ভারতের নাগপুরে হিন্দু-মুসলমান সহিংসতা, কারফিউ জারি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০১:০২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ভারতের মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহরের বিভিন্ন এলাকায় সোমবার রাত থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ চলেছে। ব্যাপক পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি, দোকান ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ব্যবহার করে। পরে কারফিউ জারি করেছে প্রশাসন।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, নাগপুর শহরের মহাল এলাকায় সোমবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের দিকেও ব্যাপক পাথর ছোঁড়া হয়।
প্রাথমিকভাবে ছয় জন বেসামরিক নাগরিক ও তিনজন পুলিশ অফিসার আহত হন বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থাটি।
এরপরে কোতোয়ালি আর গণেশপেঠ এলাকাতেও সংঘর্ষ ছড়ায়। হাজার খানেক মানুষ ব্যাপকভাবে পাথর ছোঁড়া, ভাঙচুর চালায়। দোকানপাট আর গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার প্রায় ভোররাত পর্যন্ত পুলিশ নানা এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে ২০ জনকে আটক করেছিল।
বেলা দশটা নাগাদ মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্র মন্ত্রী যোগেশ কদম সংবাদ সংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, সহিংসতার কারণ এখনো খুঁজে বার করা যায়নি। এখনো পর্যন্ত ৪৭ জনকে আটক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। যদিও কারফিউ জারি আছে সেখানে।
যে অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়েছিল, সেই মহাল অঞ্চল ছাড়া শহরের অন্যান্য এলাকায় জনজীবন স্বাভাবিকই আছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন।
তবে পুলিশ নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানিয়েছে যাতে প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে না বের হন।
যেসব এলাকায় সোমবার রাত থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়েছে, সেটি হিন্দু পুণরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের মূল কার্যালয়ের একেবারেই কাছে। আবার মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবিশের বাড়িও নাগপুরেই।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
সোমবার দুপুরে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কবর সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দল নাগপুরের মহাল এলাকায় একটি বিক্ষোভ জমায়েত করে। ওই বিক্ষোভে আওরঙ্গজেবের একটি ছবি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি সম্ভাজিনগর জেলায় অবস্থিত খুলদাবাদ থেকে আওরঙ্গজেবের কবর সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে রাজ্যের নানা জায়গায় বিক্ষোভ হচ্ছে।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই পুলিশ সূত্র উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ওই বিক্ষোভ চলাকালে কোরআন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়ায়, যাতে মুসলমান সমাজের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়ায়। পরে এই এই সংক্রান্ত একটি অভিযোগও পুলিশের কাছে দায়ের করা হয়।
নাগপুর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার অর্চিত চন্দক সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, একটি গুজবের ফলেই সোমবারের ঘটনার সূত্রপাত। কিছু ভুল তথ্যের ফলেই এই ঘটনা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। সবার কাছেই আবেদন যে ঘর থেকে বের হবেন না, পাথর ছুঁড়বেন না। গুজবে বিশ্বাস করবেন না।
আবার নাগপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গডকরিও বলছেন, গুজব থেকেই এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়েছে।
নিজের এক্স হ্যান্ডেলে তিনি জানিয়েছেন, কিছু গুজবের কারণেই নাগপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় শান্তি বজায় রাখাটাই শহরের ঐতিহ্য। আমি সবার কাছে আবেদন করব যে কেউ কোনো ধরনের গুজবে কান দেবেন না, শান্তি বজায় রাখুন।
এআইএমআইএম নেতা ও সাবেক বিধায়ক ওয়ারিস পাঠানের কথায়, নাগপুরে অগ্নিসংযোগ ও পাথর ছোঁড়াছুঁড়ির ঘটনা হয়েছে। আমরা এ ধরনের সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই। প্রত্যেকের উচিত কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা মেনে চলা। কিন্তু এই ঘটনা হলো কীভাবে? প্রশাসন তদন্ত করে দেখুক এর পিছনে কী কারণ ছিল।
তিনি এও বলেছেন, গত কয়েকদিন ধরেই আওরঙ্গজেবের কবরের বিষয়টা নিয়ে মহারাষ্ট্র্রে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে যাতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়া যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলছেন
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে, সোমবার রাতে সব থেকে বেশি সহিংসতা হয়েছে শহরের চিটনিস পার্ক থেকে শুখরাওয়ারি তালাও রোড পর্যন্ত। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি চার চাকার গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, আবাসিক ভবনগুলোকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়।
এই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা মব ঢুকে পড়ে সেখানে। এলাকার বাড়িগুলোর দিকে পাথর ছোঁড়া হতে থাকে, গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। চারটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, একটি গাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।
এরপরে হনসাপুরি এলাকাতেও সহিংসতা ছড়ায়। ওই অঞ্চলের এক দোকানি সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি দোকান বন্ধ করছিলাম। হঠাৎ দেখি একদল লোক গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। আমি পানি নিয়ে এসে আগুন নেভাতে গেলে ওরা আমার মাথায় পাথর ছোঁড়ে।
ওই ব্যক্তির দুটি গাড়ি আর কাছাকাছি রাখা আরও কিছু গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় ওই দুষ্কৃতিরা।
হনসাপুরির আরেক বাসিন্দা এএনআইকে জানিয়েছেন যে সহিংসতা শুরুর আগে আক্রমণকারীরা প্রথমে সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
তার কথায়, ওদের মুখ ঢাকা ছিল। ধারালো অস্ত্র, লাঠি আর কাঁচের বোতল নিয়ে এসেছিল ওরা। এসেই দোকানগুলোয় হামলা চালাতে থাকে, পাথর ছুঁড়ছিল ওরা, গাড়িতেও আগুন লাগিয়ে দেয়।
আরেক বাসিন্দার অভিযোগ খবর দেওয়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে পুলিশ পৌঁছিয়েছিল সেখানে।
সূত্র: বিবিসি