ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের দুর্যোগের ভেতর অন্যরকম এক রমজান বা রামাদান পেয়েছি আমরা। হাজার কষ্টের ভেতরও রামাদানের (রমজানের) আনন্দ অনুভব করা যায় যেন।
প্রতিদিন সেহরি-ইফতারি ও তারাবির মাধ্যমে উদযাপন করছি রহমত মাগফিরাতের দিনগুলো। বেশ কয়েক বছর যাবত ঘুরে-ফিরে রমজান শব্দটির উচ্চারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মধ্যবিত্ত ধার্মিকদের ভেতর।
মধ্যবিত্ত বললাম একারণে যে, নিম্নবিত্তের মানুষরা এ সব শব্দ নিয়ে গবেষণা করার মতো অবসর পায় না। তারা কোনো চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতে শব্দ উচ্চারণ করে না। আগে থেকে চলে আসা শব্দই তারা হয়ত ব্যবহার করে। আর বিপরীত উচ্চারণেও তাদের কোনো অরুচি নেই।
সারা বছরই তাদের রোজা চলে তাই রোজার মাসে নতুন করে কোনো শব্দের প্রমিত উচ্চারণ নিয়ে মতামত দেয়ার মতো অবস্থা থাকে না। উচ্চবিত্তের লোকগুলোর তো ধর্মের প্রয়োজন হয় না।
তাদের জীবনে রমজান বলে কিছু নেই। প্রতিদিনই তাদের ঈদ। প্রতিদিন তাদের জন্য উৎসব।
রমজান রমাদান না রামাদান এ নিয়ে দ্বন্দ্ব একেবারেই অমূলক অর্থহীন। গোলাপকে তুমি যে নামেই ডাকো না কেন তা সুগন্ধি ছড়াবেই।
অনেকেই মনে করেন বিশেষ উচ্চারণে অধিক সওয়াব পাওয়া যাবে। বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। রমজান বলি আর রমাদান বলি রোজা রাখাটাই হচ্ছে আসল। রোজা না সিয়াম এনিয়েও মতামত রয়েছে।
রমজান রামাদান দু’ধরনের উচ্চারণের পক্ষেই যুক্তি রয়েছে। কারো যুক্তিই ফেলে দেয়ার মতো নয়। উভয় গ্রুপের যুক্তি নিয়েই আজ আমি আলোচনা করব।
প্রথম আলোচনা করি যারা রামাদান বলেন তাদের চিন্তাটা। অনেক সুন্দর একটা মানসিকতা রয়েছে এর নেপথ্যে। আরবিতে রমজান বলে আসলেই কোনো শব্দ নেই।
তারা চিন্তা করেন, প্রিয় রাসুল সা. ও তার সাহাবিরা প্রথম যুগের মুসলিমরা কিভাবে উচ্চারণ করত শব্দটি? আমরা যদি সেভাবেই উচ্চারণ করতে পারি তাহলে মন্দ কি? এটা দারুণ এক আবেগের ব্যাপার।
আসলেই তো প্রতিটি কাজেই একজন মুমিনের তো উচিত প্রিয় রাসুল সা.কে পূর্ণ অনুসরণ করা। কারণ তিনিই তো আমাদের জন্য আদর্শ এবং উসওয়াহ। [সূরা আহযাব]
এবার যারা রমজান উচ্চারণের পক্ষে তাদের যুক্তিটাও শোনা যাক। মূলত সাধারণ মানুষের জন্য প্রথম যুক্তিটা অনুধাবন যতটা সোজা দ্বিতীয় পক্ষের যুক্তিটা হয়ত তত সরলভাবে উপস্থাপন করা যাবে না। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক।
তার আগে বলে নেয়া যাক অজুকে কিন্তু প্রথম পক্ষও অদু বলে না। নামাজ কাজা করাকে কাদা বলে না। তার কারণ হয়ত এই যে, অজুকে অদু বললে খুবই শ্রুতিকটূ লাগে বাঙালির কানে।
দ্বিতীয় পক্ষের চিন্তা প্রথম পক্ষের সঙ্গে একস্থানে মিলে যায় সেটি হচ্ছে, অবশ্যই আমাদেরকে মহানবী সা.কেই অনুসরণ করা উচিত সব ক্ষেত্রে। আর নবীজীকে অনুসরণ করতেই আমাদের রমজান উচ্চারণ করা উচিত রমাদান নয়।
কি অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ আসলেই তাই। রাসুল সা. ও পবিত্র কোরআনের যে রীতি তাতে বাঙালিদের অবশ্যই রমজান বলা উচিত রমাদান নয়।
ভাষাতত্ত্ব একটি জটিল বিষয়। প্রত্যেকটি ভাষায় রয়েছে বিদেশি ভাষার শব্দ ভাণ্ডার। কোনো ভাষাই অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার না করে সমৃদ্ধ হতে পারে না। অন্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি পবিত্র কোরআন আমাদের শিক্ষা দিয়েছে।
সেটি হচ্ছে অন্য যে কোনো ভাষা থেকে কোনো শব্দ যখন কোনো ভাষায় গ্রহণ করা হবে তখন সেটিকে ভাষাভাষি লোকের রুচি অনুসারে পরিবর্তন করে নিতে হবে। পবিত্র কোরআনে হিব্রু থেকে আব্রাহাম মোজেস ইয়াসু জেকব প্রভৃতি নাম আনা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বহু শব্দ।
কিন্তু আরবদের কাছে শ্রুতিকটূ বা তাদের জন্য উচ্চারণ কষ্টকর হওয়ায় প্রতিটি শব্দের ভেতর পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন আমরা ইবরাহিম মুসা ইসা ইয়াকুব ইত্যাদি উচ্চারণেই বলি। অথচ এ শব্দগুলোর মূল উচ্চারণ অন্যরকম।
রমজান শব্দটির মূল উচ্চারণ যদিও রামাদান কিন্তু বাংলায় আমরা রমজান বলি কারণ এভাবে পরিবর্তনের কারণে শব্দটি বাংলার শব্দ ভাণ্ডারে যুক্ত হয়ে গেছে। হাজার বছর ধরে এভাবে উচ্চারিত হয়ে আসছে।
বাংলা ভাষায় আপন করে নেয়ার জন্যই শব্দটিকে আদর করে যেন এ দেশের মানুষ পরিবর্তন করে নিয়েছে। পরিবর্তন না করা হলে যেন দূরের মনে হয়। পরিবর্তনের পর একান্ত নিজস্ব হয়ে যায়।
অনেক ইংরেজি শব্দ বাংলায় ব্যবহার হয়। যে শব্দগুলো বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দভাণ্ডারে নিয়ে নেয়া হয়েছে সেগুলো কিন্তু ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে নেয়া হয়েছে। আর যেগুলো এখনও বাংলার সম্পদ হয়নি সেগুলো ইংরেজদের উচ্চারণেই ব্যবহার করা হয়।
এখন দেখার বিষয় রমজানকে কি আমরা আপন করে নিতে পারিনি? যদি আপন করে নিয়ে থাকি তাহলে রমজানই উচ্চারণ করা উচিত। আর দূরে দূরে রাখতে চাইলে রামাদান।
পাঠক আমি কোনো পক্ষ নিচ্ছি না। কিন্তু আপনি আশা করি নিজেই বুঝতে পারছেন প্রথম পক্ষের যুক্তি সুন্দর কিন্তু স্থূল। আর দ্বিতীয় পক্ষের যুক্তি অনেক সূক্ষ্ম।
স্থূলতা ও সূক্ষ্মতার ভেতর কোনটি শেষমেষ জয়ী হয় তা দেখার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। যেটির প্রচারণা বেশি হবে এক সময় সেটিই প্রমিত হিসেবে নির্ধারিত হয়ে যাবে।
এখন দেখা যাক স্থূলতার জয় হয় না সূক্ষ্মতার। এ দেশে হানাফিরা মুসলিমরা কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে স্থূলতাকে পরিহার করে চলে। আর আহলে হাদিস সালাফি বা জাহিরিদের ব্যাপারে স্থূলতার আরোপ করা হয়।
রমাদান শব্দটি হয়ত এ দ্বন্দ্বের ফল নয়। অথবা হতেও পারে এ ধরনের ইখতিলাফ থেকেই এর উৎপত্তি।
বাস্তবতা যাই হোক এ নিয়ে দ্বন্দ্ব না করে আসুন এ সময় বেশি বেশি ইবাদত-বন্দিগি করে রমজান বা রামাদানটাকে স্বার্থক বানাই। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।