিন হতে হবে। যেহেতু তাদের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার ফলেই এতসব অপকর্ম করার সুযোগ ওই মন্দ লোকটি পেয়েছে। 

কেউ যদি ক্ষমতা পেয়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্নীতি করে, পক্ষপাতিত্ব করে, জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করে, ইসলামবিরোধী কাজ করে, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানকে পাপের বাজারে পরিণত করে, সে ব্যক্তি বা তার দলই শুধু আল্লাহর গজবে নিপতিত হবে না। বরং তারা সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলবে। 
সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণেই সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-এর কাফন-দাফনের চেয়ে রাষ্ট্রের নেতা নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে খলিফা নির্বাচিত করেছিলেন।

নেতা নির্বাচনে অত্যন্ত দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দেয় ইসলাম। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট একটি পবিত্র আমানত। এ আমানত ওই ব্যক্তির কাছেই গচ্ছিত রাখতে হবে; যিনি শিক্ষিত, সৎ, যোগ্য, ন্যায়পরায়ণ, নিরপেক্ষ এবং রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবতার কল্যাণে কাজ করেছেন, করছেন ও করবেন। 

এ ছাড়া যিনি তার অন্তরে জবাবদিহির ভয় পোষণ করেন, তাকে ভোটদান করলে সমাজের কল্যাণকর কাজ হবে এবং অসৎ, অযোগ্য, পক্ষপাতদুষ্ট, অশিক্ষিত, সমাজবিরোধী ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে তার দ্বারা সমাজের ধ্বংসাত্মক ছাড়া আর কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না।

ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি

(১) সাক্ষ্য প্রদান করা
(২) সুপারিশ করা 
(৩) প্রতিনিধির ক্ষমতা প্রদান করা।

(১) সাক্ষ্য দেওয়া

প্রতিনিধি বা নেতা নির্বাচনে অনেক প্রার্থীই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। তাদের মধ্য থেকে আমরা মাত্র একজনকে ভোট প্রদানের ক্ষমতা রাখি। যাকে ভোট প্রদান করলাম তাকে সাক্ষ্য প্রদান করলাম যে, তিনি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক দায়িত্ব পালনে আস্থাশীল একজন সৎ, যোগ্যপ্রার্থী। যদি আমরা কোনো প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে অযোগ্য, অসৎ বা মন্দ লোককে ভোট প্রদান করি, তবে তার অর্থ দাঁড়ায় আমি মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদান করলাম; যা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি বড় অপরাধ ও গোনাহের কাজ। 

এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনুল কারীমে উল্লেখ রয়েছে, ‘হে ইমানদাররা, তোমরা আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য প্রদানে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যদি তা তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতা-মাতা অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। যদি সে বিত্তশালী হয় কিংবা দরিদ্র হয়। তবে আল্লাহ উভয়ের ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা (প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে) এড়িয়ে যাও, তবে জেনে রেখো তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত’।  (সূরা: নিসা, আয়াত-১৩৫)। 

এ ছাড়া পবিত্র কুরআনুল কারীমে আরো অনেক আয়াতে সত্য সাক্ষী প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব যেকোনো নির্বাচনে প্রতিনিধি বা নেতা নির্বাচিত করতে অসৎ, অযোগ্য প্রার্থীকে ভোট প্রদান করলে তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে নিশ্চিত।

(২) সুপারিশ করা 

কোনো ব্যক্তি কোনো প্রার্থীকে ভোট প্রদানের অর্থ হলো, সে ব্যক্তি ওই প্রার্থীকে একজন সৎ, যোগ্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করার সুপারিশ করেছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সুপারিশ দুনিয়া ও পরকালে ব্যক্তির ভালো-মন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত। 

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি সৎকাজের জন্য কোনো সুপারিশ করবে তা থেকে (সৎ কাজের) একটি অংশ পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের সুপারিশ করবে, সে তার (মন্দ কাজের) একটি অংশ পাবে। আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের সংরক্ষণকারী’। (সূরা: নিসা, আয়াত-৮৫)।

(৩) প্রতিনিধির ক্ষমতা প্রদান করা

ক্ষমতা প্রদান হলো ভোট প্রদানে ইসলামের তৃতীয় মূলনীতি। জেনে-শুনে-বুঝে কোনো অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করার পুরো দায়ভার যিনি ভোট প্রদান করবেন তাকেই বহন করতে হবে। 

এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এ (মানুষের জীবন পরিচালনায় ইসলামের বিধিবিধান পালনের) আমানত পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা তাতে আশঙ্কিত হলো, কিন্তু মানুষ সে দায়িত্বভার গ্রহণ করল। সে বড়ই অন্যায়কারী, বড়ই অজ্ঞ’। (সূরা: আহযাব, আয়াত-৭২)। 

অতএব, প্রতিটি নির্বাচনে সৎ ও যোগ্যপ্রার্থীকে ভোট প্রদান আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। কোনো প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বা অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য ও অসৎ লোককে ভোট প্রদান একটি গোনাহের কাজ। অতএব, ভোটাধিকার প্রদানের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে সচেতন থাকা অত্যাবশ্যক।

লেখক: ইসলামী কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম