কুরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কুরআন ও হাদিসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এমনিভাবে কুরবানি ইসলামের শিআরসমূহের অন্যতম।
শিআর বলা হয় ইসলামের মৌলিক নিদর্শনগুলোকে। যেমন,মসজিদ, নামাজ, রোজা, রমজান, হজ পালন, জাকাত প্রদান, ঈদ, কুরবানি করা- এজাতীয় মৌলিক নিদর্শন ও আলামতগুলোর মধ্য দিয়ে ইসলামের রূপ ও অবয়বটি প্রকাশ পায়। এই শিআরগুলোর অন্যতম হল, আল উযহিয়্যা তথা কুরবানি।
কুরআন,সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মতের আলোকে কুরবানির বৈধতা প্রমাণিত। হাদিস শরীফে এসেছে যে, ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরতের পর যখন থেকে কুরবানি করা শুরু করেন, তারপর থেকে আর কখনো বাদ দেননি। অর্থাৎ কোনো ঈদুল আজহার সময় কুরবানি না করে থাকেননি। (জামে তিরমিযী ১/১৮২)
কুরবানি কি সুন্নত নাকি ওয়াজিব? এ বিষয়ে মুজতাহিদ ফকিহদের মাঝে দু’টো মত রয়েছে।
প্রথম মত: সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ি, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রমুখের মত এটা। আর এর উপরই হানাফী মাজহাবের ফতোয়া। আর ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদের একটি মতেও কুরবানি ওয়াজিব। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর মতেও কুরবানি করা ওয়াজিব।
দ্বিতীয় মত: কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা অত্যন্ত তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। এটা ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ, ইবনে কুদামা, ইবনে হাযম রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখসহ একদল ফকীহদের মত। আর এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম মালিকের মতেও সুন্নতে মুয়ায়াক্কাদাহ।
কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি পরিত্যাগ করা মাকরুহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সামর্থ্য হওয়া সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা বৃহৎ নিদর্শন। (আহকামুল উদহিয়্যাহ, পৃ.214 )
কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ একমত যে, কুরবানির দিনগুলোতে যথাসম্ভব কুরবানি করা জরুরি এবং এর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি না দেওয়া অন্যায়। কেননা নবী করিম সা.এর ভাষ্যমতে কুরবানির দিনগুলোতে কুরবানির রক্ত প্রবাহের চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক প্রিয় কোন আমল নেই।
জাওয়াহিরুল ইকলিল শরহু মুখতাসারে খালিল গ্রন্থে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে যে,যদি কোনো শহরের সমস্ত লোক কুরবানি ছেড়ে দেয় তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করা হবে। কেননা কুরবানি ইসলামের শিআর। (রাসায়িলে ফিকহিয়্যা লিশ শায়খে ইবনে উসাইমিন রহিমাহুল্লাহ ৪৬,আহকামুল উদহিয়্যাহ, ইবনে উসাইমিন পৃ.214 )
কুরআন-সুন্নাহে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার দলিলসমূহ।
• আল্লাহ তায়ালা বলেন- নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার:১-২)
মুফাসসিরীনে কেরাম বলেছেন, এই আয়াতের মর্ম হচ্ছে, ‘ঈদের নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন।’
আমাদের নবী, ইনসানিয়াতের রাহবার হজরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কুরবানি করেছেন, মানুষকে কুরবানী করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
• হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে- সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৩১২৩; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ৪৭৪৩ [হাদীসটি ‘মারফ‚’ ও ‘মাউক‚ফ’ উভয়ভাবে বর্ণিত হয়েছে।
প্রখ্যাত হাদীসবিষারদ যফর আহমাদ উসমানী রাহ.-সহ বহু মুহাদ্দিস উভয় বর্ণনাকেই ‘সহীহ’ বলেছেন। আর হাদীসের শব্দ ও মর্ম দেখেও তা ‘মারফ‚’ বলেই মত প্রকাশ করেছেন। (ইলাউস সুনান, খ. ১৭, পৃ. ২১২-২২৫)]
• হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত- হজরত জাবের (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাতে ঈদের নামাজ পড়িয়েছেন। কিছু লোক নামাজের পূর্বেই কুরবানি করে ফেলেছেন এ ধারণায় যে, হয়তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালামও কুরবানি করে ফেলেছেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিলেন যারা নামাযের পূর্বে কুরবানি করেছে তারা অবশ্যই পূনরায় কুরবানি করতে হবে। তোমরা কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বে কুরবানি করবে না। (সহীহ মুসলিস-১৯৬৪)
কুরবানি যদি ওয়াজিব না হয়ে সুন্নত-ই হতো, তাহলে তো পূনরায় কুরবানির নির্দেশ দিতেন না।
• হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দশ বছরের প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন। (জামে তিরমিযী, হাদিস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৪৯৫)
ফিকহের পরিভাষায় নবীজীর এমন নিয়মিত আমলকে বলা হয়- (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়মিত আমল) এই নিয়মিত আমল- এটাও আমলটি ওয়াজিব হওয়ার বা আবশ্যকীয় হওয়ার আলামত।
সুনানে তিরমিযীসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস রয়েছে কুরবানি সম্পর্কিত।
• মিখনাফ বিন সুলাইমান রা. হতে বর্ণিত- মিখনাফ বিন সুলাইম রা. বলেন, আমরা আরাফাতের ময়দানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে উকুফ করছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করেন, হে মানুষ সকল! প্রত্যেক পরিবারের কর্তার উপর প্রতি বছর কুরবানি করা আবশ্যক এবং আতিরাও। (আবু দাউদ হাদিস-২৭৮৮)
এ হাদিসে উল্লিখিত ‘আতিরা’ সর্বসম্মতিক্রমে রহিত হয়ে গেছে। কুরবানির বিধান বলবৎ।
• হযরত জুনদুব আল বাজালি রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের খুতবাতে ইরশাদ করেন, যারা নামাজের পূর্বে কুরবানি দিয়েছো তারা তার পরিবর্তে অবশ্যই পুনরায় কুরবানি করো। আর যারা তখন কুরবানি করোনি তারা আল্লাহর নামে কুরবানি করো। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-১৯৬০)
• এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন- কুরবানি কি আবশ্যকীয় আমল? তিনি উত্তর দিলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানি করেছেন। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলে তিনি এবার বললেন, তুমি কি কিছু অনুধাবন করতে পারছ- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানি করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদিস ১৫০৬
এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নকারী যে ভাষায় প্রশ্ন করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. অন্য ভাষায় তার উত্তর দিলেন। তিনি নবীজী এবং মুসলমানদের আমলের কথা বললেন।
প্রশ্নকারী তখন প্রশ্নটি দ্বিতীয় বার করলেন। তখন ইবনে উমর রা. রাগত ভাষায় বললেন- তুমি কি কিছু অনুধাবন করতে পারছ? তিনি আবার আগের উত্তর দিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানরা কুরবানী করে এসেছেন। এখানে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কুরবানি মুসলমানদের মাঝে সুন্নতে মুতাওয়ারাছা (নিয়মিত হয়ে আসা আমল) এটা দ্বীনের একটি শিআর।
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানি (হাফি.) তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিমে বলেন: ইবনে উমর (রা.) এর জবাবে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেননা, তাকে কুরবানি ওয়াজিব কি-না? এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। যদি সত্যিই কুরবানি ওয়াজিব না-ই হতো, তবে তিনি স্পষ্ট ওয়াজিব নয় বলতে পারতেন। তিনি তা না করে রাসূল সা. এর আমলের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করেছেন, যা ওয়াজিব হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। আর স্পষ্ট ওয়াজিব বলেননি যাতে কেউ ফরজ ভেবে না বসে। (তাকমিলাতুল ফাতহুল মুলহিম: ৩/৩০৯)
• শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মাজমাউল ফাতাওয়া গ্রন্থে রয়েছে, অর্থাৎ কুরবানির ব্যাপারে সর্বাধিক স্পষ্ট মত হল, তা ওয়াজিব। কেননা তা ইসলামের সর্ববৃহৎ নিদর্শন। এটা গোটা উম্মতের জন্য ওয়াজিব হওয়ার-ই দাবি রাখে।
দ্বিতীয়ত কুরবানিকে আল্লাহ তায়ালা নামাজের সাথে যুক্ত করেই পেশ করেছেন, যা ওয়াজিব হওয়ার উপরই প্রমাণ বহন করে।
মাজমাউল ফাতাওয়া ১২/৯৩
তাই ওয়াজিব-সুন্নত নাম যা-ই দেন, কুরবানি থেকে পালিয়ে থাকার সুযোগ নেই। ফুকাহায়ে কেরাম পরিভাষা কী ব্যবহার করেছেন, তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল যুগ যুগ ধরে চলে আসা মুসলমানদের আমল এবং আমলের পরম্পরা দেখা।
মাজহাবী পরিভাষার বিতর্কে না গিয়ে আমরা কুরবানির ক্ষেত্রে সব যুগে মুসলমানদের আমল দেখলে বুঝতে পারব যে, কুরবানি আবশ্যকীয় একটি আমল এবং ইসলামী শরীয়তের একটি শিআর।