ইতিহাসবিদ আবু জাফর ইবনে জাবির বলেন, ‘হজরত আদম ও হাওয়ার (আ) ঔরসে বিশ জোড়া সন্তান হয়।’ প্রতি জোড়ার একজন ছিল ছেলে, আরেকজন মেয়ে।
একদম প্রথম দুই জোড়ায় যথাক্রমে কাবিল ও হাবিল নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। কাবিল কৃষিকাজ করত আর হাবিল ভেড়া চড়াতেন।
আল্লাহতায়ালা সুরা মায়িদায় এই দুই ভাইয়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন—‘তাদের সামনে আদমের দুই পুত্রের কাহিনি যথাযথভাবে পড়ে শোনান—যখন তাদের প্রত্যেকে একেকটি কুরবানি পেশ করেছিল এবং তাদের একজনের কুরবানি কবুল হয়েছিল, অন্যজনের কবুল হয়নি। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। প্রথমজন (হাবিল) বলল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের পক্ষ হতেই কবুল করেন।’
তখনকার দিনে যেকোনো জিনিস দিয়েই কুরবানি করা যেত। নিয়ম ছিল কুরবানির পশু বা অন্যকিছু পাহাড়ের ওপর রেখে আসবে, তারপর আকাশ থেকে আগুন এসে জ্বালিয়ে দেবে। যার কুরবানি আগুনে জ্বলবে না, বোঝা যাবে তার কুরবানি কবুল হয়নি।
তো, হাবিল একটি মোটাতাজা ভেড়া পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসে, আর কাবিল রেখে আসে নিম্নমানের গম ও শস্য। আল্লাহ কাবিলের কুরবানি কবুল করেননি, তার গম ও শস্যের কারণে নয়, বরং তার মাঝে ছিল তাকওয়ার বড্ড অভাব।
আমাদের সবারই মনের ভেতরে লুকিয়ে আছে একটি পশু। ওই পশুর খাদ্য হলো লোভ, হিংসা, অহংকার, কাম ও ক্রোধ। ওটাকে তাই শক্ত শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়, না খাওয়ায়ে দুর্বল বানাতে হয়। ও যদি একবার ছাড়া পায়—তাহলে আর রক্ষা নাই, আমাদের ঈমান-আমল সব ধ্বংস করে ফেলবে।
কাবিল ওই পশুটাকে আটকে রাখতে পারেনি, কুরবানি কবুল না হওয়ায় সে হিংসায় মরে যাচ্ছিল। খুনে-ক্রোধ তাকে অন্ধ করে তুলেছিল, সে একবারের জন্যও এই চিন্তা করেনি—তার ঘাটতি আসলে কোথায়, কোন দোষে আল্লাহ তার কুরবানি কবুল করেননি।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে এগুলোর (কুরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’
কাবিল মুত্তাকিদের পথ অবলম্বন করার বদলে, নিজেকে বদলানোর পরিবর্তে, জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল সিদ্ধান্তটি নেয়—নিজের দোষে অপরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়।
হাবিল কিন্তু কাবিলের তুলনায় শক্তিশালী ছিল, তবু হাবিল বললেন, ‘তুমি যদি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করব না। আমি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই, তুমি আমার ও তোমার দুজনেরই গোনাহের ভার বহন কর এবং জাহান্নামিদের মধ্যে গণ্য হও। আর এটাই জালিমদের শাস্তি।’
এ কথা শুনেও কাবিলের মনে আল্লাহর ভয় জাগল না, মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রবৃত্তি নামক পশু তাকে প্ররোচিত করল। সত্যি সত্যিই সে হাবিলকে মেরে ফেলল, এবং অকৃতকার্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। এরপর সে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে—এ কী করলাম আমি! এখন এই লাশ নিয়ে আমি কী করব?
তখনও পৃথিবীতে কোনো মানুষের মৃত্য হয়নি। কাবিল তাই জানত না কীভাবে লাশ দাফন করতে হয়। সে বুকে অনুশোচনার ভারী পাথর আর পিঠে ভাইয়ের লাশ নিয়ে ঘুরতে থাকে। আল্লাহ তাআলা তখন দুটো কাক পাঠিয়ে তাকে দাফনের নিয়ম শিখিয়ে দেন। ‘সে বলে উঠল, হায় আফসোস—আমি কি এই কাকটির মতো হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি!’
শুধুমাত্র হিংসার কারণে, নিজের দোষ না খুঁজে অন্যকে দোষারোপ করার ফলে, কাবিল নিজেকে হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
হাদিসে আছে, পৃথিবীতে যত হত্যাকাণ্ড হবে, তার সব গোনাহের এক ভাগ পাবে কাবিল। কারণ সেই প্রথম হত্যার প্রচলন ঘটিয়েছিল।