
প্রিন্ট: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৪৯ এএম
তিন দিনের মিশর সফরে মাক্রোঁ, আলোচনায় গুরুত্ব পাবে যেসব ইস্যু

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
তিন দিনের মিশর সফরে যাচ্ছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ। রোববার মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে নানা ইস্যুতে বৈঠক করবেন তিনি৷ ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১১ বার কায়রো অথবা প্যারিসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেছেন এই দুই নেতা। তবে এবারের সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের দপ্তর এলিসি প্যালেসের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, সিরিয়া এবং প্রতিবেশী দেশ লিবিয়া, সুদান এবং ইসরাইলসহ আমরা এই অঞ্চলের সংকট নিয়ে কথা বলবো।
আরব বিশ্বের সঙ্গে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করার দীর্ঘদিনের ভূমিকা রয়েছে ফ্রান্সের। ফলে এবারও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাতের সমাধানে ভূমিকা রাখার আশা করছে ফ্রান্স।
তবে অধিকারকর্মীরা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মিশরের ভয়াবহ ইতিহাস তুলে ধরার জন্যও মাক্রোঁর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
এই সফরের আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা। কিন্তু বাস্তবে, সকলের দৃষ্টি রয়েছে গাজার দিকে। ইসরাইল সম্প্রতি হামাসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে আক্রমণ করার পর ইসরাইল গাজা উপত্যকায় পাল্টা আক্রমণ করে। হামাস ১,২০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে এবং দুই শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে। জিম্মিদের কয়েকজন এখনো হামাসের কাছে আটক রয়েছেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের আক্রমণে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং কিছু আরব রাষ্ট্রও হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাবদ্ধ করেছে।
এলিসি প্যালিসের মুখপাত্র জানিয়েছেন, আমরা একটি যুদ্ধবিরতি এবং যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তি নিয়ে কথা বলবো। পাশাপাশি, ফ্রান্স এবং মিশরের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব জোরদার করার লক্ষ্যও মাক্রোঁর রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আরব বিশ্বে ফ্রান্সের ভূমিকা কী?
সাবেক সাংবাদিক এবং বর্তমানে রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এইকে কনসিল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ এল কেই মনে করেন, ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মিশর এবং আরব বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগে ফ্রান্স এগিয়ে রয়েছে।
ডয়চে ভেলে’কে তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে ফরাসি-মিশরীয় সম্পর্ক চমৎকার। অনেক ফরাসি কোম্পানি মিশরে সক্রিয় এবং সেখানে তাদের কয়েক হাজার কর্মচারি রয়েছে। এছাড়াও, ২০১৫ সালে প্রথম দেশ হিসেবে ২৪টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনেছিল মিশর, যা অন্যান্য দেশে বিমান রপ্তানির পথ প্রশস্ত করেছিল। এখনো ফরাসি সামরিক সরঞ্জামের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক দেশ মিশর।
এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট শার্ল ডি গল-এর মধ্যপ্রাচ্য নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা এই জেনারেল মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যমপন্থি কৌশল অনুসরণ করেছিলেন।
এই কৌশলের ফলে রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সেটি নিঃশর্ত ছিল না। ডি গল ইসরাইলের নিন্দা জানিয়েছিলেন এবং ১৯৬৭ সালের জুনে মিশরে হামলা চালিয়ে ছয় দিনের যুদ্ধ শুরু করার পর ইসরাইলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছিলেন। আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে ডি গল সতর্ক অবস্থান নিয়েছিলেন।
এল কেই ব্যাখ্যা করেন, আরব বিশ্বে, বিশেষ করে মিশরে ফ্রান্সকে অত্যন্ত সম্মান দিয়ে দেখার এটি আরেকটি কারণ ১৯৯৫ সাল থেকে এলিসি প্যালেসে প্রবেশ ও সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি রয়েছে সাংবাদিক খালেদ সাদ জাঘলুলের। এই প্রবণতাটি তিনিও প্রত্যক্ষ করেছেন।
মিশরীয় পরামর্শদাতা জাঘলুল ডয়চে ভেলে’কে বলেন, প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক, নিকোলাস সারকোজি, ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ এবং এখন এমানুয়েল মাক্রোঁ সকলেই সপ্তাহে অন্তত একবার কায়রোর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। ১৯৭৯ সালে মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তির পর থেকে কায়রোকে একটি গ্রহণযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখা হয়ে আসছে। সেই সময়ে মিশর ছিল প্রথম আরব দেশ যারা তথাকথিত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরাইলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ফাওয়াজ গার্গেসের কাছে আসন্ন সফরের সময়কালটাও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নেতৃত্বে শূন্যতার সময়ে পশ্চিমা নেতা হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে মাক্রোঁর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন অসংলগ্ন বলে মনে হচ্ছে। জোট সরকার গঠনের আলোচনার নিজেদের সুশৃঙ্খল করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে জার্মানি। ইতালি এবং যুক্তরাজ্যের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রান্সের উপস্থিতিও কম।
মিশর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১১ কোটি এবং আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। গার্গেস বলেন, মিশরে যা ঘটে তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি রয়েছে। অভিবাসনের দিক থেকে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনেক শরণার্থীকে গ্রহণ করে দেশটি। লিবিয়ার মতো শরণার্থীরা (ইউরোপের দিকে) এগিয়ে যায় না। এমন একটি অঞ্চলে স্থিতিশীলতার আশ্রয়স্থল হিসাবে মিশরকে দেখা হয়, যে অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ এবং সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে।
সাংবাদিক জাঘলুল বলেন, মিশর সকল আঞ্চলিক সংঘাতে মধ্যস্থতার ভূমিকা নেয়। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বলা হয়, মিশর ছাড়া আপনি যুদ্ধ বা শান্তি স্থাপন করতে পারবেন না - আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এই জাতি একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
এদিকে মার্চের শুরুতে আরব লীগের ২২টি সদস্য রাষ্ট্র মিশরের রাজধানীতে বৈঠকে বসে। পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে গাজা পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনায় একমত হয় দেশগুলো। একমত হওয়া অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাসিন্দাদের গাজাতেই থাকতে দেওয়া এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দ্বারা গাজা পরিচালিত করার সিদ্ধান্তও ছিল।
এই প্রস্তাবটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিলিস্তিনিদের মিশর এবং জর্ডানে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিপরীত।
এলিসির মুখপাত্র জানান, আরব পরিকল্পনা আলোচনার জন্য একটি ভালো ভিত্তি, তবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং গাজার ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এটি সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন যে, এই সফরের ফলাফল পরবর্তীতে ওয়াশিংটনের কাছে উপস্থাপন করা হবে।
ফ্রান্স এবং সৌদি আরবও এই জুনে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের উপর একটি সম্মেলনের পরিকল্পনা করছে। সাদ জঘলুল আশা করেন যে মাক্রোঁর এই সফর ফলপ্রসূ হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ফ্রান্স, ইইউ এবং মিশরকে অবশ্যই চাপ তৈরি করতে হবে।
এদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ফ্রান্সকে মিশরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভিন্নভাবে ব্যবহার করার আহ্বান জানাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাটি মানবাধিকার সংকট এবং দেশটির বিরোধী রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের ওপর নিয়মতান্ত্রিক দমন সম্পর্কে সতর্ক করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মিশর প্রতিনিধি লেনা কোলেট ডয়চে ভেলে’কে বলেন, চূড়ান্ত ঘোষণায় মাক্রোঁর স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা উচিত, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করা উচিত এবং এই আগস্টে সংসদীয় নির্বাচন অবাধ ও গণতান্ত্রিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।