একান্ত সাক্ষাৎকার- পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম
অর্থনীতি বাঁচানো ও মূল্যস্ফীতি থেকে মুক্তি দেওয়ার বাজেট

হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক ধাক্কা দেশের অর্থনীতিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। সেই নেতিবাচক প্রভাব এখনো চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাগত। তাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট তৈরি হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে। বিশেষ এ পরিস্থিতিতে কেমন হবে আগামী দিনের সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে জনমনে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) এবং আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে খোলামেলা কথা বলেছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট হবে অর্থনীতি বাঁচানো ও মূল্যস্ফীতি থেকে মুক্তি দেওয়ার বাজেট। এছাড়া ভারসাম্য রক্ষা ও নানামুখী ঝুঁকি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ থাকবে বাজেটে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার হামিদ-উজ-জামান।
যুগান্তর : চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নের অবস্থা এত খারাপ কেন?
ড. শামসুল আলম : কোভিড-১৯ মহামারি থেকে পুনরুদ্ধার আমরা ভালোই করেছি। চারদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়। ফলে খাদ্যের দাম যেমন বাড়ে, তেমনই খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কমে যায় টাকার মান। এ অবস্থায় আমাদের দেশে ইট, পাথর, সিমেন্ট, বিটুমিনসহ সব নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। যেমন: আগে ৬০ গ্রেডের এক টন রডের দাম ছিল ৬৪ হাজার টাকা। সেটি হঠাৎ করেই বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ টাকায়। আমাদের এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত। ঠিকাদাররা তাই কাজ বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দামই বেড়ে যায়। এ অবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দরপত্র অনুযায়ী ঠিকাদাররা যখন কাজ পায়, তখন এত দাম বাড়তে পারে, সেটি ভাবতেও পারেননি। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে দাম নির্ধারণ করা হয়। এতে বেশ খানিকটা সময় চলে যায়। বাজারে মূল্য পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করে দাম নির্ধারণ করতে সময় লাগে। এ কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়। তবে এখন কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, জুনের শেষে আরএডিপির বস্তবায়ন ভালো হবে।
যুগান্তর : আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব থাকছে কি না।
ড. শামসুল আলম : নির্বাচনি প্রভাব কিছুটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে যুবকদের প্রশিক্ষণসহ জনতুষ্টির বাজেট হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা সেটি করছি না। নির্বাচনের স্বার্থে প্রচুর ব্যয়ের লোভ দেখিয়ে বাজেট করা হচ্ছে না। এটি করলে দেশের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়বে। সরকার সেটি করছে না। আগামী বাজেট হবে অর্থনীতি রক্ষা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার বাজেট। নির্বাচন একটি শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সেটি যখন সময় হবে তখন অনুষ্ঠিত হবে। এর সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক স্থাপন করা হচ্ছে না। সরকার চেষ্টা করছে অর্থনীতি যাতে ভঙ্গুর অবস্থায় না যায়।
যুগান্তর : তাহলে আপনি বলছেন বাস্তবভিত্তিক বাজেট তৈরি হচ্ছে?
ড. শামসুল আলম : হ্যাঁ, অবশ্যই। আগামী বাজেট বাস্তবভিত্তিক হবে। কেননা ইতোমধ্যে সরকারের ভর্তুকি অনেক বেড়ে গেছে। ডিজেল, সারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকিতে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা লাগছে। সরকারকে ব্যাংক ঋণ অথবা বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এর ফলে বাজেট বড় করার সুযোগ নেই। সেই সঙ্গে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না। এর যৌক্তিক কারণও আছে। করোনা মহামারি এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক কমে গেছে। বিনিয়োগ প্রায় থেমে ছিল। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে কম আমদানি হওয়ায় এক্ষেত্রেও রাজস্ব কম এসেছে। এসব কারণে গত অর্থবছর এই সময় যেখানে রাজস্ব আদায় ১৬ শতাংশ ছিল এবং সেটি ১১ শতাংশে নেমে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে উচ্চাকাক্সক্ষী বাজেট দেওয়া যায়নি। সেটি আমরা চাইওনি। চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট কিছুটা বাড়বে। সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ইচ্ছামতো বাড়ানো হয়নি বাস্তবতা বিবেচনা করে।
যুগান্তর : আগামী বাজেটে বিশেষ গুরুত্বের দিক কোনটি?
ড. শামসুল আলম : এডিপি তৈরির সময় আমরা লক্ষ রেখেছি যেসব প্রকল্প কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখবে সেগুলোয় গুরুত্ব দিতে। কোভিড-১৯-এর কারণে দেশে যে শিখন ক্ষতি হয়েছে, সেটি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কৃষির প্রকল্প গুরুত্ব পেয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা বাজেট বাড়লেও সেটি থাকবে সীমার মধ্যে। কৃষিসংক্রান্ত প্রকল্পেও গুরুত্ব আছে। আমাদের বোরো ধান চমৎকার হয়েছে। ৯৫ শতাংশ মাঠের ধান কাটা মাড়াই শেষ হয়েছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথমদিকে সব কাটা হবে। শাকসবজির উৎপাদন ভালো হয়েছে। এসব মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। প্রয়োজনে আমরা আমদানির সুযোগ দেব। যেমন পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। আই পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। চালের দাম স্থিতিশীল আছে। এর মধ্যেও ডিম, তেল, চিনিসহ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। প্রচণ্ড গরমের কারণেও ডিমের দাম বাড়তে পারে। তবে আশা করছি, শিগগিরই এসব দাম কমবে। পণ্যমূল্য যাতে সহনীয় থাকে সেজন্য আগামী বাজেটে ব্যবস্থা থাকবে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাত সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধি পাবে।
যুগান্তর : উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়ে বাজারে নানা কথা আছে। এ সম্পর্কে বলুন।
ড. শামসুল আলম : প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ে এখন অনেক মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। যদিও এটা একটা অপ্রীতিকর কাজ। তবুও প্রস্তাবিত ব্যয়কে যুক্তিযুক্ত করা হচ্ছে। এছাড়া ভবন নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্প কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যথাযথ বিচারবিশ্লেষণ করে প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে। যেভাবে প্রকল্প বাছাই করা হয়েছে, এতে হয়তো আগামী দিনে পুনরায় ক্যাটাগরিভিত্তিক ভাগ করে গুরুত্ব নির্ধারণ করতে নাও হতে পারে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. শামসুল আলম : যুগান্তর পরিবারসহ আপনাকেও ধন্যবাদ।