
প্রিন্ট: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০২:৪৭ পিএম
‘আল্লামা শফীর ১৩ দফায় আরও ১ দফা যোগ করতে চেয়েছিলাম’

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২০, ০৬:১০ পিএম

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।
আরও পড়ুন
আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম; নানা কারণে আলোচিত ও সমালোচিত। জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৫০ সালের ৭ মার্চে।
ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে ১৯৭৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথমস্থান অধিকার করে ফাজিল পাস করেন।
তিনি শোলাকিয়া জাতীয় ঈদগাহের ইমাম, জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি, ইকরা বাংলাদেশের পরিচালক, এশিয়া ফাউন্ডেশনের বিশেষ পরামর্শক, ফাউন্ডেশন ফর গ্লোবাল পলিসি স্টাডিজ, ইসলামিক রিসার্চ কাউন্সিল অব বাংলাদেশ, ইকরা মাল্টিমিডিয়া ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের সভাপতি এবং মাসিক পাথেয় পত্রিকার সম্পাদক।
এর আগে মাওলানা মাসঊদ বাংলাদেশ সরকারের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের সহ-সভাপতি এবং বিভিন্ন সময়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি, গবেষণা, প্রকাশনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষের সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। বাংলা ও উর্দু ভাষায় লিখিত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩১। ১২টি গ্রন্থ সরাসরি আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদিত।
আল্লামা আহমদ শফীর (রহ.) ইন্তেকালের অব্যবহিত পর তার মূল্যায়ন, অবস্থান ও কওমি পরিমণ্ডলের নানা বিষয়-আশয় নিয়ে যুগান্তরের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেছেন- এহসান সিরাজ ও মনযূরুল হক। গ্রন্থনা করেছেন- তানজিল আমির
যুগান্তর: আজকাল কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: দুই হাজার পৃষ্ঠার বিরাট কলবরের সিরাতগ্রন্থ লেখার কাজ শেষ হল। হাতেই লিখেছি। প্রথম খণ্ড প্রকাশ হবে কিছুদিন পর। মোট তিন খণ্ড হবে। তাফসিরের কাজও করছি। ইতোমধ্যে চারপারা সম্পন্ন হয়েছে। আরও কিছু পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ করছি।
যুগান্তর: আল্লামা আহমদ শফীর (রহ.) ইন্তেকাল হল। তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: তার সম্পর্কে আমি দুটো কথা বলি। এক. তাঁর পা যেখানে, আমার মাথা সেখানে। এটা এর আগেও আমি বলেছি। তার প্রতি আমার আস্থা, বিশ্বাস ও ভক্তি থেকেই কথাটা বলি।
দুই. তিনি মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানির (রহ.) একজন এজাযতপ্রাপ্ত খলিফা। মাদানি (রহ.) যার প্রতি আস্থা রেখেছেন, যার প্রতি ভরসা করে খেলাফতের এজাযত দিয়েছেন, তার প্রতি আস্থা রাখতে আমার তো কোনো দ্বিধা নেই।
আমি বিশ্বাস করি- মাদানির (রহ.) সোহবত যারা পেয়েছেন, আখেরাতে আল্লাহ তাদের লজ্জিত করবেন না। আর আল্লামা আহমদ শফি (রহ.) ইলমের দৌড়ে যেমন এগিয়ে ছিলেন, তেমনি আমলের দৌড়েও। তিনি অনুপ্রাণিত ছিলেন হযরত মাদানির (রহ.) চিন্তাধারায়।
একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন দীনের খেদমতে, তালিবুল ইলমদের জন্য মেহনতে। সামাজিক কাজে, ধর্মীয় আন্দোলনে তো যুক্ত হয়েছেন জীবনের শেষ বয়সে, এই ইদানীং।
যুগান্তর: ২০১৬ সালে পত্রপত্রিকায় একটা নিউজ দেখেছি- আপনি আল্লামা আহমদ শফীর (রহ.) সাক্ষাৎ চাচ্ছেন। সাক্ষাৎ কি পেয়েছিলেন? কেন সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: না, তখন পাইনি। তখন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি হাটাহাজারী মাদ্রাসা অবধি গিয়েছিলাম। তিনি তখন দেশের তুমুল আলোচিত আলেম। জাতীয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। আর আমি পরিচিত ছিলাম তার বিরোধী হিসেবে।
তার খাদেমরা আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। কখনও বলেছে হযরত ঘুমাচ্ছেন। কখনও বলেছে তিনি ব্যস্ত আছেন। দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও তার দেখা না পেয়ে চলে আসি।
পরে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে তাকে বলার পর তিনি বলেছেন, ‘কী বলেন, আপনি আমার কাছে গিয়েছেন, আর আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করব না?’ আসলে আমি যে তার সাক্ষাতে গেছি, বিষয়টি ঘূণাক্ষরেও জানতে পারেননি।
আমি তার কাছে গিয়েছিলাম মূলত একটি দাবি নিয়ে। দাবিটি হল- হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের ১৩ দফায় কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করার একটি পয়েন্ট আছে। এই ১৩ দফার সঙ্গে যেন মওদুদিবাদ সম্পর্কেও একটি পয়েন্ট যুক্ত করা হয়।
যুগান্তর: কাদিয়ানি ও মওদুদিদের আপনি এক রকম মনে করেন?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: না, তা করি না। তবে কোথাও কোথাও কাদিয়ানি থেকে মওদুদিবাদ বেশি ভয়ংকর, বেশি ডেঞ্জারাস। কারণ কাদিয়ানিদের সরকার অমুসলিম ঘোষণা করুক বা না করুক, আলেমদের প্রচারণায় মানুষ এতটুকু বিশ্বাস করে-কাদিয়ানিরা মুসলমান নয়।
কিন্তু মওদুদিরা তেমন নয়। তারা ইসলামের লেবাসে কাজ করে, ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। তাই মানুষ তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হবার আশঙ্কা বেশি।
যখন মওদুদিদের তেমন বিকাশ ঘটেনি, তখনই দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস ও নাজেমে তালিমাত (শিক্ষা পরিচালক) আল্লামা ইজাজ আলী বলেছিলেন- ‘কাদিয়ানিদের চেয়ে মওদুদিরা বেশি নিকৃষ্ট।’
আরেকটি দিক হলো- মওদুদিদের সাংগঠনিক কাঠামো, পরিচালনা নীতি থেকে নিয়ে সবকিছুই কমিউনিস্টদের কাঠামো ও নীতি দ্বারা প্রভাবিত। তাদের সবকিছু সেখান থেকে নেয়া।
এ জন্যই আমি চেয়েছিলাম ১৩ দফার সঙ্গে মওদুদিবাদ সম্পর্কে একটি পয়েন্ট দাবি নিয়ে গিয়েছিলাম। যদি এই পয়েন্ট যুক্ত করা হতো, মওদুদিবাদীরা শফী (রহ.) থেকে দূরে চলে যেত, আর তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন।
এখন যেমন হাটহাজারী আন্দোলনের পেছনে তৃতীয় শক্তি কাজ করেছে, তেমনি হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের পেছনেও কলকাঠি নেড়েছে মওদুদিবাদীরা। আন্দোলনের আড়ালের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। তারা যদি না থাকতো, তাহলে আল্লামা আহমদ শফী এই বিপর্যয়টা দেখতেন না।
যুগান্তর: কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড) তো তাদের সমর্থন দেয়। সৌদির বাদশাহ ফয়সাল সাইয়েদ মওদুদিকে ‘বাদশা ফয়সাল’ পুরস্কার দিয়েছেন।
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: বাদশা ফয়সালের পুরস্কার দেয়াটা ইসলামের বড় কোনো স্বীকৃতি নয়। খোদ সৌদিরা ইসলামের ওপর কতটুকু আছে, তাই নিয়ে সন্দেহ। এসব পুরস্কারের পেছনে লবিং কাজ করে। কত বড় বড় ব্যক্তি পুরস্কার পান না। অথচ অনেক নিম্ন লেবেলের মানুষও পুরস্কার পেয়ে যান।
আর বর্তমান ইখওয়ানুল মুসলিমিন শায়খ হাসানুল বান্নার প্রতিষ্ঠিত সেই ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মতো নেই। শায়খ বান্না ছিলেন অত্যন্ত সুফী ও দাঈ মেজাজের মানুষ। ইখওয়ানকে রাজনৈতিক মেজাজে রঙিন করেছেন সাইয়েদ কুতুব। আর মওদুদিদের সঙ্গে সাইয়েদ কুতুবের সম্পর্ক ছিল। সুতরাং তারা সবাই একই ধারার। সমর্থন দিতেই পারে।
যুগান্তর: জামায়াতের শীর্ষ নেতারা আহমদ শফী সাহেবের খাটিয়া বহন নিয়ে আলোচনা উঠেছে...
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: জামায়াতে ইসলামী আসলে সুযোগ সন্ধানী দল। তারাও হয়ত সুযোগে ছিল, সুযোগ বাগিয়ে নিয়েছে। তারা ভক্তি থেকে হজরতের লাশ বহন করেছে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। তারা লাশ বহন করেছে তাদের পপুলারিটি এবং প্রচারের জন্য। এটা তাদের কৌশল। নয়তো কতজনই তো খাটিয়া বহন করে। কই তাদের আলোচনা তো হয় না।
যুগান্তর: হাটাহাজারীর ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: ছাত্রদের ক্ষোভ তো অমূলক ছিল না। তবে তাদের ক্ষোভ আল্লামা আহমদ শফির ওপর ছিল না। ছিল তাকে ঘিরে রাখা সাহেবজাদা ও সিন্ডিকেটের ওপর। কিন্তু তাদের ভেতরের ক্ষোভকে আন্দোলনরূপে উসকে দিয়েছে অন্য কেউ। এর আগের ঘটনা পরম্পরার দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে।
যুগান্তর: তার ইন্তেকালের জন্য এই আন্দোলন দায়ী? তেমন কেউ কেউ ‘হত্যাকাণ্ড’ শব্দ ব্যবহার করেছেন...
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন যখন খবর ছড়িয়ে পড়ল আহমদ শফী (রহ.) তার সাহেবহাজাদাকে (ছেলে) আবার নিয়োগদানের চেষ্টা করছেন, তখনই ছাত্ররা উন্মত্ত হয়ে যায়। ভাঙচুর শুরু করে।
তারা হজরতকে হত্যা করার জন্যই ইচ্ছেকৃতভাবে এসব শুরু করেছে, আমার তা মনে হয় না। যদিও ভিডিওতে বলতে শোনা গেছে ‘বুইড়াটা মরুক’। তারা এটা রাগ থেকে বলেছে। তবে তারা হজরতকে শারীরিক টর্চার না করলেও মানসিক টর্চার করেছে।
এটা তো সত্য, তার সামনে তার খাদেমকে মারধর করা হয়েছে, তার রুমের কপাট ভাঙা হয়েছে, জানালার গ্লাস চূর্ণ করা হয়েছে। তিনি তখন সজ্ঞানে এসব দেখছেন। আমার রুমে এমন আগ্রাসী আক্রমণ চালালে আমিও তো ভয় পেয়ে যাব।
সুতরাং এমনিতেই তিনি অসুস্থ, তারওপর এইসব দেখে তার হার্টফেল করাটা বিচিত্র কিছু নয়। তারা যা করেছে, হত্যার উদ্দেশ্যে না করলেও, তা হত্যার মধ্যেই শামিল। সবকিছু বাদ দিলাম। তিনি তো একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। তার প্রতি আন্দোলনকারী ছাত্ররা ন্যূন্তম মানবতাবোধও দেখায়নি। তারা যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল, তার রেশ টেনে ধরার মতো কোনো নেতৃত্ব ছিল বলে মনে হয় না।
যুগান্তর: হাটহাজারীর আন্দোলনের কিছুদিন পরে ঢাকার চৌধুরীপাড়া মাদরাসায়ও একই রকম আন্দোলন হলো। আপনার কী মনে হয় এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: হাটহাজারী ও চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসায় যে আন্দোলন হয়েছে, তা ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এটা ছড়িয়ে পড়বে না। তবে ছাত্রদের যে দাবি, সেগুলো তো যৌক্তিক দাবি। আশা করি তার যথার্থ সমাধান হবে। আবার ছড়িয়ে না পড়লেও ছড়িয়ে দেবার চেষ্টাও করা হতে পারে। কারণ, মওদুদিরা এখন সক্রিয়। তাই সতর্ক থাকতে হবে।
যুগান্তর: হেফাজতের মূল্যায়নটা আপনার কাছে কেমন?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: হেফাজতে ইসলাম একটা সাময়িক জোয়ারের মতো বিষয়। সাময়িক ইস্যুতে জনগণের মাঝে ঢেউ উঠেছে; ইস্যু শেষ হয়েছে, ঢেউ মিলিয়ে গেছে। এটা পরিকল্পিত কোনও আন্দোলন ছিল না। গঠনমূলক আন্দোলন হতে হলে এর নেতৃস্থানীয়দের যে সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী কোনও লক্ষ্য থাকা দরকার, তা আছে বলে তাদের আচরণ দেখে মনে হয় না।
যুগান্তর: একটু আগে বলছিলেন, ১৩ দফার সঙ্গে আপনি আরেকটি দফা যোগ করতে চাচ্ছিলেন। ১৩ দফায় কি আপনার সমর্থন ছিল?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: ছিল। তবে পদ্ধতিগত ভিন্নমত ছিল। দফাগুলো যেভাবে এসেছে, আমি সেভাবে চাই নি, চেয়েছি ভিন্নভাবে। যাই হোক, তখন হেফাজত বড় একটি সুযোগ হারিয়েছে। আমি ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি, সরকার সিংহভাগ দফা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু বেশি চাইতে গিয়ে কিছুই জোটেনি।
যুগান্তর: ১৩ দফার মাধ্যমে সরকার পতনের প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিল, এমন কথাও শোনা যায়...
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: আল্লামা আহমদ শফীর (রহ.) তো সরকার পতনের উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চাইছিলেন, ইসলাম বিরোধীদের উন্মত্ততা থামিয়ে দিতে। তাদের বিষক্রিয়া নষ্ট করে দিতে।
সরকার পতনই যদি উদ্দেশ্য হতো, তাহলে পরবর্তী সময়ে তিনি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন না, হেফাজতের আন্দোলনও আরও জোরদার করতেন। হ্যাঁ, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলগুলো যুক্ত হয়েছে, তাদের অবশ্যই রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল।
যুগান্তর: ঠিক একই সময়ে আপনি শাহবাগের মঞ্চে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সেখানে গিয়ে আপনি জীবনের সবচেয়ে বড় নেক কাজ করেছেন। এখনও কি তাই মনে করেন?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: হ্যাঁ, সেটা তো আমি তখন বলেছি। এ ব্যাপারে প্রথম কথা হল- আমি শাহবাগের মঞ্চে গিয়েছি আন্দোলনের তৃতীয় দিন। আর নাস্তিকতার বিষয়টি সামনে আসে অষ্টম দিনে।
আমি যখন গিয়েছি, তখন শাহবাগের আন্দোলন ছিল মওদুদি-বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলন শুরুই হয়েছিল মওদুদিবিরোধী সেন্টিমেন্ট নিয়ে। যেখানে মওদুদিবিরোধী আন্দোলন হবে, আর আমি যাব না, তা তো হতে পারে না।
বরং মনে করি, সেখানে না গেলেই অপরাধ হতো আমার। আন্দোলনটি বিশ্বব্যাপী যে বিশাল মিডিয়া কভারেজ পেয়েছে, হলিউড-বলিউডের তারকারাও তা পায় না। এমন একটি মঞ্চে মওদুদিদের বিরুদ্ধে আমার কণ্ঠস্বর উচ্চকিত হয়েছে, বিশ্বব্যাপী মওদুদিবিরোধী প্রচারণা সংহত হয়েছে, এটা তো আমার সফলতা।
মওদুদিবিরোধী আন্দোলন আমারই আন্দোলন। এ আন্দোলনে তাদের আমি সহযোগী হিসেবে পেয়েছি, তাই তাদের মঞ্চে গিয়েছি। আমি যখন মঞ্চে গিয়েছি, তখনও শাহবাগীদের নাস্তিকদের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ পায়নি। যারা নেতৃত্বে ছিল, তারাও নাস্তিক ছিল না।
ইমরান এইচ সরকারের একজন আত্মীয় আমার ঘনিষ্ঠ ছাত্র। সে বলেছে, ইমরান সাধারণ মুসলমানের মতো- কখনও নামাজ পড়ে, কখনও ছাড়ে। তার সঙ্গে যারা ছিল, তারা ইসলাম থেকে উদাসীন ছিল- নাস্তিক ছিল না। কিন্তু ব্লগার রাজিব হত্যার পর নাস্তিকদের পক্ষে তাদের সমর্থন প্রকাশ পায়।
এ হত্যার ঘটনা আন্দোলনের দশ দিনের মাথায়। সুতরাং আমি যদি নাস্তিকতার পক্ষে তাদের সমর্থন প্রকাশের পর ওখানে যেতাম, তাহলে আমাকে অভিযুক্ত করা যেত। কিন্তু আমি তো গিয়েছি আগে, একদম শুরুর দিকে। তখন তাদের স্লোগান ছিল মওদুদিবিরোধী। স্বাধীনতার পক্ষের লোক হিসেবে মওদুদিবাদের বিপক্ষে দাঁড়ানোটাও আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, হেফাজতের আগে আমি একটি সম্মেলন করেছি। ইসলামী ফাউন্ডেশনের ডিজি এবং অন্যরা সরকারি মহলে লবিং করে সম্মেলন বানচাল করতে চেয়েছিল। কিছু দুর্বৃত্ত সম্মেলনে আসা লোকদের ওপর হামলাও করেছিল।
ওই সম্মেলনে আমি সুস্পষ্টভাবে নাস্তিকদের বিচার চেয়েছি, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। সেখানে মওদুদিদের বিরুদ্ধে একটি ফতোয়াও প্রকাশ করেছি। ফতোয়াটি ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন নিয়ে। ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছেন, আল্লামা আহমদ শফী, মুফতি আবদুস সালাম, পাকিস্তানের মাওলানা সলিমুল্লাহ খান।
তারা সবাই বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকে সুদি লেনদেন হয়। এই ফতোয়া প্রকাশ করার কারণে মুওদুদিবাদীরা আমার ওপর চটেছিল।
যুগান্তর: এ ফতোয়া প্রকাশের পর ইসলামী ব্যাংকে খোদ আপনারই একটা অ্যাকাউন্ট তারা সামনে নিয়ে এসেছিল। এটা সত্য?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটা সত্য। তবে ফতোয়া প্রকাশের আগেই আমি এই অ্যাকাউন্ট বাদ দিয়ে দিয়েছি। এর পেছনের গল্পটা বলি। আমি যখন ইসলামিক ফাউন্ডশনে, তখন ইফা’র কিছু আলেম, তাদের নাম বলব না- মওদুদি প্রভাবিত ছিলেন।
আমাদের বেতন আসত চেকে, ব্যাংকের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংক যখন প্রতিষ্ঠা হল তখন ওই কর্মকর্তারা বেতনের জন্য ওখানে অ্যাকাউন্ট খুলে দিলেন। আমি জানতামও না। পরে দেখলাম বেতন এসছে ইসলামী ব্যাংকে। এই হল আসল রহস্য। পরে যখন জানতে পারলাম, অ্যাকাউন্ট বাদ দিয়ে দিয়েছি। বেতন তুলতে পারব কিনা- সেই চিন্তা করিনি।
যুগান্তর: ফ্রান্সের একটি পত্রিকা ‘শার্লি এব্দো’ রাসূলকে (সা.) নিয়ে কার্টুন প্রকাশ করেছে। তাদের অফিসে হামলাও হয়েছে। কয়েক দিন আগে পাকিস্তানে রাসূলকে (সা.) গালমন্দকারীকে প্রকাশ্যে আদালতে গুলি করে হত্যা হয়। বাংলাদেশেও একই ধরনের অবমাননা হয়েছে। শাতেমে রাসূলের (রাসুল অবমাননাকারী) শাস্তির বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: হেফাজতেরও আগে আমি শাতেমে রাসূলের বিচারের দাবি করেছি। এখন কথা হল- রাসূলকে (সা.) কটূক্তি করা বা গালি দেয়ার শাস্তি- এটা তো হুদুদের মধ্যে পড়ে না।
ইসলামী শরিয়তে যে জিনিসগুলো হুদুদের মধ্যে পড়ে না, সেগুলোর বিচার ন্যস্ত হয় বিচারকের ওপর। বিচারক চাইলে তাকে মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারেন। কিন্তু বিচার না করে এভাবে হত্যা করাটা অতি আবেগীয়। ইসলামে বিচারিক আদালতে বিচার ছাড়া কোনো দণ্ড প্রয়োগ করার বিধান নেই।
অনুলিখন: রাকিবুল হাসান। আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব