
প্রিন্ট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৫ পিএম
পারস্য সংস্কৃতির বিখ্যাত ‘নওরোজ’ উৎসব, ইরান ছাড়াও কোথায় কিভাবে পালিত হয়
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ১১:২৯ পিএম

আরও পড়ুন
ইরানি সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব ‘নওরোজ’। উৎসবটিকে নতুন দিনের সূচনা ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নওরোজ উদযাপন করা হয়।
শীতের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর গোলার্ধে দিন দীর্ঘতর হতে শুরু করে এবং কোটি কোটি মানুষ ফারসি নববর্ষ নওরোজ উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়। এই উৎসব বসন্তের আগমনী বার্তা বহন করে এবং নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
নওরোজ কী?
ফারসি শব্দ ‘নওরোজ’ অর্থ ‘নতুন দিন’। এটি ফারসি সৌর ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন ও নববর্ষের সূচনা।
নওরোজের ইতিহাস তিন হাজার বছরের পুরোনো এবং এটি জরথুষ্ট্রবাদ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামেরও পূর্ববর্তী এক প্রাচীন পারস্য ধর্ম। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর একটি, যা যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে।
নওরোজ পালিত হয় বসন্তের মহাবিষুব বা দিন-রাত সমান হওয়ার সময়, যখন সূর্য আকাশের বিষুবরেখা অতিক্রম করে। এটি শুধু বসন্তের সূচনা নয়, নতুন সম্ভাবনা, ভারসাম্য ও পুনর্জন্মের প্রতীক।
নওরোজ কখন পালিত হয়?
প্রতি বছর ১৯ থেকে ২১ মার্চের মধ্যে নওরোজ পালিত হয়, তবে এর সুনির্দিষ্ট সময় জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গণনার ওপর নির্ভর করে।
এটি যেহেতু সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই বিভিন্ন দেশে পালনে সময়ের তারতম্য দেখা যায়।
নওরোজ কোথায় পালিত হয়?
ফারসি সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে এমন দেশগুলোতে সাধারণত নওরোজ পালন করা হয়। যেমন:
• ইরান, আফগানিস্তান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান
• ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য ও বলকান অঞ্চল
• ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের কুর্দি সম্প্রদায়
• ভারত ও পাকিস্তানের ফারসি ও জরথুষ্ট্রী সম্প্রদায়
নওরোজ কীভাবে উদযাপিত হয়?
নওরোজ হল নতুন সূচনা, পরিচ্ছন্নতা ও সংযোগের উৎসব। অঞ্চলভেদে উদযাপনের রীতি ভিন্ন হলেও বেশ কিছু সাধারণ ঐতিহ্য সবার মাঝেই রয়েছে।
• পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা – উৎসবের আগে পরিবারগুলো তাদের ঘর
• বাড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করে, যা খারাপ শক্তি দূর করার প্রতীক।
• আগুনের ওপর দিয়ে লাফানো – নববর্ষের আগে শেষ বুধবারের রাতে লোকজন আগুন জ্বালিয়ে তার ওপর দিয়ে লাফ দেয়, যা পুরনো দুঃখ-কষ্ট দূর করা ও নতুন শক্তি আহরণের প্রতীক।
• নতুন পোশাক পরা– নওরোজের প্রথম দিনে নতুন জামা-কাপড় পরা হয়।
• খাবারের আয়োজন– ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘সবজি পলো বা মাহি’ (মাছ ও ভর্তা করা সবজি দিয়ে চালের খাবার) ও ‘আশ রেশতে’ (নুডল স্যুপ) খাওয়া হয়।
• পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো– উপহার বিনিময়, প্রিয়জনদের বাড়িতে যাওয়া ও খাবার ভাগ করে নেওয়া নওরোজের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্য।
• ১৩তম দিনে প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো– উৎসবের শেষ দিনে পরিবারগুলো প্রকৃতির মাঝে পিকনিকে যায়, যা খারাপ ভাগ্য দূর করার প্রতীক।
নওরোজ উৎসবে হাফত-সিন খাবার টেবিলের গুরুত্ব কী?
হাফত-সিন অর্থ “সাতটি ‘স’ দিয়ে শুরু হওয়া বস্তু”। এটি নওরোজের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্য।
এটি বিশেষভাবে সাজানো একটি টেবিল, যেখানে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু রাখা হয়, যা প্রতিটি আলাদা অর্থ বহন করে।
হাফত-সিনের ঐতিহ্য প্রাচীন পারস্য থেকে এসেছে, যেখানে মানুষ বিশ্বাস করত যে নির্দিষ্ট কিছু প্রাকৃতিক উপাদান আধ্যাত্মিক ও রক্ষাকবচের শক্তি ধারণ করে। সময়ের সঙ্গে এই ঐতিহ্য সাতটি বস্তুতে সীমাবদ্ধ হয়, যেখানে ৭ সংখ্যাটির পার্সি সংস্কৃতিতে গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে।
হাফত-সিন খাবার টেবিলের সাতটি পদ ও প্রতীকী
১. সবজি (অঙ্কুরিত গম, মসুর বা বার্লি)– নতুন জীবন ও পুনর্জন্মের প্রতীক।
২. সামানু (মিষ্টি গমের পুডিং)– ধৈর্য, শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
৩. সেনজেদ (শুকনো বন্য জলপাই)– ভালোবাসা ও জ্ঞানের প্রতীক।
৪. সির (রসুন)– স্বাস্থ্য ও দুষ্টশক্তি থেকে রক্ষার প্রতীক।
৫. সিব (আপেল)– সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক।
৬. সিরকে (ভিনেগার)– ধৈর্য ও অভিজ্ঞতার প্রতীক।
৭. সুমাক (গুঁড়ো করা লাল বেরি)– সূর্যোদয় ও আলো-অন্ধকারের জয়লাভের প্রতীক।
এছাড়াও অনেক পরিবার আয়না (আত্মবিশ্লেষণের জন্য), রঙিন ডিম (উর্বরতার প্রতীক), স্বর্ণমাছ (নতুন জীবনের প্রতীক) ও মোমবাতি (আলো ও সুখের প্রতীক) যোগ করে। কিছু পরিবার কোরআন, শাহনামা বা পারস্য কবি হাফিজের কাব্যগ্রন্থ রাখে, যা জ্ঞান ও আশীর্বাদের প্রতীক।
নওরোজ কেবল একটি নববর্ষ উদযাপন নয়, এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও নবজীবনের প্রতীক। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য, যা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সংযোগ তৈরি করে।