সিরিয়া: সংঘাত থেকে বাঁচতে লেবাননে ১০ হাজার আলাওয়ি শরণার্থী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৫, ১১:২১ এএম
-67cfc8483ed3c.jpg)
সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে বাঁচতে আসাদপন্থি আলাওয়ি সংখ্যালঘুদের অন্তত ১০ হাজার সদস্য গত পাঁচ দিনে লেবাননে প্রবেশ করেছে এবং দেশটির উত্তরের বিভিন্ন শহর ও এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এর ফলে লেবাননে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এবং পুরনো সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ফের জেগে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে লেবাননের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
সোমবার (১০ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল।
সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে সহিংসতা লেবাননের উত্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে দেশটির সরকার শঙ্কিত। বিশেষ করে ত্রিপোলির বাব আল-তেব্বানেহ এবং জাবাল মোহসেন এলাকায় সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে, যেখানে গত ১৫ বছরে সুন্নি ও আলাওয়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একাধিক প্রাণঘাতী সংঘাত ঘটেছে।
ব্রিটেনভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে সিরিয়ায় চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ১,৩০০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৮০০ জনই বেসামরিক নাগরিক এবং বেশিরভাগই আলাওয়ি সম্প্রদায়ের। সিরিয়া সরকার বিদ্রোহীদের সাবেক শাসনব্যবস্থার অনুগত বলে অভিযুক্ত করছে এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছে।
গত ডিসেম্বরে বিদ্রোহীরা উপকূলীয় এলাকাগুলো দখল করার পর থেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি, দুটি সরকারপন্থী সেনার মৃত্যু হলে উপকূলীয় এলাকায় সহিংসতা আরও বেড়ে যায়।
একজন লেবাননি নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, গত পাঁচ দিনে প্রায় ১০ হাজার আলাওয়ি শরণার্থী সিরিয়া থেকে লেবাননে প্রবেশ করেছে। তারা ত্রিপোলি ও আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে, যা লেবাননের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। উত্তরের পরিস্থিতি যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে।
তিনি আরও জানান, জাবাল মোহসেন এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, এবং পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর অবস্থায় রয়েছে।
ত্রিপোলির জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ, যার ৮০ শতাংশ সুন্নি মুসলিম, ৬-৭ শতাংশ আলাওয়ি এবং বাকিরা খ্রিস্টান। বাব আল-তেব্বানেহ এলাকার বাসিন্দারা সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল, অন্যদিকে জাবাল মোহসেনের বাসিন্দারা আসাদকে সমর্থন দিয়েছিল। ২০১১ সালে সিরিয়ার সংঘাত শুরুর পর থেকে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে বারবার সংঘর্ষ হয়েছে।
লেবাননে অস্ত্র চোরাচালান ও নতুন হুমকি
সিরিয়ার সেনাবাহিনীর পতনের পর দেশটিতে অস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং লেবাননে এর প্রভাব পড়ছে। লেবাননের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কম দামে এসব অস্ত্র কিনে দেশের অভ্যন্তরে চোরাচালান করছে। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, মাত্র ২৫ ডলারে একে-৪৭ রাইফেল বিক্রি হচ্ছে, যা নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে।
বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথে থাকায় লেবানন দ্রুত তার প্রায় সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, শুধুমাত্র বৈরুত-দামেস্ক সংযোগকারী প্রধান ক্রসিংটি খোলা রাখা হয়। তবে, বিশেষ করে উত্তরের অবৈধ সীমান্তপথগুলো চালু ছিল।
লেবাননের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাড়তে থাকলে লেবাননে আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
এক কর্মকর্তা বলেন, সিরিয়ার সরকারপন্থি গোষ্ঠীগুলো আলাওয়িদের খুঁজে বের করার জন্য লেবাননের উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালাতে পারে এবং স্থানীয় সমর্থক মিলিশিয়াদের সহায়তায় সেখানে সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো লেবানন সীমান্তে সেনা সমাবেশ করছে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের বেকা উপত্যকার কাছে।
হিজবুল্লাহর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে লেবাননের উপজাতি গোষ্ঠী ও সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দামেস্ক সরকার সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালান প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়, যেখানে হিজবুল্লাহর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।
সিরিয়ার নতুন সরকার, যা বর্তমানে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নিয়ন্ত্রণে, হিজবুল্লাহ-সংশ্লিষ্ট চোরাচালান রোধের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এইচটিএস পূর্বে আল-কায়েদা ও আল-নুসরা ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এখন তারা লেবানন সীমান্তে নিজেদের আধিপত্য সুসংহত করার চেষ্টা করছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ার নতুন সরকার লেবাননের দিকে হামলা চালাতে পারে আলাওয়িদের তাড়ানোর জন্য। তবে আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এইচটিএস যদি বেকা উপত্যকা দিয়ে লেবাননে প্রবেশ করে এবং হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানোর চেষ্টা করে, তাহলে তা পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, লেবানন নতুন এক নিরাপত্তা সংকটের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সিরিয়া থেকে আসা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।