Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

মাহে রমজানের জানা অজানা তথ্য

Icon

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৩, ১১:০১ এএম

মাহে রমজানের জানা অজানা তথ্য

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম একটি হলো রোজা। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। আর সারা বিশ্বজুড়ে মুসলিমের কাছে রমজান মাস একটি পবিত্র সময়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রেখে তারা এ সময়টি পার করে থাকে। 

কিন্তু ইসলামের পূর্বে রোজা কেমন ছিল? কবে প্রথম এই মাসব্যাপী রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়? রোজা অনেক ধর্মের একটি সাধারণ কর্ম। রোজা রাখার নিয়ম সর্বযুগেই প্রচলিত ছিল। আদি মানব সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত নবী-রাসুলরা রোজা পালন করেছেন। 

রোজা শুধু নবী করিম (সা.)-এর প্রতি ফরজ করা হয়নি, পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিল। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত নূহ (আ.) পর্যন্ত চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা ফরজ ছিল, যাকে ‘আইয়্যামে বিজ’ বলা হতো। 

ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর মাহে রমজানের রোজা ফরজ হলে তা রহিত হয়ে যায়।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিন সাওম পালন করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? তোমরা এই দিনে সাওম পালন কর কেন? তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহতায়ালা বনি ইসরাইলকে শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেছেন। তাই হজরত মূসা (আ.) এ দিনে সাওম পালন করেছেন।

 এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিন সাওম পালন করেন এবং সবাইকে সাওম পালনের নির্দেশ দেন। 

রোজা নামাজের মতো একটি পুরোনো ইবাদত এবং পূর্ববর্তী বিভিন্ন ধর্মে রোজার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, চীন, জাপান, কোরিয়া, মিসর ও গ্রিসে রোজার প্রচলন ছিল। 

হজরত মূসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে তাওরাত প্রাপ্তির আগে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। হজরত ঈসা (আ.) তার ধর্ম প্রচারের শুরুতে ইঞ্জিল পাওয়ার আগে ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন। 

হজরত মূসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.) এবং তাদের অনুসারীরা সবাই রোজা পালন করেছেন। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের জন্য রোজা পালনের বিধান ছিল। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন এবং অন্যান্য সময় রোজা ফরজ ছিল। 
খ্রিষ্টানদের ওপর মুসলমানদের মতো রোজা ফরজ ছিল। বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মধ্যেই রোজা পালনের ইতিহাস পাওয়া যায়।

আর রামাদান  (ভাষাগত অপভ্রংশ: রমজান) শব্দটা এসেছে আরবি মূল রামিদাবা আর-রামাদ থেকে, যার মানে প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। আরবি ক্যালেন্ডারের নবম মাস হলো রমজান। ৬১০ সালের রমজান মাসেই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ওহীর মাধ্যমে নবুয়ত পেয়েছিলেন । 

এ মাসের যে রাত্রিতে প্রথম আয়াতগুলো নাজিল হয় (সুরা আলাক এর প্রথম পাঁচ আয়াত) সে রাতকে বলা হয় শবে কদর বা লাইলাতুল কদর  (আরবিতে লাইল=রাত) । 

বলা হয়েছে যে, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাত্রির কোনো এক রাত্রি এই শবে কদর, প্রসিদ্ধমতে সেটা ২৭ তারিখ ধরে নেয়া হয়। যদিও আরেক মতে সেটি ২৩তম রাত্রি। তবে নিশ্চিতভাবে এই রাতটি পাবার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ ইতিকাফ করে থাকেন, অর্থাৎ নির্জনে টানা ১০ দিন  ইবাদত। আর এই রমজান শেষ হওয়া মানেই ঈদুল ফিতর যা মুসলিমদের প্রধান দুটি উৎসবের একটি।

পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও, মতবাদ আছে যে, নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সহিফা নাজিল হয়েছিল তৎকালীন রমজানের ১ম দিবসে, তাওরাত এসেছিল ৬ রমজান, যাবুর ১২ রমজান আর ইঞ্জিল ১৩ রমজান। যদিও আরবের বাহিরে রমজান মাস হিসেব করা হতো না, কিন্তু এই হিসেবটা ভিন্নজাতিক পঞ্জিকার সাথে মিলিয়ে স্থির করা হয়েছে বলে বলা হয়।

তবে পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় যখন  হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং সাহাবীরা মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেন তার পরে। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল।

তবে এমন না যে, এর আগে কেউ রোজা রাখত না। অবশ্যই রাখত। কুরআনেই বলা রয়েছে যে, আগের জাতিগুলোর জন্যও রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সেটা রমজান না হলেও।

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।” (পবিত্র কুরআন, বাকারা ২:১৮৩)

এমনকি মক্কার মানুষেরাও ইসলামের পূর্বে রোজা রাখত, তবে সেটা কেবল মুহাররাম মাসের ১০ম দিন, আশুরার রোজা। কারবালার ঘটনা তখনও ঘটেনি, আশুরার প্রধান উপজীব্য ছিল হযরত মুসা (আ) এর নেতৃত্বে মিসর থেকে বনী ইসরাইলের মুক্তি এবং লোহিত সাগর দু’ভাগ হয়ে যাবার ঘটনা। আত্মসংযম আর আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির নিমিত্তে অন্যরাও রোজা রাখত বটে।

৭৪৭ সালের একজন আরব লেখক আবু যানাদ জানান যে, উত্তর ইরাকের আল জাজিরা অঞ্চলে অন্তত একটি মান্দাইন সমাজ ইসলাম গ্রহণের আগেও রমজানে রোজা রাখত। 

প্রথম থেকেই রমজানের রোজা রাখা শুরু হত নতুন চাঁদ দেখবার মাধ্যমে, তাই অঞ্চল ভেদে রোজার শুরুও ভিন্ন হতো। এখন মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি দেশের মুসলিমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক সময়ানুসারে সেখানে রোজা রাখতে পারে না, যেহেতু সেখানে দিনরাত্রির পার্থক্য করা দুরূহ। তাই নিকটতম স্বাভাবিক দেশের সময়সূচী কিংবা মক্কার সময় মেনে তারা রোজা রাখে এবং ভাঙে।

অতিরিক্ত ইবাদত হিসেবে রয়েছে তারাবি, যদিও সেটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। হযরত মুহাম্মাদ (সা) প্রথমদিকে জামাতের সাথে সে নামাজ আদায় করলেও পরে জামাতে করেন নি, পাছে সেটি মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তবে খলিফা উমর (রা.) পুনরায় জামাতে আদায় করা শুরু করেন তার শাসনামলে। 

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ) এবং তাদের উম্মাতগণ সকলেই সাওম পালন করেছেন। নবীগণের মধ্যে হযরত দাউদ (আ.)-এর রোজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইব্‌নুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সবসময় রোজা রাখ এবং রাতভর নামাজ আদায় কর। আমি বললাম জী, হ্যাঁ। তিনি বললেন: তুমি এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। যে ব্যক্তি সারা বছর রোজা রাখল সে যেন রোজাই রাখল না। (প্রতি মাসে) তিনদিন রোজা রাখা সারা বছর রোজা রাখার সমতুল্য। 

আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি রাখার সামর্থ রাখি। তিনি বললেন: তাহলে তুমি ‘সাওমে দাউদী’ পালন কর। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন। ( ফলে তিনি দূর্বল হতেন না ) এবং যখন তিনি শত্রুর সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না।

এতে প্রমাণিত হয় যে, হজরত দাউদও (আ.) সিয়াম পালন করেছেন। মোটকথা হয়রত আদম (আ.)- এর যুগ থেকেই রোজা রাখার বিধান ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে আদর্শচ্যুত হয়ে লোকেরা আল্লাহর বিভিন্ন বিধানকে যেভাবে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছিল অনরূপভাবে রোজার মধ্যে তারা এমন সব পরিবর্ত ন করেছিল যাতে রোজার ধর্মীয় তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট শেষ হয়ে একটি নিছক প্রথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

এহেন অবস্থা হতে রোজাকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং এক আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর নিমিত্তে মহান রাব্বুল আলামীন দ্বিতীয় হিজরীতে রমজান মাসের রোজাকে এ উম্মাতের উপর ফরজ করে দেন।

অনেকের আগ্রহের বিষয় থাকতে পারে, নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও সাহাবীরা কী খেয়ে সাহরি বা ইফতার করতেন? নবীজী (সা.) মাগরিবের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুর খেতেন, তা না থাকলে শুকনো খুরমা-খেজুর, আর পানি। এটাই ছিল ইফতার। 

একবার তিনি সফরে থাকা অবস্থায় ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার করেছিলেন। সাহরি ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দিতেন খেজুরকে। তবে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে খেজুরগুলো ছোট ছোট, আরবীয় খেজুর যথেষ্ট বড়, অন্তত আমাদের দেশের তুলনায়।

পরিশেষে, মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে মুসলিম জাতির উপর রোজা ফরজ করেন। 

মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো।’ হিজরী শাবান মাসের ১০ তারিখে এই আয়াতটি আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় রাসূল (সা.) এর উপর নাযিল করেন এবং মুসলমানদের উপর রোজা ফরজ হয়। মহানবীর নির্দেশ মতে ইসলামের এই ফরজ রোজা, রমজান মাসে পালিত হয়ে থাকে।


লেখক: এম এ কামিল হাদিস, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। 
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম