ইসলামের পঞ্চম ভিত্তি হজ। সামর্থ্য থাকলে হজ করা ফরজ, এ ছাড়াও প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে জীবনে একবার হলেও আল্লাহর ঘর তওয়াফ করার খায়েশ থাকে। কিন্তু হজ কেবলই একটি নিয়মসর্বস্ব প্রথা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক সফর।
হজের মধ্যে দিয়ে হাজি নিজেকে নতুন এক মানুষে পরিণত করেন। হাদিসে আছে—কেউ হজ করল আর অশালীন ও নিষিদ্ধ করল না, কেয়ামতের দিন তাকে এমনভাবে উঠানো হবে যেন সেদিনই তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস ১৫২১)
ইসলামে আমল যেমন কাম্য, তেমনই আমলটা সঠিক ও পরিপূর্ণ হওয়াও কাম্য। আমল শুদ্ধ হওয়া আর পরিপূর্ণ হওয়া এক বিষয় নয়। পরিপূর্ণতা মানে ফরজ ও ওয়াজিবের পাশাপাশি প্রতিটি সুন্নত ও মুস্তাহাব মেনে আমল করা।
হজের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন—ِ এবং আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণভাবে হজ ও ওমরা পালন কর। (সুরা বাকারা, ১৯৬) অর্থাৎ হজ ও ওমরাটা যেন আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণ হয়। এটা অনেক হাজি সাহেবের সামনে স্পষ্ট থাকে না। এই ব্যাপারটা যত স্পষ্ট হবে, আপনার প্রস্তুতি সেই মাপে হবে এবং বাস্তবায়নও সেভাবে হবে।
তো হজের উদ্দেশ্যে সব ধরনের প্রস্তুতির আগে এই চারটি কাজ করতে হবে—
(এক) খালেস নিয়ত: নিয়ত যে সহিহ হতে হবে, এটা সবাই জানি। এটা বনিয়াদি কথা। তবে সত্যি বলতে, নিয়তই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। এর জন্য যুগ যুগ সাধনা করতে হয়। ব্যাপারটা খুবই সুক্ষ্ম, একটা পিঁপড়ার হাঁটার চেয়ে সুক্ষ্ম। একটুখানি রিয়া (লোক দেখানো) হলেই শিরক হয়ে যাবে।
রাসুল (স.) বলেন, আমি আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে বেশি ভয় করি শিরকে খফি (গোপন শিরক)। তাই আগে নিয়ত ঠিক করো, তারপর হজ করো।
(দুই) তওবা: খাঁটি তওবা করে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া। তাহলে আপনার অবস্থাও ভিন্ন হবে, অবস্থানও ভিন্ন হবে। আপনার আবেদন-নিবেদন ও কবুল হওয়ার যোগ্যতা ব্যতিক্রম হবে।
(তিন) তাকওয়া: আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের শ্রেষ্ঠ পাথেয় হলো তাকওয়া। কোরআনে আছে—আল্লাহ কেবল মুত্তাকি লোকের এবাদতই কবুল করেন। (সুরা মায়িদা, ২৭) তাই তাকওয়া রাখতে হবে।
(চার) হালাল মাল: আপনার সম্পদ হালাল হতে হবে। হালাল-হারাম মিশ্রিত হলে হবে না। দশ টাকা দিয়ে কাপড় কিনেছেন, এর মধ্যে এক টাকা হারাম, তবু হবে না। আল্লাহ নিজে পাক-পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকেই কেবল পছন্দ করেন।
এরপর প্রস্তুতি হিসেবে যে কাজগুলো করতে হবে—
(এক) দীনকে বোঝা: হজের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক হলো এই শিক্ষা—এবাদত কাকে বলে, দীন কাকে বলে। নামাজ পড়া কিংবা রোজা রাখাই এবাদত নয়। তাহলে এবাদত কী?
এবাদত হলো আল্লাহর হুকুম মানা। কেন একটা কালো ঘরের সামনে ঘুরতে হবে, এর পেছনে কোনো যুক্তি আছে কী? থাকুক বা না থাকুক, আল্লাহ হুকুম করেছেন তাই তওয়াফ করতে হবে—মনের মধ্যে এই বোধ জাগিয়ে তোলা। যে কাজ রসুল (স) করেছেন, সাহাবায়ে কেরাম করেছেন, আজও চলছে—এগুলোই হলো দীন। এর জন্য কারণের প্রয়োজন নাই, ব্যাখ্যা কিংবা যুক্তিরও দরকার নাই। এটাই এবাদত। হজ থেকে এই শিক্ষা নেওয়া।
(দুই) হজের উদ্দেশ্য জানা: হজের হাকিকত, হজের শিক্ষা, হজের সফর থেকে কী নিয়ে আসবেন, হজের জন্য মানুষ কেমন পাগলপারা ছিল, হজে গিয়ে মানুষ কেমন পাগল হয়েছে, কতজন জান দিয়েছেন, আল্লাহর ভালোবাসায় নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নাই—এসব জানা।
(তিন) হজের মূল আমল সম্পর্কে জানা: এক ধরনের কাজ হলো সব সময়ের আমল। যেমন আপনি কীভাবে ঘর থেকে বের হবে, কীভাবে বাহনে আরোহণ করবেন। এই বিষয়গুলোও হজের আলোচনায় আসে। কিন্তু এসব হজের জন্য নির্ধারিত আমল নয়। অজ্ঞতার কারণে অনেকে হজের ব্যবস্থাপনামূলক নিয়মকেও এবাদত মনে করে।
অন্যদিকে যে ধরনের কাজ হজের জন্য ফরজ কিংবা ওয়াজিব, সেগুলোকে বিশেষভাবে বুঝতে হবে। কারণ এসব বাদ পড়লে হজ আদায় হবে না। তাই দুই ধরনের আমল সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া জরুরি।
(চার) হজের বিষয়গুলো বুঝে নেওয়া: হজ সংক্রান্ত প্রত্যেকটি নাম আরবি ভাষায়। এই পারিভাষিক নামগুলো মুখস্ত করার প্রয়োজন নেই, কেবল বিষয়গুলো বুঝে নিলেই হবে।
(পাঁচ) ইতিহাস জানা: হজের সাথে সম্পৃক্ত সবকিছুর ইতিহাস জানা। একেকটা বস্তু একেকটা জায়গা—মিনা, মুজদালিফা, সাফা, মারওয়া, রসুলের (স) জীবনের সাথে ও ইসলামের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত জিনিসের ইতিহাস জানা ও বোঝা।
কাবায় পৌঁছে যে বিষয়গুলো মেনে চলার প্রস্তুতি নিতে হবে—
(এক) কষ্টের জন্য প্রস্তুত থাকা: ঢাকা থেকে রওয়ানার পর প্রায় ২৪ ঘন্টা ঘুম হবে না, আপনি একদম দিশেহারা থাকবেন। বড় ভোগান্তি হবে। হোটেলে পৌঁছলে মনে হবে কতক্ষণে বিছানায় শরীরটা রাখব, কিন্তু খুব দ্রুতই রুম পাবেন না। একটু অপেক্ষা করতে হবে। তারপর রুমে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখতে পাবেন—খাবার ভালো না, এসি চলে না, বাথরুম থেকে পানি পড়ে—এরকম হাজারো অসুবিধা।
কিন্তু শোকর আদায় করতে হবে, আল্লাহ পাক তার ঘরে এনেছেন। একেক জন সাথী একেক চরিত্রের হবে, কারও জন্য দেরি হবে, কেউ একদিকে ডাকলে আরেকদিকে যাবে। এই পরিস্থিতিতে আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে।
কবি হাফিজ শিরাজি বলেন—
‘লাইলার বাড়ির পথ বিপদে আপদে ভরপুর
পা ফেলার প্রথম শর্ত হলো মজনু হতে হবে।’
মোদাকথা, অনেক অনেক কষ্টের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
(দুই) ঝগড়া করা যাবে না: কোরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন—যে নিজের উপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। (সুরা বাকারা, ১৯৭)
তো নিজেকে নিজে প্রশ্ন করবেন :
• আমি কে?
• আমি কোথায়?
• আমি কী?
এই প্রশ্নের উত্তর পেলে আপনার মধ্যে তিনটি গুণ পয়দা হবে :
• শুকরগুজারি
• সবর
• জিম্মাদারের আনুগত্য
এই বিষয়গুলো আপনাকে অনেক ঝগড়া থেকে বাঁচিয়ে দেবে। প্রশ্ন তো ওই একটাই—অনেক টাকা দিয়েছি, কিন্তু যেমন চেয়েছি তেমন পাইনি। আপনি যদি নিজেকে জিম্মাদারের অধীন বানিয়ে ফেলেন, আপনার যদি নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত না থাকে, তাহলে কোনো ঝগড়া হতেই পারে না।
(তিন) জিম্মাদারের আনুগত্য করা: একজন জিম্মাদারের সকলের মন রক্ষা করে চলতে হয়। তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। সার্বিকভাবে যা ভালো মনে হয় জিম্মাদার তা-ই করে থাকেন। তাই সব সময় তার নির্দেশ মেনে চলা জরুরি।
(চার) একলা একলা থাক: জামাতের নামাজে যেমন ডানে-বায়ে মানুষ থাকে, কিন্তু কারও সাথে কারও সম্পর্ক নাই। হজেও তেমন হতে হবে। হজ কোনো ইজতেমায়ি (সামষ্টিক) আমল নাই, প্রত্যেকটা কাজ ইনফেরাদি (ব্যক্তিগত)। তাই যতটুকু নিরিবিলি জায়গা পাবেন, ওর মধ্যেই নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হবে। একদম কবরের বাসিন্দা হয়ে যাবেন।
(পাঁচ) নিজের ব্যাপারে সচেতন থাকা: দল থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না। নিজের রোগ ও ওষুধের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। অতিরিক্ত তওয়াফ করে অসুস্থ হয়ে পড়বেন না। ঠাণ্ডা পানি থেকে দূরে থাকবেন।
(ছয়) নিজের ভাষায় দোয়া করা : হাজি সাহেবগণ দোয়া নিয়ে খুব পেরেশানিতে থাকেন। অথচ হাতে গোণা দুই-চারটা দোয়া ছাড়া হজের কোনো মাসনুন দোয়া নেই। একটা দোয়াও যদি কেউ না পড়ে, তার হজে ঘাটতি হবে না। হ্যাঁ, দোয়া পড়লে হজ নুরানি হবে, বরকতময় হবে। কিন্তু একজন নতুন হাজির জন্য আরবিতে দোয়া বা আরবিতে নিয়ত বড় কঠিন পরীক্ষা। দোয়া আরবিতে না পড়তে পারলে অসুবিধা নাই, দিল খুলে নিজের ভাষায় আল্লাহর সাথে কথা বলবেন।
(সাত) পাগল বেশে থাকা : হাজির পাগল বেশ হতে হবে। আল্লাহর রসুলকে (স) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘হজ কী?’ তিনি বলেন, ‘এলোমেলো চুল আর গায়ে উৎকট গন্ধ।’
(আট) বেশি বেশি তালবিয়া পাঠ করা : তালবিয়া হলো—‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ তালবিয়া উচ্চস্বরে পড়া। আর পরপর তিনবার তালবিয়া পাঠ করা তাকিদপূর্ণ মুস্তাহাব।প্রত্যেক অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তনে তালবিয়া পাঠ করবেন।