হুমায়ূন আহমেদের নবীজি ও শেষ দিনগুলোতে মুহিউদ্দীন খানের প্রভাব
সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০১৮, ১২:০০ পিএম
[কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ‘বিশ্বাসী হুমায়ূন ও ঐতিহ্য চিন্তা’ নামে একটি জাতীয় পত্রিকায় এ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল আজ থেকে ১২ বছর আগে। এতে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের একটি চমৎকার বিশ্বাসী দিক ফুটে উঠেছিল, তার আলোচনার অনেকটা অংশ জুড়ে ছিলো মাসিক মদীনার সম্পাদক মুহিউদ্দীন খান। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি তাঁর মতের একেবারে উল্টো দিকের লোকটিকেও কাছে টেনে নিতে পারতেন। এটা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। আকাশের মতো উদার হৃদয়ের এই মহান মানুষটির কাছে যেই আসতেন তিনি প্রভাবিত না হয়ে পারতেন না। জীবনের শেষ দিনগুলোতে প্রভাবিত হয়েছিলেন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদও। তাই এখানে তুলে ধরা হলো।]
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা আর কথা বলার ইচ্ছেটা ছিল বেশ পুরানো। পত্রিকা থেকে অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়ার পর ফোন করে তাঁর থেকে সময় নিয়ে পরদিন যথা সময় হাজির হই- ধানমণ্ডির ৩/অ নম্বর সড়কে, ৪৮ নাম্বার বাসার ৬ষ্ঠ তলা ৬/ঋ নাম্বারের তার ‘দখিনা হাওয়া’য়। এই বাড়িটির মালিক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের দাদা ইসলামি চিন্তাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ। মুহিউদ্দীন খানের একান্ত কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। মুহিউদ্দীন খানের সাহিত্যের হাতেখড়ি প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর এই বাড়িতেই। এই বাড়ির অনেক গল্প শুনেছি খান সাহেবের কাছে। তার ‘জীবনের খেলাঘরে’ বইটিতে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর অনেক কথা আছে। আমি ঘরে বসে বাড়িটি সম্পর্কে অনেক কিছু ভাবছিলাম। কিছুক্ষণ পর লুঙ্গি আর ফতুয়া গায়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলেন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সাইমুম সাদী ভাই স্যারের পূর্ব পরিচিত। তাই বললেন, সাদী, কি প্রয়োজন এসবের? আমার তো মিডিয়ার আড়ালে থাকতেই ভাল লাগে।
এরপর শুরু হলো আড্ডা রূপকথার এই নায়কের সাথে। কথার পিঠে কথা। চলছে রেকর্ডিং। সাক্ষাৎকার শেষ কিন্তু আড্ডাপ্রিয় হুমায়ূন স্যারের কথা বলা যেন শেষ হয় না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কলম জাদুকর আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন, পড়ালেখা কোথায়? উত্তর দিলাম মাদরাসায়। জানতে চাইলেন, কওমী না আলীয়া? বললাম কওমী। চমকে উঠে বললেন, কওমীতে পড়ালেখা! পেশা সাংবাদিকতা! লিখ কবিতা! অদ্ভূত মানুষ তো? আপনার হিমুর চেয়েও? হেসে উত্তর দিলেন – কমও নও।
তারপর বললেন, ‘এই শহরে একজন আলেম আছেন। দারুণ লিখতে পারেন। বেশ শক্ত তাঁর কলম। সমীহ করি। বাবার মতো শ্রদ্ধা করি সেই মনীষাকে। বললাম কে তিনি? লেখক সম্রাট বললেন, খান সাহেব। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। মাসিক মদীনার সম্পাদক। তিনি আমার পিতার প্রতিচ্ছবি।
আমার বাবা একাত্তরের শহীদ ফয়জুর রহমান ছিলেন মদীনা পত্রিকার পাঠক। মা’ও মদীনা পড়তেন। প্রতি মাসে ডাক পিয়ন বাসায় মদীনা দিয়ে যেত। কদিন আগে হুজুরকে দেখতে তাঁর অফিসে গিয়েছিলাম মোহনলালের মিষ্টি নিয়ে। পা ছুঁয়ে কদমবুছি করতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। যেন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এই সেলফটা দেখছ না, এখানে সবগুলো গ্রন্থ মুহিউদ্দীন খানের লেখা। গুলতেকিন ছিলেন খানের ভক্ত। কারণ তাঁর দাদা প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ’’র ঘনিষ্ট এই একজন মানুষই এই শহরে আছেন। বইমেলায় সবাই আমার বই নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর আমি খুঁজি মুহিউদ্দীন খানের লেখা নতুন বই। এই যে তাঁর লেখা ‘কুড়ানো মানিক’ এটা আমার পড়া সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঐতিহ্য সচেতন ও গভীর অনুসন্ধিৎসু মানুষ। শেকড় আর ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর প্রবল টান ছিল। যদিও জনপ্রিয়তার মোহ তাঁকে বরাবরই উল্টো পথে পরিচালিত করতে উৎসাহিত করেছিল। হুমায়ূন আহমেদ একবার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মুহিউদ্দীন খানের কাছে গিয়ে বললেন- ‘ইনি তোমাদের দাদু ভাই, আমার পিতা’। হুমায়ূনের এই সম্বোধনের কারণ ছিল তাঁর পিতা শহীদ ফয়েজ উদ্দীন আহমদ ছিলেন মুহিউদ্দীন খানের একান্ত কাছের মানুষ। ‘মাসিক মদীনা’র একনিষ্ঠ ভক্ত পাঠক। তার বাবা চাচাদের কথা খান সাহেবের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘জীবনের খেলাঘরে’ রয়েছে।
তেমনি হুমায়ূন আহমেদের দাদা শ্বশুর প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর অসংখ্য স্মৃতি এবং হুমায়ূন আহমেদের মামা ফজলুর রহমান, ফুফা সৈয়দ আব্দুস সুলতানের কথাও এসেছে জীবনের খেলাঘরে। ফলে এই বইটার প্রতি কলম জাদুকরের একটু অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। আমাদের সাথে গল্প করতে করতে শেলফ থেকে ‘জীবনের খেলাঘরে’ নামিয়ে এনে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে শোনালেন।
হুমায়ূনের পিতা ফয়েজ উদ্দীন আহমেদ ‘নয়া যামানা’ পত্রিকায় চাকুরী জীবনের শুরুতে মুহিউদ্দীন খানের সাথে কাজ করেছেন। হুমায়ূন নাকি তখন হাফপ্যান্ট পরে বাবার সাথে অফিসে এসেছিলেন। খান সাহেব তাকে কোলে নিতেই বুকের কলমটা টান দিয়ে নিয়ে এসে আঁকতে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। খান সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধের উপর দাগ দিতে দিতে নষ্ট করে ফেলেন সেটি। খান সাহেব কিছু না বলে ছোট্ট খোকার সাহস ও দুষ্টুমি দেখে কেবল হাসছিলেন। হুমায়ূনের বাবার চেহারা লজ্জা আর রাগে লাল হয়ে এলো। ‘কর কি, কর কি? হুজুর আমার ছেলেকে আমার কাছে দেন’ বললেন হুমায়ূনের বাবা।
কবি তালিম হুসেন তখন হাসতে হাসতে বললেন, এই ছেলে এখনি যে কাজ করেছে, বড় হয়ে না জানি কলম দিয়ে কি করে। খানের পকেট থেকে কলম নিয়ে লেখা শুরু করেছে, বাপরে বাপ! এই ঘটনা হুমায়ূন আহমেদ জেনেছেন তাঁর বাবার কাছে। সেদিন এই ঘটনাটি তিনি আমাদের শোনালেন।
হুমায়ূনের শেষ জীবনে ধর্মচিন্তার প্রভাব পড়েছিল। আর তা ছিল মুহিউদ্দীন খানের সাহচর্য লাভের ফল। কলম জাদুকরের শেষ লেখা ছিল ‘নবীজি’। কেন নবীজির সীরাতে নিয়ে উপন্যাস লিখা শুরু করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ? কার প্রভাবে? এজন্য তিনি কি কি গ্রন্থ সংগ্রহ করেছিলেন? সে এক বিস্ময়কর ঘটনা।
সীরাত বিষয়ক রচনা ‘নবীজি’ লিখতে লিখতে ইহলোক ত্যাগ করেন। হুমায়ূন আহমেদ নবীজির জীবন লিখা শুরু করেই হঠাৎ লেখা বন্ধ করে দিলেন। এই খেয়ালে যে ‘যাকে নিয়ে লিখব, তাকে স্বপ্নে অনেকেই দেখেছেন। আমিও দেখতে চাই’।
এই ছেলেমানুষি আর জেদ নিয়ে সর্বশেষ হাজির হয়েছিলেন, নবীপ্রেমিক, সীরাত সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের কাছে। এটাই শেষ দেখা।
‘নবীজি’ লেখার ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ একাধিকবার মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মোস্তফা জামান আব্বাসী, অন্যপ্রকাশের মাসুম ভাই ও আমার সাথে আলাপ-আলোচনা করেছেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কোনো এক বিকেলে নুহাশ পল্লীর লীলাবতী দিঘির ঘাটলাতে হাজির হলাম। নবীজি লিখা কবে শেষ করছেন? জানতে চাইলে পুকুরে বরশি ফেলতে ফেলতে তিনি বলেছিলেন, ‘ধুর মিয়া, আগে নবীজিকে দেইখ্যা লই। তারপর ‘নবীজি’ আবার শুরু করব’।
নবীজি লেখার পেছনে মূল ঘটনা হল, প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশ যখন বাংলাবাজারের পূর্বতন বিক্রয়কেন্দ্র পরিবর্তন করে বৃহৎ পরিসরে বর্তমান বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য হুমায়ূন আহমেদকে অনুরোধ করে, তিনি তাতে সম্মতি দেন। লেখালেখির শুরুর দিকে প্রকাশনাসংক্রান্ত কাজে প্রায়ই বাংলাবাজারে এলেও পরে দীর্ঘদিন আর ওমুখো হননি তিনি। অন্যপ্রকাশের নতুন বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধন উপলক্ষে বহুদিন পর তিনি বাংলাবাজারে এলেন। যথাসময়ে ফিতা কেটে উদ্বোধন করা হলো বিক্রয়কেন্দ্র। একজন মাওলানা সাহেব হৃদয়াগ্রহী দোয়া করলেন।
তারপর কী ঘটল সেটা হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বিভিন্ন পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সর্বশেষ দৈনিক কালের কন্ঠে’র সাময়িকী ‘শিলালিপি’তে [২১ অক্টোবর, ২০১১] হুমায়ূন আহমেদের নিজের ভাষায়,
‘আমি খুবই অবাক হয়ে তাঁর প্রার্থনা শুনলাম। আমার কাছে মনে হলো, এটি বইপত্র সম্পর্কিত খুবই ভালো ও ভাবুক ধরণের প্রার্থনা। একজন মাওলানা এত সুন্দর করে প্রার্থনা করতে পারেন যে আমি একটা ধাক্কার মত খেলাম। মাওলানা সাহেবকে ডেকে বললাম, ‘ভাই, আপনার প্রার্থনাটা শুনে আমার ভালো লেগেছে।’ মাওলানা সাহেব বললেন, আমার জীবনের একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হবে। আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে।‘
আমি তাঁর কথা শুনে বিস্মিত হলাম।
আমি বললাম, ‘এই আকাঙ্ক্ষাটি ছিল কেন? মাওলানা সাহেব বললেন, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই, কারণ আমি ঠিক করেছি, দেখা হলেই আপনাকে একটা অনুরোধ করব।‘
‘কী অনুরোধ শুনি?’
‘আপনার লেখা এতলোক আগ্রহ নিয়ে পড়ে, আপনি যদি আমাদের নবী-করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীটা লিখতেন, তাহলে বহু লোক লেখাটি আগ্রহ নিয়ে পাঠ করত। আপনি খুব সুন্দর করে তাঁর জীবনী লিখতে পারতেন।‘
মাওলানা সাহেব কথাগুলো এত সুন্দর করে বললেন যে, আমার মাথার ভেতরে একটা ঘোর তৈরি হলো। আমি তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ভাই, আপনার কথাটা আমার খুবই মনে লেগেছে। আমি নবী-করিমের জীবনী লিখব।‘
‘এই হলো ফার্স্ট পার্ট। চট করে তো জীবনী লেখা যায় না। এটা একটা জটিল ব্যাপার, কাজটা বড় সেনসেটিভ। এতে কোথাও একটু উনিশ-বিশ হতে দেওয়া যাবে না। লিখতে গিয়ে কোথাও যদি আমি ভুল তথ্য দিয়ে দিই, এটি হবে বড় অপরাধ। আমি নবীজির সীরাত পড়তে শুরু করি। মদীনা পাবলিকেশন্স থেকে খান সাহেব হুজুরের লিখা সব সীরাত গ্রন্থ সংগ্রহ করলাম। তাঁর পরামর্শ নিয়ে কাজ শুরু করি। আমার জানামতে এদেশে নবীজির জীবনী মুহিউদ্দীন খানই সবচেয়ে ভালো জানেন। এনিয়ে তিনি ব্যাপক কাজ করেছেন।
আমি অন্যদিন-এর মাসুমকে বললাম, ‘তুমি একটা সুন্দর কাভার তৈরি করে দাও তো। কাভারটা চোখের সামনে থাকুক। তাহলে আমার শুরু করার আগ্রহটা বাড়বে।‘ মাসুম খুব চমৎকার একটা কাভার তৈরি করে দিল।বইটার নামও দিলাম ‘নবীজি’।
অল্প কয়েক লাইন লেখার পরেই একটা ছেলেমানুষি ঢুকে গেল মাথার মধ্যে। ছেলেমানুষিটা হলো, আমি শুনেছি বহু লোক নাকি আমাদের নবীজিকে স্বপ্নে দেখেছেন। কিন্তু আমি তো কখনো তাকে দেখি নি। আমি ঠিক করলাম, যেদিন নবীজিকে স্বপ্নে দেখব, তার পরদিন থেকে লেখাটা শুরু করব। স্বপ্নে এখন পর্যন্ত তাকে দেখি নি। যেহেতু এক ধরণের ছেলেমানুষি প্রতিজ্ঞার ভেতর আছি, সে কারণে লেখাটা শুরু করতে পারি নি। ব্যাপারটা হাস্যকর। তবু আমি স্বপ্নের অপেক্ষায় আছি।‘
অতঃপর নবীজিকে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুহিউদ্দীন খানের কাছে ফের হাজির হন। খান সাহেব তাঁকে নিজের লেখা জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘স্বপ্নযোগে রাসূল সা.’ পড়তে দিলেন। হুমায়ূন বইটি হাতে নিয়ে আবেগী হয়ে উঠেন। বাসায় এসে বারবার পড়তে থাকেন। এই মুহূর্তে তাঁর শরীরে ধরা পড়ে মরণব্যাধি ক্যান্সার। তিনি চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় চলে যান। যাবার সময় নিজের পছন্দের তিনটি জিনিস শাওনের হাতে দিলেন। ‘এগুলো ব্যাগে ভরে রেখ।‘ কি ছিল সেই জিনিসগুলো? সাথে নিয়েছিলেন একটিমাত্র গ্রন্থ। কোন সে বই…? হ্যাঁ, বলছি।
যাবার আগের রাতে তিনি শাওনকে বললেন, ‘আমার জায়নামাজ, তাসবিহ আর মুহিউদ্দীন খানের ‘স্বপ্নযোগে রাসূল সা.’ গ্রন্থটি লেদারে ভরে রেখ।‘ আমেরিকায় গিয়ে এই একটি মাত্র গ্রন্থ তাঁর প্রিয় সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। মুহিউদ্দীন খানের সীরাত চর্চা, সীরাতপ্রেম জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এসময় নিউইয়র্কে চিকিৎসা করাতে এসে নিয়মিত নামাজ পড়তেন। হুমায়ূন আহমেদকে নামাজ পড়ায় উৎসাহিত করেন তার ভায়রা [গুলতেকিনের ফুপাতো বোনের স্বামী] জামাল আবেদীন খোকা। জামাল আবেদীন হুমায়ূন আহমেদকে নামাজ পড়া দেখে একটি নতুন জায়নামাজ এবং তসবিহ উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে তিনি নানান দোয়া দরুদ শিখে নিয়েছিলেন তখন। অধিকাংশ সময় নামাজ শেষে জায়নামাজে ধ্যান করে একাকী দীর্ঘ সময় বসে থাকতেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনাবস্থায় হুমায়ূন নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। একদিন বললেন, ‘আমি একটি জিনিসের অপেক্ষায় আছি।‘ সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলে লিখতে বসব। তুমি আমার জন্য কাগজ কলম এনে রেখ। জীবনের শেষ লেখাটা শুরু করতে হবে হয়তো।‘ এ কথা মৃত্যুর পর বিভিন্ন মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন জামাল আবেদীন।
নিজের উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতোই রহস্য রেখে গেলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। মৃত্যুর আগে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কালজয়ী বাংলা সাহিত্য রচনা করতে চান তিনি। শেষ একটা লেখা তার মাথায় আছে। সেটা লিখে তিনি মরতে চান। বলেছিলেন- কি লিখবেন তা তাঁর মাথায় আছে। কিন্তু তিনি বলবেন না। সেটা লিখার জন্য অনেক বেশি সাধনা আর চর্চা করতে হয়। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে তার ওই সাক্ষাৎকারটি নেন বিবিসি’র অর্চি অতন্দ্রিলা। আমরা সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরছি।
বিবিসি: আচ্ছা, আপনি লেখালেখি থেকে অবসর নেয়ার কথা কখনও ভেবেছেন কী?
হুমায়ূন আহমেদঃ যখন খুব লেখালেখির চাপ যায়, যেমন ধরো বইমেলার সামনে বা ঈদ সংখ্যার সামনে। যখন খুব চাপের ভেতর থাকি তখন দেখা যায়। [লেখাটা যখন] শেষ হয় সেদিন মনে হয় এখন থেকে আমি অবসরে। আর লেখালেখি নাই। বাকী সময়টা আরামে থাকবো। সিনেমা দেখবো। গল্পের বই পড়বো। সেদিন মনে হয় এটা। তারপরের দিন মনে হয় না। দ্বিতীয় দিন থেকে আমার মনে হয় আমার যেন কিছুই করার নেই। আমি মারা যাচ্ছি। এক্ষুণি কিছু একটা লেখা শুরু করতে হবে। লেখা শুরু করি। তখন একটা স্বস্তি ফিরে আসে। হ্যাঁ, আমি অবসর নেবো। ঠিক করেছি মৃত্যুর ঘন্টাখানেক আগে আমি অবসর নেবো। তার আগে নেবো না। আমি চাই মৃত্যুর এক ঘন্টা বা দু’ঘন্টা আগেও আমি যেন এক লাইন বাংলাগদ্য লিখে যেতে পারি।
বিবিসি: এটা যে মৃত্যুর সময় আপনি কিভাবে বুঝতে পারবেন?
হুমায়ূন আহমেদ: বোঝা যায় তো, বোঝা যায় না! অনেকে তো বলে দেয়। টের পায় আমি মারা যাচ্ছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার জন্য শারীরিক প্রস্তুতি। মৃত্যু তো শুধু হার্ট বন্ধ হয়ে যায় তা না। প্রতিটি কোষই মারা যায়। সেই প্রতিটি কোষের মৃত্যু একটা ভয়াবহ ব্যাপার। এটা বুঝতে পারার তো কথা। [তিনি গুনগুনিয়ে গাইলেন] মরিলে কান্দিস না আমার দায়, শিয়রে বসিয়া সুরায়ে এয়াসিন পড়িও…খাছায়।
বিবিসি: তো আপনি শেষ পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি পারবো কিনা জানি না। আমার গোপন ইচ্ছা এবং প্রগাঢ় ইচ্ছা হচ্ছে- মৃত্যুর এক-দু’ঘন্টা আগেও বাংলাগদ্য লিখতে পারি, যেন হা-হুতাশ করে না মরি। আল্লাহকে স্মরণ করে মরতে পারি। আমি সেই গদ্যটি লিখার জন্য অনেক সাধনা ও স্ট্যাডি করছি।‘
নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদের সেই শেষ বাংলা গদ্যটি ছিল ‘নবীজি’। আমার কাছে মনে হয় তিনি হয়তো ভাবতেন, ‘নবীজি’ লেখার মতো যোগ্যতা তাঁর নেই। কিন্তু তিনি এক মাওলানা আর তাঁর পিতাতুল্য মুহিউদ্দীন খানের কাছে ওয়াদা করেছিলেন ‘নবীজি’ লেখার। রহস্যপুরুষ হুমায়ূন শেষ পর্যন্ত একটি গভীর প্রেমের রহস্যে ডুব দিয়েছিলেন। তা হলো নবীজি স্বপ্নে দেখার প্রবল ইচ্ছে জেগেছিল তাঁর ভেতরে। মৃত্যুর আগে যতোটা না ‘নবীজি’ শেষ করার ইচ্ছে ছিল, তার চেয়েও বেশি ইচ্ছে ছিল নবীজি লিখতে লিখতে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। মনে হয় তাঁর সেই ইচ্ছে পুরো করেছিলেন মহান প্রভু।
নিচের এই অংশটি লিখে তিনি নবীজি লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নবীজিকে স্বপ্নে দেখে বাকিটুকো লেখার ইচ্ছে নিয়ে। স্বপ্নে দেখার ইচ্ছের আগের অংশটুকু হলো-
‘আরব পেনিনসুয়েলা। বিশাল মরুভূমি। যেন আফ্রিকার সাহারা। পশ্চিমে লোহিত সাগর, উত্তরে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পার্শিয়ান গালফ। দক্ষিণে প্যালেস্টাইন এবং সিরিয়ার নগ্ন পর্বতমালা। সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল। এখানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বলে কিছু নেই। সারা বৎসরই মরুর আবহাওয়া। দিনে সূর্যের প্রখর উত্তাপ সব জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। সারা দিন ধরে বইছে মরুর শুষ্ক হাওয়া। হাওয়ার সঙ্গে উড়ে আসছে তীক্ষ্ণ বালুকণা। কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। পানি নেই। তারপরেও দক্ষিণের পর্বতমালায় বৃষ্টির কিছু পানি কীভাবে যেন চলে আসে মরুভূমিতে। হঠাৎ খানিকটা সবুজ অঞ্চল হয়ে ওঠে। বালি খুঁড়লে কাদা মেশানো পানি পাওয়া যায়। তৃষ্ণার্ত বেদুঈনের দল ছুটে যায় সেখানে। তাদের উটগুলির চোখ চকচক করে ওঠে। তারা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কাঁটাভর্তি গুল্ম চিবায়। তাদের ঠোঁট কেটে রক্ত পড়তে থাকে। তারা নির্বিকার। মরুর জীবন তাদের কাছেও কঠিন। অতি দ্রুত পানি শেষ হয়। কাঁটাভর্তি গুল্ম শেষ হয়।
বেদুঈনের দলকেও আবারো পানির সন্ধানে বের হতে হয়। তাদের থেমে থাকার উপায় নেই। সব সময় চলতে হবে। এর মাঝেই যুদ্ধ। এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের হামলা। পবিত্র কোরান শরীফে সূরা তাকবীরে জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যা বিষয়ে আয়াত নাজেল হলো। কেয়ামতের বর্ণনা দিতে দিতে পরম করুণাময় বললেন-
‘সূর্য যখন তার প্রভা হারাবে, যখন নক্ষত্র খসে পড়বে, পর্বতমালা অপসারিত হবে। যখন পূর্ণগর্ভা উষ্ঠী উৎক্ষেপিত হবে, যখন বন্যপশুরা একত্রিত হবে, যখন সমুদ্র স্ফীত হবে, দেহে আত্মা পুনঃসংযোজিত হবে, তখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে- কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’
যে মহামানব করুণাময়ের এই বাণী আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, আমি এক অকৃতী তাঁর জীবনী আপনাদের জন্য লেখার বাসনা করেছি। সব মানুষের পিতৃঋণ-মাতৃঋণ থাকে। নবীজির কাছেও আমাদের ঋণ আছে। সেই বিপুল ঋণ শোধের অতি অক্ষম চেষ্টা।
ভুলভ্রান্তি যদি কিছু করে ফেলি তাঁর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি পরম করুণাময়ের কাছে। তিনি তো ক্ষমা করার জন্যই আছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করছি নবীজির কাছেও। তাঁর কাছেও আছে ক্ষমার অথৈ সাগর।
একরাতে হুমায়ূন আহমেদ ঘুম থেকে উঠে অযু করে নামাজ পড়লেন। তারপর গোসল করে লিখতে বসলেন। সে রাতে কি ঘটেছিল, কি লিখেছিলেন সেটা লিখেছেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাঁর অপ্রকাশিত কিছু রচনা নিয়ে ‘লীলাবতীর মৃত্যু’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। ভূমিকাতে হুমায়ূন আহমেদের শেষ কাজ হিসাবে গ্রন্থটির প্রধান আকর্ষণ উল্লেখ করেছেন নবীজিকে। তিনি সেখানে নবীজি লিখার ঘটনা প্রবাহ চিত্রায়িত করেছেন।
এছাড়া গ্রন্থটি প্রকাশের পর তিনি মিডিয়াকে বলেছেন। হুমায়ূন আহমেদ ‘নবীজি’ কিছু লেখার পর নবীজিকে স্বপ্নে দেখার ইচ্ছায় লেখাটি বন্ধ করে দেন। আমেরিকাতে চিকিৎসাধীন এক রাতে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে ‘নবীজি’ লেখা ফের শুরু করেন। এটি লিখাবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এটাই হুমায়ূন সাহিত্যের শেষ কাজ। হুমায়ূন নবীজিকে সে রাতে সম্ভবত স্বপ্নযোগে দেখেছিলেন। না হয় নবীজি ফের শুরু করার কথা নয়। কিন্তু রহস্যমানব নবীজিকে দেখেছেন কি না এটা কাউকে বলে যান নি।
নিচে পাঠকের জন্য নবীজির অসমাপ্ত অংশ তুলে ধরা হল-
‘ তখন মধ্যাহ্ন।
আকাশে গনগনে সূর্য। পায়ের নিচে বালি তেতে আছে। ঘাসের তৈরি ভারী স্যান্ডেল ভেদ করে উত্তাপ পায়ে লাগছে। তাঁবুর ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য সময়টা ভালো না। আউজ তাঁবু থেকে বের হয়েছে। তাকে অস্থির লাগছে। তার ডান হাতে চারটা খেজুর। সে খেজুর হাত বদল করছে। কখনো ডান হাতে কখনও বাম হাতে।
আউজ মনের অস্থিরতা কমানোর জন্যে দেবতা হাবলকে স্মরণ করল। হাবল কা’বা শরিফে রাখা এক দেবতা যার চেহারা মানুষের মতো। একটা হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল বলে কা’বা ঘরের রক্ষক কোরেশরা সেই হাত সোনা দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। দেবতা হাবলের কথা মনে হলেই সোনার তৈরি হাত চোখে চকচক করে।
দেবতা হাবলকে স্মরণ করায় তার লাভ হলো। মনের অস্থিরতা কিছুটা কমল। সে ডাকল, শামা শামা। তাঁবুর ভেতর থেকে শামা বের হয়ে এল। শামা আউজের একমাত্র কন্যা। বয়স ছয়। তার মুখ গোলাকার। চুল তামাটে। মেয়েটি তার বাবাকে অসম্ভব পছন্দ করে। বাবা একবার তার নাম ধরে ডাকলেই সে ঝাঁপ দিয়ে এসে তার বাবার গায়ে পড়বে।
শামার মা অনেক বকাঝকা করেও মেয়ের এ অভ্যাস দূর করতে পারেন নি। আজও নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না। শামা এসে ঝাঁপ দিয়ে বাবার গায়ে পড়ল। সে হাঁটতে পারছে না। তার বাঁ পায়ে খেজুরের কাঁটা ফুটেছে। পা ফুলে আছে। রাতে সামান্য জ্বরও এসেছে।
শামা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাবার কাছে আসতেই তার বাবা এক হাত বাড়িয়ে তাকে ধরল। এক হাতে বিচিত্র ভঙ্গিতে শূন্যে ঝুলিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। শামা খিলখিল করে হাসছে। তার বাবা যেভাবে তাকে কোলে তোলেন অন্য কোনো বাবা তা পারে না।
আউজ বলল, মা খেজুর খাও।
শামা একটা খেজুর মুখে নিল। সাধারণ খেজুর এটা না। যেমন মিষ্টি স্বাদ তেমনই গন্ধ। এই খেজুরের নাম মরিয়ম।
আউজ মেয়েকে ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। রওনা হয়েছে উত্তর দিকে। শামার খুব মজা লাগছে। কাজকর্ম না থাকলে বাবা তাকে ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে বের হন। তবে এমন কড়া রোদে বেড়াতে কখনও না। আউজ বলল, রোদে কষ্ট হচ্ছেরে মা?
শামা বলল, না।
তার কষ্ট হচ্ছিল। সে না বলল শুধু বাবাকে খুশি করার জন্যে।
বাবা!
হুঁ।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তোমাকে অদ্ভূত একটা জিনিস দেখাব।
সেটা কী?
আগে বললে তো মজা থাকবে না।
তাও ঠিক। বাবা, অদ্ভূত জিনিসটা শুধু আমি একা দেখব? আমার মা দেখবে না?
বড়রা এই জিনিস দেখে মজা পায় না।
আউজ ঘাড় থেকে নামাল। সে সামান্য ক্লান্ত। তার কাছে আজ শামাকে অন্যদিনের চেয়েও ভারী লাগছে। পিতা এবং কন্যা একটা গর্তের পাশে এসে দাঁড়াল। কূয়ার মতো গর্ত, তবে তত গভীর না।
আউজ বলল, অদ্ভূত জিনিসটা এই গর্তের ভেতর আছে। দেখো ভালো করে। শামা আগ্রহ এবং উত্তেজিত হয়ে দেখছে। আউজ মেয়ের পিঠে হাত রাখল।
তার ইচ্ছা করছে না মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলতে। কিন্তু তাকে ফেলতে হবে। তাদের গোত্র বনি হাকসা আরবের অতি উচ্চ গোত্রের একটি। এই গোত্র মেয়ে শিশু রাখে না। তাদের গোত্রের মেয়েদের অন্য গোত্রের পুরুষ বিবাহ করবে? এত অসম্মান?
ছোট্ট শামা বলল, বাবা, কিছুতো দেখি না।
আউজ চোখ বন্ধ করে দেবতা হাবলের কাছে মানসিক শক্তির প্রার্থনা করে শামার পিঠে ধাক্কা দিল।
মেয়েটি ‘বাবা’ ‘বাবা’ করে চিৎকার করছে। তার চিৎকারের শব্দ মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আউজকে দ্রুত কাজ সারতে হবে। গর্তে বালি ফেলতে হবে। দেরি করা যাবে না। এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। শামা ছোট্ট হাত বাড়িয়ে ভীত গলায় বলছে, বাবা, ভয় পাচ্ছি। আমি ভয় পাচ্ছি।
আউজ পা দিয়ে বালির একটা স্তুপ ফেলল। শামা আতঙ্কিত গলায় ডাকল, মা! মাগো!
তখন আউজ মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, উঠে এসো।
আউজ মাথা নিচু করে তাঁবুর দিকে ফিরে চলেছে। তার মাথায় পা ঝুলিয়ে আতঙ্কিত মুখ করে ছোট্ট শামা বসে আছে। আউজ জানে সে মস্ত বড় ভুল করেছে। গোত্রের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তাকে অবশ্যই গোত্র থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। এই অকরুণ মরুভূমিতে সে শুধুমাত্র তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বাঁচতে পারবে না। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে হলে তাকে গোত্রের সাহায্য নিতেই হবে। গোত্র টিকে থাকলে সে টিকবে।
বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্যে গোত্রকে সাহায্য করতেই হবে। গোত্র বড় করতে হবে। পুরুষশিশুরা গোত্রকে বড় করবে। একসময় যুদ্ধ করবে। মেয়েশিশুরা কিছুই করবে না। গোত্রের জন্যে অসম্মান নিয়ে আসবে। তাদের নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে যাওয়াও কষ্টকর। আউজ আবার গর্তের দিকে ফিরে যাচ্ছে। ছোট্ট শামা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। মরুভূমিতে দিকচিহ্ন বলে কিছু নেই। সবই এক। আজ থেকে সতেরো শ’ বছর আগে।
সূত্রঃ ত্রৈমাসিক হেরার জ্যোতি, ৪র্থ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, জানুয়ারী, ২০১৭। মাওলানা মহিউদ্দীন খান রহ. এর স্মরণে বিশেষ সংখ্যা।