ধর্মীয় শিক্ষা সংস্কারে আল্লামা শিবলী নোমানীর ঐতিহাসিক অবদান

মুহাম্মাদ রবিউল হক
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২০, ১০:৫৯ পিএম

আল্লামা শিবলী নোমানী। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন উসমানী সালতানাত তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। পাশ্চাত্য শক্তি একের পর এক মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোতে দখলদারিত্ব কায়েম করছিলো।
এদিকে ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের বাতিও প্রায় নিভু নিভু করছিলো। যদিও ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে মোঘল সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করা হয়। কিন্তু এর ফলাফলও খুবই ভয়ানক ছিলো।
শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর গ্রেফতার হোন এবং হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হয়। ফলে মোঘল সাম্রাজ্যের বাতি চিরদিনের জন্য নিভে যায়।
এরপর ভারতবর্ষের মহান দাঈ, মনিষা এবং মুজাদ্দিদরা মুসলমানদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
মাওলানা কাসেম নানুতবীর নেতৃত্বে একদল আলেম দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বীনের হেফাজতের দূর্গ গড়ে তোলেন।
অপর দিকে স্যার সাইয়্যিদ আহমদ আলীগড় কেন্দ্রিক নতুন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানদের পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা শুরু করেন।
এর দ্বারা একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, আলীগড়ে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ার ফলে মুসলমানরা পাশ্চাত্য জগতের অন্ধ অনুসারী হতে থাকে এবং ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন ছেড়ে পাশ্চাত্যের কৃষ্টি-কালচারে আকৃষ্ট হতে থাকে।
যার ফলে স্যার সাইয়্যিদ আহমদের এই প্রচেষ্টা অনেক আলেম গ্রহণ করতে পারেন নি।
কবি আকবর এলাহাবাদির ভাষায়, ‘তারা না পায় লেবুর স্বাদ আর না পারে মদ গলাধঃকরণ করতে।’
ঠিক এ সময় ভারতবর্ষে এমন এক দূরদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মহান মনিষীর জন্ম হয়, যিনি মনে করতেন, ‘প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া মুসলিমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না।’
এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব এমন বিপ্লবাত্মক শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন যার ঐতিহাসিক অবদান সম্পর্কে পক্ষে বিপক্ষের সবাই একমত। সেই মহান মনিষীর নাম আল্লামা শিবলী নোমানী।
আল্লামা শিবলী নোমানী ছিলেন কালজয়ী লেখক-গবেষক, অনন্যসাধারণ জীবনীকার-ঐতিহাসিক, যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিক-চিন্তাবিদ এবং খ্যাতনামা বিদ্বান-শিক্ষক।
কবি ও সাহিত্যের ইমাম হবার সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন এমন একজন আলেমে দ্বীন, যার চিন্তা-মনন আজ পর্যন্ত ইলমে নববীর ধারক-বাহকদের জন্য মশাল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
১৮৭৬ সালে আল্লামা শিবলী হজব্রত পালনের জন্য মক্কা গমণ করেন। ছয় মাসের এই সফরে তিনি স্বচক্ষে জাযিরাতুল আরব দেখার সুযোগ পান এবং হারামাইন শরিফাইনের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার এবং যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের থেকে ইলম অর্জন করেন।
দেশে ফিরে আল্লামা শিবলী পিতার আদেশে কিছু দিন ওকালতি প্র্যাকটিস করেন এবং কিছু দিন ব্যবসা-বাণিজ্যেও সময় দেন।
১৮৮৩ সালে আল্লামা শিবলীর জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়ে যায় যখন স্যার সায়্যিদ আহমদ তার প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান এ্যাংলো অরিয়েন্টাল কলেজে(আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়) তাকে ‘আরবি ও ফারসি’ বিভাগের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে নিয়োগ প্রদান করেন।
এই কলেজে শিবলী নোমানীর সঙ্গে পরিচয় হয় প্রফেসর থমাস আর্নল্ডসহ অন্যান ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের। যার ফলে তার পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচয় লাভের সুযোগ তৈরী হয়।
আল্লামা শিবলী ১৮৯২ সালে প্রফেসর আর্নল্ডের সঙ্গে তুর্কিস্থান,মিসর ও সিরিয়া অঞ্চল ভ্রমণ করেন এবং ছয় মাস অবস্থান করেন। তুর্কিস্থানে অবস্থানকালে খেলাফতে উসমানিয়া তার জ্ঞান-পাণ্ডিত্যে অভিভূত হয়ে তাকে ‘তমঘা-ই মজিদিয়া’ পদক প্রদান করে।
আল্লাম শিবলী আলীগড়ে দীর্ঘ ১৬ বছর শিক্ষতা করেন এবং স্যার সাইয়্যিদ আহমদের মৃত্যুর পর ১৮৯৮ সালে আলীগড় ছেড়ে জন্মভূমি আজমগড় চলে আসেন।
১৯০১ সালে তিনি হায়দরাবাদের শিক্ষা বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। সে সময়ের তার উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
১৯০৫ সালে তিনি হায়দারাবাদ ছেড়ে ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান নদওয়াতুল উলামায় চলে আসেন এবং এই নতুন প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন।
১৮৯৮ সালে নদওয়া প্রতিষ্ঠিত হয় যা ছিলো আল্লামা শিবলীর হৃদয়ের স্পন্দন,স্বপ্নের অনুরণন। তাই শুরু থেকেই এর জ্ঞান-গবেষণার মানোন্নয়নে রাত-দিন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। পাঁচ বছর অবস্থানের পর তিনি সেখান থেকে বিদায় নেন।
আল্লামা শিবলীর জীবনের উল্লেখযোগ্য অবদান মাদরাসার ‘নেসাবে তা'লিম’ বা শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা।
যার অবদান সাইয়্যিদ সুলাইমান নদভী,আব্দুস সালাম নদভী,সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী,মাসউদ আলম নদভী প্রমূখ যুগশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
কিন্ত আলেমদের একটি দল আল্লামা শিবলীর এই কারিকুলামকে শুধু প্রত্যাখানই করেন নি বরং তাকে নদওয়া ছাড়তে বাধ্যও করেন।
আল্লামা শিবলী নদওয়ায় ইংরেজি,সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান কে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূত করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেওবন্দ এবং আলীগড়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
তার ভাষায়, ‘আমাদের আলেম সমাজ প্রাচীন এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গমস্থল হবে।’ এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রাথমিক পর্যায়ের ইংরেজি ও বিজ্ঞান আবশ্যক ছিলো।
আজ শতবর্ষ পরে আলেমগণ অনুভব করছেন, আল্লাম শিবলীর ‘শিক্ষা কারিকুলাম’ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তার বিপ্লবাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক ছিলো।
উপমহাদেশের যে সব মাদ্রাসার নেসাব-নেযামে পরিবর্তন এসেছে সব কিছুতেই আল্লাম শিবলীর চিন্তা-চেতনার ছায়া পরিলক্ষিত হয়।
নদওয়াতুল ওলামায় তার নেসাবি কারিকুলাম প্রয়োগ করে মাত্র পাঁচ বছরে এমন ফলাফল বের করেন যা তার বিরুদ্ধবাদীরাও বিনাবাক্যে স্বীকার করতেন।
নদওয়ার কিছু আলিমদের আল্লামা শিবলীর শিক্ষা কারিকুলামের সাথে কঠিন মতানৈক্য ছিলো। যখন বাতাসের গতি পরিবর্তত হলো এবং নদওয়ার পরিবেশ তার জন্য সংকুচিত হয়ে আসলো তখন এই মহান মনিষী নদওয়া ছেড়ে জন্মভূমি আজমগড় চলে আসেন।
আজমগড় এসেই তিনি তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ‘দারুল মুসান্নিফীন’ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। তার মৃত্যুর পর তারই প্রিয় শিষ্য সাইয়্যিদ সুলাইমান নদবী যার সফল বাস্তবায়ন সম্পন্ন করেন।
আল্লামা শিবলীর রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আল ফারুক,ইলমুল কালাম,সাওয়ানেহ মাওলানা রুম,আল মামুন,সিরাতুন নু’মান, আল গাযালী,শে’রুল আযম,মুয়াঝেনায়ে আনিস ও দবির ইত্যাদি।
তবে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন সীরাতুন্নবী স. এর মাধ্যমে। যা পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যদিও তিনি সীরাতুন্নবীর মাত্র ২ খন্ড সম্পন্ন করে যেতে পেরেছেন।
এরপর তার স্নেহধন্য ছাত্র সাইয়্যিদ সুলাইমান নদবী দীর্ঘ ২৫ বছরের পরিশ্রমে তা পরিসমাপ্ত করেন। আল্লামা শিবলী উঁচু মানের একজন কবিও ছিলেন। আরবি,ফারসি এবং উর্দু ভাষায় তিনি কবিতা লিখেছেন।
তার কবিতার সংকলন ‘কুল্লিয়াতে শিবলী’ নামে প্রকাশিত।
আল্লামা শিবলী নোমানীর ছাত্রদের মধ্যে সাইয়্যিদ সুলাইমান নদবী,আব্দুস সালাম নদবী,সাইয়্যিদ সাজ্জাদ হায়দার, মাওলানা হসরত মোহানী,মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর,মাওলানা জাফর আলী খান এবং খাজা গোলাম সাকলাইন অন্যতম।
১৯১৪ সালের ১৮ নভেম্বর এই ক্ষণজন্মা বিদ্বান মনিষী নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক