একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি বাতিল করে কেন গাজায় ভয়াবহ হামলা চালাল ইসরাইল?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০২:৫১ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী।মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) ভোরে চালানো এ বিমান হামলায় সবশেষ ৩৪২ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে গাজার মেডিকেল সূত্র। যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। গাজায় আকস্মিকভাবে ভয়াবহ এই হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সঙ্গে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করল ইসরাইল।
কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার সম্প্রচারিত ফুটেজে দেখা গেছে, নিহত ও আহতদের মধ্যে অনেক শিশু রয়েছে। উত্তর গাজা, গাজা সিটি, দেইর আল-বালাহ, খান ইউনিস এবং দক্ষিণে মিশরের সীমান্তবর্তী রাফাহসহ উপত্যকাটির বিভিন্ন এলাকা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।
গাজায় চালানো এই ভয়াবহ হামলার বিষয়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, তিনি গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। হামাস জিম্মিদের মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং সমস্ত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
নেতনিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরাইল এখন থেকে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে হামলার প্রসঙ্গে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পরামর্শ করে গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।
সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেমনটা স্পষ্ট করে বলেছেন, হামাস, হুথি, ইরান— যারা কেবল ইসরাইলকে নয়, যুক্তরাষ্ট্রকেও আতঙ্কিত করতে চায়— তাদের মূল্য দিতে হবে এবং তাদের ওপর নরক ভেঙে পড়বে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘হুথি, হিজবুল্লাহ, হামাস, ইরান এবং ইরান-সমর্থিত সন্ত্রাসী প্রতিনিধিদের উচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেওয়া। কারণ তিনি (ট্রাম্প) বলেন যে— তিনি আইন মেনে চলা মানুষের পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের মিত্র ইসরাইলের পক্ষে দাঁড়াতে ভয় পান না। ’
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা যতদিন প্রয়োজন ততদিন গাজায় আক্রমণ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত এবং বিমান হামলার বাইরেও অভিযানটি সম্প্রসারিত করবে। অর্থাৎ গাজায় স্থল অভিযানের ইঙ্গিত দিয়েছে সেনাবাহিনী।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী হামাস কমান্ডার এবং অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে ফুটেজ এবং স্থানীয় প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বহু বেসামরিক লোক নিহত এবং আহত হয়েছে।
হামাসের প্রতিক্রিয়া
গাজায় হামলার জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ‘নাৎসি-ইহুদিবাদী দখলদারিত্ব’-কে দায়ী করেছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, নেতানিয়াহু এবং তার চরমপন্থি সরকার যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যার ফলে গাজার বন্দিদের অজানা পরিণতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
হামাস যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইসরাইলকে দায়ী করার জন্য। এছাড়া আরব লীগ এবং ইসলামী সহযোগিতা সংস্থাকে (ওআইসি) ‘গাজায় আরোপিত অন্যায্য অবরোধ ভাঙতে’ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে একটি জরুরি বৈঠক করে ইসরাইলকে গাজায় আগ্রাসন বন্ধে বাধ্য করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে তিনটি ধাপ অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মার্চের শুরুতে শেষ হওয়া প্রথম ধাপে হামাস ৩৩ জন ইসরাইলি এবং পাঁচজন থাই বন্দিকে মুক্তি দেয়। এর বিনিময়ে ইসরাইলি কারগার থেকে মুক্তি পায় প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি।
ইসরাইল চুক্তির প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে, অন্যদিকে হামাসের দাবি, যুদ্ধবিরতি দ্বিতীয় ধাপে যাওয়া উচিত।
দ্বিতীয় ধাপের বিস্তৃত রূপরেখা হলো- গাজা থেকে সম্পূর্ণ ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে সকল জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া। যদিও এখনো এটিতে সম্মত হয়নি উভয়পক্ষ।
ইসরাইলি কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, হামাসের সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে অপসারণ না করা পর্যন্ত তাদের বাহিনী ছিটমহল থেকে সরে যাবে না।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হত। তৃতীয় পর্যায়ে গাজায় আটক ইসরাইলি
জিম্মিদের মৃতদেহ ফেরত পাঠানো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে উপত্যকার জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের পুনর্গঠন পরিকল্পনা ঘোষণা করার কথা ছিল বলে আশা করা হয়েছিল।
তবে গাজায় এখনো ৫৯ জন ইসরাইলি বন্দি রয়েছে। ইসরাইলি চ্যানেল ১২ একজন ইসরাইলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে গত ৩ মার্চ এক প্রতিবেদনে বলেছেন, সরকার গাজায় পুনরায় যুদ্ধ শুরু করার আগে হামাসকে তাদের হাতে বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য ১০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে।
হত ৪ মার্চ আরব লীগ মিশরের প্রস্তাবিত গাজা পুনর্গঠনের জন্য ৫৩ বিলিয়ন ডলারের একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এর লক্ষ্য হলো-গাজাবাসীদের বাস্তুচ্যুত না করেই তা পুনর্গঠন করা।
আরব লীগের পরিকল্পনাটিকে ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের ঘোষণার পাল্টা প্রস্তাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা দখল করে এটিকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার পরিকল্পনার কথা জানান। সেই সঙ্গে তিনি গাজাবাসীকে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা করছেন বলেও জানান।
ট্রাম্পের এই প্রস্তাবকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জাতিগত নির্মূলের সমতুল্য বলে নিন্দা করেছে। অন্যদিকে আরব লীগের পরিকল্পনাটি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি এবং জার্মানি সমর্থন করেছে।
এদিকে গত ২ মার্চ যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ইসরাইল গাজায় প্রবেশকারী সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেয়। এরপরেই তারা উপত্যকাটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দেন। আর এরপর আজ গাজায় ভয়াবহ বিমান হামলা চালালো দখলদার ইসরাইলি বাহিনী।
তথ্যসূত্র: আলজাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর